অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার’ নাকি ‘নিরুপায় চাওয়া’?

গোলাম কিবরিয়া, সাংবাদিক ও লেখক

প্রকাশিত: ০৫:১৯ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০৫:২২ পিএম, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ শনিবার

লেখার শুরুতে একটা পুরনো কৌতুক শোনাই। 

ট্রেনের একজন সিগন্যাল ম্যান নতুন বিয়ে করেছেন। তো নতুন বৌয়ের কাছে নিজের বিরত্ব আর 'পাওয়ার' দেখানোর অভিপ্রায় নিয়ে ঘোষণা করে বসলের, "আমার এক ইশারায় চলন্ত ট্রেন থাইম্মা যায়, জানোস! আমার এত্তো পাওয়ার।" 

স্বামীর এই কথা শুনে বউ আহ্লাদে আটখানা। 

আবদার করে বসে, তাকে এই 'পাওয়ারের' নমুনা দেখাতে হবে। 

নবপরিণীতার আবদার রক্ষা করে না, এমন পুরুষ আছে নাকি? আমাদের সেই সিগন্যাল ম্যানও ব্যতিক্রম নন। অগত্যা নতুন বউকে নিয়ে চললেন তার 'পাওয়ার' দেখাতে। 
রেললাইন ধরে তখন তীব্র গতিতে ছুটে আসছে বিরতীহীন আন্তঃনগর ট্রেন। তার সামনেই আমাদের গল্পের নায়ক উড়িয়ে দিলেন লাল ঝাণ্ডা। ট্রেনের চালক পড়িমড়ি করে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষলেন। কোনোমতে থামালেন ট্রেনটি। 

কী ব্যাপার, কেন এই আকষ্মিক জরুরি সংকেত! খোঁজ নিতে এসে সুপারভাইজার দেখেন, কোনো কারণ ছাড়াই সিগন্যাল ম্যান লাল পতাকা দেখিয়েছেন।

ব্যাস, আর যায় কোথায়, ঠাস করে এক বিরাশি শিক্কার চড় কষিয়ে দিলেন সুপারভাইজার। 

বউটাতো হতভম্ব! 

"এইডা কী হইলো?" 

তার বিষ্ময় মাখানো প্রশ্নের জবাবে স্বামীটির উক্তি, "আমি তোরে দেখাইলাম আমার পাওয়ার, আর হ্যায় দেখাইছে হের পাওয়ার, বুঝলি?"

এই গল্প থেকে যে শিক্ষাটা আমরে পাই, সেটি অত্যন্ত সরল- পাওয়ার থাকলেই সেটা দেখানো সমীচীন নয়, আগে তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেয়াটা জরুরি। 

সম্প্রতি হাঙ্গেরি বাংলাদেশ থেকে টিকা চেয়েছে, নাকি বাংলাদেশ স্বতপ্রণোদিত হয়ে দেশটিকে টিকা দিতে চেয়েছে নিয়ে বেশ জোর আলোচনা চলছে। ফেসবুকে চলছে যুক্তি আর পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন। এ প্রসঙ্গে আমার সাবেক সহকর্মী, বর্তমানে ডয়েচেভেলেতে কর্মরত অনুপম দেব কানুনগোর দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরছি-

"বাংলাদেশের ৫,০০০ ডোজ টিকা না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে হাঙ্গেরি।

হাঙ্গেরিতে বাংলাদেশের টিকা পাঠানো নিয়ে দুই দেশের কোনো একজন মন্ত্রী মিথ্যা বলছেন। প্রশ্ন হচ্ছে- কোন জন?

সরকারের অব্যবস্থাপনা, সামাজিক বিধি মানতে জনগণের অনীহা ইত্যাদি সত্ত্বেও পরিসংখ্যানের হিসেবে অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় ভালো করছে। জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ যেখানে ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ করেও মৃত্যুর হার কমাতে পারছে না, সেখানে প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় আক্রান্তের সংখ্যায় বাংলাদেশ ১৩৭ নম্বরে, প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যায় মৃত্যুর তালিকায় বাংলাদেশ ১৩৬ নম্বরে।

এই পরিসংখ্যানই তো সরকারের জন্য গর্ব ও অহংকার করার মতো বিষয় হতে পারতো। পাশাপাশি ইউরোপের অনেক দেশের আগে টিকাদান শুরু করাও নিঃসন্দেহে প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে।

কিন্তু তারপরও কি সংসদে দাঁড়িয়ে মিথ্যা তথ্য দিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী? ৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সংসদকে জানান হাঙ্গেরি বাংলাদেশের কাছে টিকা চেয়েছে।

সংসদ টিভিতে সরাসরি প্রচার হওয়া তার বক্তব্য হুবহু তুলে ধরছি। "আমাদের কাছে গত সপ্তাহে চিঠি এসেছিল। পশ্চিম বিশ্বের অন্যতম উন্নত রাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যভুক্ত উন্নত রাষ্ট্র হাঙ্গেরি আমাদের কাছে অ্যাপিল করেছে পাঁচ হাজার ভ্যাকসিনের।"

বাংলাদেশের তো বটেই, হাঙ্গেরির নানা পত্রপত্রিকাতেও পরবর্তী কয়েকদিন গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয় এ সংবাদ, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন শিরোনামে।

স্ট্যাটাসের সঙ্গে সংযুক্ত ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন, বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো সংসদে দেয়া প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে 'বাংলাদেশের কাছে হাঙ্গেরি টিকা চায়' শিরোনাম করলেও হাঙ্গেরির পত্রিকা বলছে বাংলাদেশ এ টিকা কৃতজ্ঞতা থেকে উপহার দিতে চায়।

কী সেই কৃতজ্ঞতা? সেটিও নিঃসন্দেহে মহৎ কাজের জন্য। হাঙ্গেরির ডাক্তাররা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে হতদরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে পাঁচ শতাধিক বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি করেছেন।

আপনাদের নিশ্চয়ই পাবনার যমজ মস্তিষ্কের দুই বোন রোকেয়া-রাবেয়ার কথা মনে আছে? বাংলাদেশ ও হাঙ্গেরি মিলিয়ে দুই বোনের প্রায় অর্ধশত ছোটখাট অপারেশন হয়। ৩৩ ঘণ্টা অস্ত্রোপচারের পর ২০১৯ সালের ২ আগস্ট তাদের মস্তিষ্ক আলাদা করতে সক্ষম হন চিকিৎসকেরা। এই দলেও বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সার্বিক সহায়তা করেছেন হাঙ্গেরির বিশেষজ্ঞরা। শুধু বাংলাদেশ না, উপমহাদেশেই এরকম অস্ত্রোপচার প্রথম ছিল।

হাঙ্গেরির পত্রিকাগুলো বলছে, এই সমস্ত চিকিৎসা সহায়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ বাংলাদেশ নিজেই এই টিকা উপহার দিতে চেয়েছে। কিন্তু এটা বাংলাদেশের জনগণকে জানালেই বরং আরো ভালো হতো না? হাঙ্গেরির চিকিৎসকদের একটি মহৎ কাজের কৃতজ্ঞতায় বাংলাদেশও একটি মহানুভবতা দেখালে সেটা তো প্রশংসারই যোগ্য। তা না করে 'হাঙ্গেরি উন্নত দেশ হয়েও টিকা পাচ্ছে না, আমাদের কাজে হাত জোড় করেছে, আমরা দয়া করে দিচ্ছি'- এমন একটা ভাব দেখানোর কি কোনো প্রয়োজন ছিল?

৩ ফেব্রুয়ারি হাঙ্গেরিয়ান ভাষার অনলাইন পত্রিকা ব্লিক এক সংবাদে ৫,০০০ ডোজ টিকা আসার খবর দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত করে। কিন্তু একই সঙ্গে দেশটির মন্ত্রণালয় জানায়, এটি তারা চায়নি, বরং বাংলাদেশ নিজে থেকে দিতে চেয়েছে।

৪ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ভাষায় হাঙ্গেরি টুডে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে 'বাংলাদেশ যে ৫,০০০ টিকার ডোজ দিতে চায়, সেটা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে হাঙ্গেরির সরকার'। হাঙ্গেরির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্ধৃত করেছে পত্রিকাটি, "আমরা তাদের প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ জানাই, তবে আমরা তা গ্রহণ করবো না।"

অবশ্য 'কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার' দেয়া টিকা না নেয়ার পেছনে হাঙ্গেরির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো কারণ দেখায়নি বলে জানিয়েছে হাঙ্গেরি টুডে।

'উপহার' পাওয়া টিকা নিতে না চাওয়ার কারণ জানতে চেয়ে হাঙ্গেরির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইমেইল করেছি। দেখা যাক কী উত্তর আসে।

কিন্তু হাঙ্গেরি বাংলাদেশের কাছ থেকে টিকা না নেয়ার সিদ্ধান্ত যে কারণেই নিক, এই টিকা পাঠানোর সিদ্ধান্তটা কী 'কৃতজ্ঞতাস্বরূপ উপহার' ছিল নাকি 'নিরুপায় চাওয়া'? কোনটা সত্য?"

এখন ফিরে আসি সেই শুরুর গল্পটিতে। 

পাওয়ার দেখানো ভালো, আমরা সবাই পাওয়ার দেখাতে চাই, পাওয়ার দেখাতে ভালোবাসি। তবে এটা খেয়াল রাখা জরুরি, অন্যের পাওয়ারের তোপে যেন আমার নিজের পাওয়ার চুপসে না যায়! 

[এই কলামের সকল মত ও মন্তব্য লেখকের নিজের।