অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

এভাবে আনন্দিত হওয়া কোন সভ্য সমাজের অভ্যাস হতে পারে না!

তুষার আবদুল্লাহ, সাংবাদিক ও লেখক

প্রকাশিত: ০৪:৪৪ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার   আপডেট: ০৫:১৭ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার

অবয়বপত্র জুড়ে একটি  আলোকচিত্র ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই ছবি নিয়ে চলছে টিকা টিপ্পনী। রকমারি মন্তব্য আসছে। তবে আলোকচিত্রটিতে যে গল্প বলা হয়েছে, তা পুরাতন নয়। এমন গল্পের মুখোমুখি আমরা প্রতিদিনই হই। শুধু যে রাজনীতির মাঠে, আমলা–মন্ত্রীদের দফতরে এমন হয়, তা নয়। যেহেতু সংস্কৃতিটি আমাদের মজ্জাগত, তাই করপোরেট থেকে শুরু করে সাধারনের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। অবয়বপত্রে আমরা দেখতে পেলাম আজ স্বাস্থ্যমন্ত্রী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিচ্ছেন। তাঁকে ঘিরে আছেন, তাঁর দাপ্তরিক কর্মকর্তা, কর্মচারি এবং গণমাধ্যম কর্মীরা। লোকেলোকারণ্য পুরো ভ্যাকসিন নেয়ার ঘরটি। 

কোভিডে যেখানে দূরত্ব বজায় রাখার কথা স্বাভাবিক ভাবেই। এবং ভ্যাকসিন গ্রহণের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে, পরিচ্ছন্নতা ও সুরক্ষারও প্রয়োজেন, সেখানে এমন ভিড় কেন?  

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভ্যাকসিন গ্রহণের সময়েই যদি সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে, সেখানে সাধারন মানুষ যেখানে ভ্যাকসিন নেবে, সেখানকার অবস্থার কথা ভাবলে সত্যি আঁতকে উঠতে  হয়। গণমাধ্যম কর্মীরা দায় এড়াতে পারে না। তাদের এই হুমড়ি খাওয়ার দৃশ্য, প্রমাণ রাখে অসচেতনতা ও দায়িত্বহীনতার। তবে একথাও সত্যি মূলধারা ও  নতুনধারার গণমাধ্যম বিস্ফোরণে চিত্র সাংবাদিকের পরিমান বেড়েছে। তাদের সকলেরই ছবি নেয়ার তাগিদ আছে। এই ভিড়ের মধ্যে নিতে না পারাটাও ব্যর্থতা বলে ধরে নেবে বার্তাকক্ষ। তাই তাদের ঝাঁপিয়ে পড়তেই হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগ যদি তাদের জমায়েত হতে না দিতো। বলা হতো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ভ্যাকসিন নেওয়ার ছবি তারা নিজেরাই সরবরাহ করবে, তাহলে গণমাধ্যম কর্মীরা সেখানে ভিড় করতেন না।

অবয়বপত্র কিংবা গণমাধ্যমে আমরা এমন ছবি বিস্তর দেখি, এক থালা বা প্যাকেট খিচুরি বা একটি কম্বল বিত্তহীনকে বিতরণের দশ বিশ হাত বা তার চেয়েও বেশি হাতের প্রয়োজন পড়ে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের বেলাতে এমনটা ঘটে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানেও ফিতে কাটার সময় দেখা যাবে কাঁচি ধরতে একটি হাতই যথেষ্ট নয়। সকলকেই হাত দিয়ে ছুঁতে হবে কাঁচিটি। এইতো কিছুদিন আগেই অবয়বপত্রেই দেখতে পেলাম, একজন নেতা ধরনের কেউ কেক কাটবেন। তার কর্মী বা শিষ্যরা সেই ছুরি ধরতে পারছে না। কি করা? সকলে তখন একে অপরের হাত স্পর্শ করলো। শেষ হাতটি নেতাকে ছুঁয়ে থাকা মানে, সকলেই নেতা এবং ছুরির স্পর্শ পেলো এবং কেক কাটার অংশীদার হতে পারলো। এতেই তারা আনন্দিত। 

এভাবে আনন্দিত হওয়া কোন সভ্য সমাজের অভ্যাস হতে পারে না। একে অসভ্যতাই বলা যায়।

সাধারনভাবে আমাদের উঁকি মারা রোগ আছে। কেউ কোথাও ছবি তুলছে, একা বা দলগত ভাবে। দেখবেন পেছন থেকে কেউ একজন উকিঁ দিয়ে বসলো। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার চলছে, দেখবেন রিপোর্টার বা যিনি বক্তব্য রাখছেন, তাঁর পেছন দিয়ে অযথাই ঘুরছেন কিছু মানুষ। কেউ কেউ ফোন করে স্বজনদের বলছেন হয়তো, ঐ টিভিতে চোখ রাখতে। তার কথা বলার ভঙ্গি ও আচরণ আপনাকে এমন বার্তাই দেবে। সুতরাং উঁকি দেওয়ার অভ্যাস যে গোষ্ঠীর, তাদের কাছ থেকে এমন বেহায়াপনাইতো দেখবো তাই না? 

গণমাধ্যম কর্মীদের হুমড়ি খাওয়া দেখে, নিজেরাই হয়তো লজ্জিত হই। আজও কয়েকজন সহকর্মী এমন লজ্জার কথা প্রকাশও করেছেন অবয়বপত্রে। কিন্তু যতোক্ষণ পর্যন্ত, গণমাধ্যমের কভারেজ নেওয়া ব্যক্তি, সংগঠন, প্রতিষ্ঠান তাদের বেহায়াপনা থেকে সরে না আসবে, ততোক্ষণ গণমাধ্যম কর্মীদের হুমড়ি খাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দল, সরকারি দফতর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, তাদের কর্মসূচি বা আয়োজনের ছবি নিজেরা ধারন করে গণমাধ্যমে পাঠান। ব্যাপক গণমাধ্যমের উপস্থিতি চাইলে, তখন শৃংখল উপস্থিতির আয়োজনও রাখেন। বাংলাদেশে এক, দুইটি  প্রতিষ্ঠান এমন রেওয়াজ চালু করেছে। তবে রেওয়াজটি জনপ্রিয়তা পায়নি এখনও। সরকারি বেসরকারি দুইদিক থেকেও এব্যাপারে আরো উদ্যোগী হতে হবে। একই সঙ্গে গণমাধ্যম কর্মীদের পক্ষ  থেকেও নিজেদের মধ্যে শৃংখলা রক্ষার অনুশীলন শুরু করা প্রয়োজন। পেশাজীবী সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে।

তুষার আবদুল্লাহ : সাংবাদিক ও লেখক