অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

আকাশের দিকে আর কেউ অর্থহীন চোখে তাকাবেনা

কাইসার রহমানী

প্রকাশিত: ১১:৩৮ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ১১:৩৮ এএম, ২৯ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

বয়স্ক আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ এখনো ডান অথবা বাম বাহু দেখিয়ে বলে, আমরাও টিকা নেয়েছিলাম। এই দ্যাখ টিকার সিল-ছাপ্পড়। বাহুতে টিকার নকশা দেখে কিছুটা অবাক হতে হতো। বাহুতে তারা ফুলের মতো উল্কি। আগে টিকার মেশিনের ছাপই ছিল এমন, তাই টিকা নিলে ছাপ থেকে যেত। এসব দেখে ও শুনে যারা নতুন জেনারেশনের তারা অনুমান করতাম, আগে বেশ আয়োজন করে টিকা দেয়া হতো।

মাঝখানের অনেকটা সময়, টিকার বিষয়টা তেমন জোরেসোরে আসেনি আর আমাদের সামনে। যক্ষা, পোলিও, হাম ইত্যাদির মতো রোগবালাই যত কমেছে, সাথে সাথে কমেছে টিকা নিয়ে আলাপচারিতা। কোভিড ১৯, যাকে আমরা করোনা ভাইরাস বলছি, সেটা পৃথিবীতে আসার পর জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। প্রাণ হারালো লক্ষ লক্ষ্ মানুষ। আক্রান্ত কোটি কোটি। জীবন-জীবিকা সবই হুমকির মুখে। অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো বিশ্বের ক্ষমতাশালী নেতারা  বলেই ফেললেন, এখন আকাশের দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই। গতবছরে তাই সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দ টিকা-টিকা আর টিকা।

সে টিকা এসেও গেলো। পৃথিবী জোড়া বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী গবেষকরা টিকার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন। আর টিকা আবিষ্কার করে ফেললেন। একটি দুটি নয়, প্রায় অর্ধ ডজন ভ্যারাইটির করোনা টিকা আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। বলা যায় একটু দ্রুতই হয়েছে।

কথা হচ্ছিলো টিকা হলেই কী বাংলাদেশ পাবে? সেসব সন্দেহ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এরই মধ্যে দেশে টিকা এসেছে। ৭০ লাখ ডোজ টিকা এখন আমাদের হাতে।

ভারতের সেরাম ইনস্টিউট থেকে অক্সফোর্ডের কোভিশিল্ড টিকা আমাদের হাসপাতালগুলোতে। খুশি দেশের মানুষ। আর খুশির বিষয় নিয়ে আয়োজন হবে এটাই স্বাভাবিক। অতীতের মতো কয়েকযুগ পর এবারো বেশ আয়োজন করে টিকা দেয়া হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে। চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধারা দিন রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন টিকা নিয়ে যে উৎসব তা সফল করার জন্য। কেমন ছিলো সে দৃশ্য?

বৃহস্পতিবার ( ২৮ জানুয়ারি ) সকাল ৯ টা থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও হাসপাতালে শুরু হয় টিকাদান কর্মসূচি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে নতুন নির্মাণ করা বিল্ডিংয়ে করা হয়েছে টিকাদান কেন্দ্র। সেখানে সকাল থেকে লোকজনের আনাগোনা আর গণমাধ্যমের স্টিকার লাগানো গাড়ির আসা- যাওয়া দেখে বুঝা যাচ্ছিলো, অন্যান্য দিনের থেকে এই দিনটা এখানে আলাদা। যখন পৌছালাম টিকাদান কেন্দ্রে তখন ঘড়িতে ১১টা। চারপাশের পরিবেশ কেবল সাদা আর সাদা। ডাক্তার, নার্স আর স্টাফদের সাদা এপ্রোনের কারণেই এমনটা মনে হচ্ছিলো। তারা ব্যস্ত, টিকা নিয়ে। প্রধান দরজায় হাতে স্যানিটাইজার নিয়ে কয়েকজন নার্স দাঁড়ানো। তাদের মুখে মাস্ক। সেই গেট দিয়ে আগতরা স্যানিটাইজার হাতে মাখিয়ে প্রবেশ করছেন বিএসএমএমইউর টিকাকেন্দ্রে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর কনক কান্তি বড়ুয়া ছুটোছুটি করছেন। চারটা ছোট বুথ বানানো হয়েছে। টেবিলে সাদা টেবিলক্লথ। সেসব বুথে গিয়ে তিনি সবার খবরাখবর নিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে ফাইল-পত্র নিয়ে কি যেন দেখছেন। বেলা ১১.৩০ টায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক পৌঁছলেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আরো ৮ থেকে ১০ জন আছেন। সবার মুখেই মাস্ক। এতো মানুষ থাকলেও, কোন বিশৃঙ্খলা নেই। অতি ব্যস্ততায় কিছুটা বিশৃঙ্খলা যা দেখা যায় তা গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যেই। কে কার আগে ছবি নিতে পারবে সে নিয়ে ক্যামেরাম্যানদের ছোটাছুটি চলছিলো। মন্ত্রীর বক্তব্য, টিকা গ্রহণকারী বক্তব্য ইত্যাদি নেয়ার জন্য একদিক থেকে আরেকদিকে দৌড়। কখনো হুড়োহুড়ি। কাখনো উচ্চস্বরে কথা। এই সব।
 
তবে সেটাও বেশিক্ষণ নয়। মন্ত্রী মহোদয় চলে যাবার পর, নীরবতা আসলো বুথে। অনেক সাংবাদিকই  স্পট ছেড়ে যান। কোন ক্যামেরা নেই ভিতরে। আছেন শুধু চিকিৎসক আর নার্স। তারপরেও পুরো পরিবেশটাকে উৎসব মনে হচ্ছিলো। সবার মুখে হাসি। টিকা নিতে যারা আসছেন, তারা হেসে হেসে আসছেন, টিকা নেবার পরও হাসতে হাসতে যাচ্ছেন। প্রশাসনের মানুষগুলোকেও দেখলাম উপস্থিত মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন টিকা নেয়ার জন্য।

রাস্তার যানজট পেরিয়ে এবার গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তখন বেলা ১২ টায়। আন্ডার গ্রাউন্ডে করোনা টিকার বুথ বানানো হয়েছে। মোট চারটি বুথ। মেডিকেলের পরিচালক স্বয়ং নিজে থেকে তদারকি করছেন সেসব। ভিতরে সংবাদকর্মীরা ভিড় করছেন। তবে আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ায় ইন্টারনেট সংযোগ সমস্যা থাকার কারণে বেশ কিছু টিভি চ্যানেল বুথের বাইরে গিয়ে সরাসরি সম্প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। বুথের ভিতরে সেই আনন্দের পরিবেশ। একজন আনসার সদস্য পেলাম, যিনি টিকা নিয়েছেন। সাংবাদিক ভেবে তিনি নিজেই এসে বললেন, টিকা নিয়ে ভাল লাগছে। যেন একটা ভাল কাজ করলাম।

যেসব হাসপাতালগুলোতে টিকা দেয়া হচ্ছে প্রায় সবখানে দেখলাম, সাধারণ মানুষও আসছেন খোঁজ খবর নিতে। সবার ভিতরেই যেন টিকাকে নিয়ে একটা উৎসাহ কাজ করছে। টিকা নেয়ার মানসিকতা যেন দৃঢ হচ্ছে। এই দুটো দিন একটা কথা বারবার শুনতে হয়েছে। টিকা নিয়ে যারা কথা বলেছেন প্রায় সবাই গুজবের বিষয়টা বারবার বলেছেন। তারা বলেছেন টিকা নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এসব বিশ্বাস না করতে।তবে টিকা নিয়ে যে উৎসব আর সাধারণ মানুষের আগ্রহ দেখলাম, মনে হয়েছে, এসব গুজব খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেনা। মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নেয়ার পথে…