অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘অজগরের খাঁচায় জ্যান্ত খরগোশ’- কতটা যৌক্তিক আর কতটা অমানবিক?

নওশীন জাহান ইতি, শিক্ষক

প্রকাশিত: ০৭:৫৫ পিএম, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০১:৪৯ পিএম, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ রোববার

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ ক’দিন ধরে ভেসে বেড়াচ্ছে একটি ছবি। ঢাকার মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় অজগরের খাঁচায় অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে বন্দী এক খরগোশ। চোখে মুখে যেন তার বাঁচার আকুতি। আর খরগোশটির পেছনেই শীত নিদ্রায় নিমগ্ন দুটি অজগর। জ্যান্ত খরগোশটিকে খাঁচায় রাখা হয়েছে অজগরের খাবার হিসেবে। প্রাণিপ্রেমী হিসেবে যখনই ছবিটা চোখে পড়ছে, বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। মনের ভেতর দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে যতই ভাবছি বিষয়টা নিয়ে।
 
চিড়িয়াখানার মতো একটি অপ্রাকৃতিক পরিবেশে মাংসাশী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে জ্যান্ত প্রাণী দেওয়া কতটা যৌক্তিক? আর কতটা অমানবিক? খাদ্যশৃংখলের দিকে তাকালে দেখা যায় বাঘ, সিংহ বা অজগর- সকল মাংসাশী প্রাণী প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন্ত প্রাণিদের শিকার করেই খায়। তাহলে খাঁচায় বন্দী খরগোশ নিয়ে কেন সমালোচনার ঝড় বয়ে চলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই, দরকার নেই ত্রিশ বত্রিশ বছর চিড়িয়াখানার দায়িত্ব পালনের। মানবিকতা বোধ থেকে ভাবলেই মিলে যায় প্রশ্নের উত্তর। একটি প্রাণী সে খরগোশই হোক আর অন্য যেকোনো প্রাণীই হোক না কেন, তাকে দিনের পর দিন খাবার না দিয়ে অজগরের খাঁচায় আঁটকে রাখা কোনো ভাবেই কাম্য হতে পারে না। অজগর সাধারণত ১০ থেকে ১৫ দিন বা এর চেয়েও পরে খাদ্য গ্রহণ করে। আর তাই অজগরের খাঁচায় খাদ্য হিসেবে কোনো প্রাণীকে মৃত্যুর আগে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষণে ক্ষণে সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে বাধ্য করা নিষ্ঠুর আচরণের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ ছাড়া আর কি হতে পারে?
   
তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে অজগর কি খাবে? সবচেয়ে মানবিক উত্তরটি হতে পারে, এই খরগোশটিকেই খাবে, তবে জীবন্ত নয় বরং মৃত অবস্থায়। অর্থাৎ, খরগোশটিকে প্রথমে মেরে ফেলা হবে এবং এরপর তৎক্ষণাৎ অজগরকে খেতে দেয়া হবে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ অবশ্য দাবি করেছেন, অজগর জ্যান্ত প্রাণীই খেয়ে থাকে এবং তাতেই সে অভ্যস্ত। জ্যান্ত প্রাণী না দিলে অজগর তার প্রেডেটরি আচরণ ভুলে যাবে, স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। এমন কথার প্রতিত্তরে বলতে হয় চিড়িয়াখানা কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ না। যেকোনো প্রাণীই তার অভ্যাসের দাস। এছাড়া যদি উন্নত বিশ্ব এমনকি আশপাশের দেশগুলোর দিকেও তাকাই, তারা কিন্তু জীবন্ত প্রাণী খাবার হিসেবে দেওয়া নিষিদ্ধ করছে। অমানবিক ঘোষণা দিয়ে লন্ডন চিড়িয়াখানা প্রায় ১০০ বছর আগেই জীবন্ত প্রাণী খাবার হিসেবে দেওয়া বন্ধ করেছে। কিন্তু আমরা আজও পারিনি মানবিক হতে। মিরপুর চিড়িয়াখানায় হাতিকে ফুটবল খেলায় অভ্যস্ত করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু অজগরকে মৃত প্রাণী খাওয়ানো শেখানো যায়নি হয়তো স্বদিচ্ছা আর মানবিকতা বোধের অভাবেই। তবে এ কথা সত্যি যে সাপ সাধারণত জ্যান্ত প্রাণীই খেয়ে থাকে। আর এজন্যই উন্নত দেশগুলোয় অজগর সহ অন্যান্য সাপকে সদ্য মৃত প্রাণী দেওয়া হয়, নাহয় লম্বা লাঠির মাথায় মৃত প্রাণী বা মাংস রেখে নাড়ানো হয় যাতে সাপ খাবারটিকে জ্যান্ত মনে করে। কিন্তু আমাদের দেশে চিড়িয়াখানা কর্মীদের এতো সময় কোথায়? 

অনেকে অবশ্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন রাতের অন্ধকারে জ্যান্ত প্রাণী দেওয়া যেতে পারে অজগর বা অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীকে। কেননা চিড়িয়াখানায় মাংসাশী প্রাণীদের জীবন্ত প্রাণী খেতে দেখা অনেক দর্শানার্থীদের বিশেষ করে শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাই যখন দর্শনার্থী থাকবে না তখন জ্যান্ত প্রাণী দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, এখনো কেবল নিজেদের কথা ভাববেন? সেই ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণীর প্রতি যে অন্যায় হচ্ছে সেটা ভাববেন না? যেখানে মানুষের জীবন নিয়ে সংশয় সেখানে ক্ষুদ্র এক প্রাণী নিয়ে কেন এতো কথা বলছি? বলছি এজন্যই যে, যেখানে একটু মানবিক হওয়া যায়, একটু মানবিক আচরণ করা যায় সেখানে তা কেন করবো না? 

একজন মানুষের যেমন অধিকার আছে, তেমনই প্রাণীদেরও অধিকার আছে। তা আমরা যতই স্বীকার বা অস্বীকার করি না কেন। আর তাই তো ২০১৯ সালে বাংলাদেশে প্রণীত হয়েছে প্রাণিকল্যাণ আইন। ১৯২০ সালের প্রাণীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ সংক্রান্ত যে আইন আছে তা রহিত করে নতুন এই আইন প্রণয়ন করা হলেও তাতে প্রাণীদের প্রতি অমানবিক আচরণের শাস্তি অতি নগণ্য। তাই তো রাস্তার পাশে অথবা ডাস্টবিনে অসুস্থ গৃহপালিত প্রাণী পরে থাকতে দেখা যায় অহরহ। আর বাংলাদেশে চিড়িয়াখানা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট আইন বা নীতিমালা নেই বললেই চলে। প্রায়শই তাই সংবাদে উঠে আসে খাঁচায় বন্দী এসব পশুপাখির করুণ অবস্থার চিত্র। ২০১৮ সালে পরিচালিত এক জরিপে প্রাণীদের প্রতি সবচেয়ে সদয় আচরণকারী দেশ হিসেবে নাম উঠে এসেছে অস্ট্রিয়ার। আর সবচেয়ে নিষ্ঠুর আচরণকারী হিসেবে নাম এসেছে ইউরোপের দেশ বেলারুশ। এছাড়া চীনেও প্রাণীদের প্রতি অমানবিক আচরণের কথা প্রায়শই শোনা যায়। 

বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায়, জীবনের মূল্য এখনো অর্থ মূল্যেই নিরূপিত হচ্ছে। যে প্রাণীর মূল্য যত বেশি, তার যত্ন তত বেশি, তার অধিকারও তত বেশি। মানবিকতার প্রতীক হিসেবে খাঁচায়বন্দী খরগোশটিকে বাঁচাতে একদল প্রাণিপ্রেমী গিয়েছিল চিড়িয়াখানায়। কিন্তু সরকারের সম্পদ থেকে সাধারণ জনগণকে একটি ধূলিকণা দেয়ার অধিকারও কর্তৃপক্ষের নেই। একটি খরগোশ তো অনেক বড় ব্যাপার। সরকার ও সাধারণ জনগণই কার চা্ওয়া প্রাধান্য পাবে? সে কিছু প্রশ্নের উত্তর তোলা থাক পরবর্তী কোনো সময়ের জন্য। শুধু সাধুবাদ জানাই বাংলাদেশ র‍্যাবিট গ্রূপ নামের প্রাণীপ্রেমী সেই দলটিকে যারা চিড়িয়াখানায় জীবন্ত প্রাণী খাবার হিসেবে দেয়া বন্ধ করতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। জানি না তারা সফল হবেন কিনা বহুকাল ধরে চর্চিত এই প্রথা পরিবর্তন করতে। সেদিন সেই খরগোশটিকে বাঁচাতে পারেন নি তারা। কিন্তু বন্দী সেই খরগোশ যার নাম দেওয়া হয়েছে সূচনা, তার মধ্য দিয়ে হয়তো প্রাণীদের প্রতি আরেকটু সদয় আচরণ, আরেকটু মানবিক আচরণের সূচনা ঘটলেও ঘটতে পারে। 

নওশীন জাহান ইতি, প্রভাষক
জার্নালিজম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ ডিপার্টমেন্ট
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ