অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ওটিটি প্লাটফর্ম: বিনোদনে নতুন বিপ্লব

বিনোদন প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৬:১৪ পিএম, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার  

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর সবগুলোই শারিরীক। হয়তো মানসিক বিষয়কে এখনও সমাজ গুরত্বের সাথে নেয়নি বলেই মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হয়নি বিনোদন। অথচ প্রত্যহ জীবনে মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রয়োজন বিবেচনায় অনায়াসেই জায়গা করে নিতে পারতো ৫ম স্থানটি। 

মানবজীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে বলেই হয়তো মার্কিন সাহিত্যিক মিখেইল কেবন বলেন- ভালো বিনোদন হলো একটি পবিত্র সাধনা, যা মানুষের জীবনমানের উন্নতি ঘটায়। বিনোদন মানেই কিন্তু কেবল চলচ্চিত্র বা গান নয়। খেলা, কবিতা, মঞ্চনাটক, যাত্রা, নৃত্য, কৌতুক, গল্পবলাও এর অন্তর্ভৃক্ত। মানব সভ্যতার শুরু থেকেই তাই জড়িয়ে আছে বিনোদন। কোরানে যেমন বর্ণিত আছে ধনুক নিক্ষেপ বা উটের দৌড় প্রতিযোগিতার কথা তেমনি রামায়নেও আছে নানা উৎসবের বর্ণনা।

মায়া সভ্যতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে দর্শকেরা রাজপ্রাসাদের সামনে বড় চত্বরে আসত এবং তাদের সুবিধামত উঁচু স্থানে বসত যাতে দূর থেকেও দেখা যায়। আবার কোথাও এমন মানুষ ছিলো যারা হেঁটে হেঁটে গল্প বলতো। যাদেরকে বলা হতো ‘গল্পকথক’। কোরিয়ায় রাজসভায় ভোজনালয়ে বিনোদনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হতো নৃত্য।  কোথাও গল্পবলা, কোথায় নৃত্য কোথাও বা গান; এভাবেই বাড়তে থাকে বিনোদনের মাধ্যম।

এদিকে মানুষ, প্রযুক্তি, বিনোদন মাধ্যেমের মিশেলে যেনো তৈরি হয়েছে এক ত্রিভুজ। যার একটি বাহু পাল্টালে পরবর্তিত হয় অন্য বাহুগুলোও। যেমন এখানে একই সাথে মানুষ ও বিনোদনে প্রভাব ফেলেছে প্রযুক্তি। নতুন প্রযুক্তির আগমনে মানুষ গ্রহণ করেছে নতুন বিনোদন মাধ্যম। 
এই যেমন রেডিও আসায় মানুষ ঘরে বসেই নিতে শুরু করলো গানের আসরের স্বাদ। আবার টিভির আগমনে বিনোদনের ঐতিহাসিক মাধ্যম যাত্রার জায়গা নিয়েছে নাটক বা সিনেমা। কিন্তু এই দুটির সমস্যা হলো সম্প্রচারের পর তা আর দেখার-শোনার সুযোগ নেই। এদিকে ই্উটিউব সে সুযোগ দিলেও এখানে সব কন্টেন্ট পাওয়া যায় না। 
পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের কি সে সময় আছে টিভির সামনে বসে থাকার? ‘লাক্সারী ট্রেপে’- পড়ে যে তারা আজকাল মহাব্যস্ত। কিন্তু বিনোদন তো চাই, এখন উপায়? প্রযুক্তির আশির্বাদে সে সুযোগ এখন আছে। শুধু আছে বললে ভুল হবে, বলতে হবে বিনোদন এখন হাতের মুঠোয়। আবার কেবল প্রাপ্যতাই সহজ হয়নি দেখার সময়ও এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণে। ব্যক্তি যখন, যেখানে, যেভাবে, যা মন চায় তাই দেখতে পারে। তাও আবার অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে।

বিনোদন মাধ্যমের নতুন এই ধারার নাম দেয়া হয়েছে ওটিটি প্লাটফর্ম (ওভার দ্যা টপ)। ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হয় বলে তার এমন নামকরণ। তবে অনেকেই এখন বলছেন এটা বিনোদনের লাইব্রেরী। ১৯৯৭ সালে নেটফ্লিক্স প্রথম এমন কিছু মানুষের সামনে তুলে ধরে। মানুষ তখন সিডি কিনে ছবি দেখতো। এমন করে ঘরে অনেক সিডি জমে কিন্তু সেগুলো নষ্ট হলে তা আর দেখা যায়না। 

নেটফ্লিক্স মালিকদের প্রাথমিক ভাবনা ছিলো অনলাইনে চলচ্চিত্রের একটি সংগ্রহশালা তৈরি করা। আস্তে আস্তে ছবির সাথে যুক্ত হয় গান, এনিমেশন, ড্রামা সিরিজ, ডকুমেন্টারি, ভ্রমণকাহিনী, কৌতুক সহ আরও অনেক কিছু। তবে দেখতে হবে টাকার বিনিময়ে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরের বছর কানাডায় নেটফ্লিক্স চালু হলে বিনোদন মাধ্যমের নতুন বিপ্লেব দেখা দেয়। কেননা এখানে কোনো কন্টেন্ট নির্দিষ্ট সময়ে দেখতে হয়না, সাথে বৈচিত্র তো আছেই। কেননা সেখানে বিশ্বের অসংখ্য দেশের কন্টেন্টের উপস্থিতি থাকে। 

২০১৬  সালে ১৩০ টি দেশের জন্য নেটফ্লিক্স উন্মুক্ত করা হলে হুড়হুড় করে বাড়তে থাকে এর সাবসক্রাইবার সংখ্যা। যার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বাজারে আসে আমাজন প্রাইম ভিডিওজ। এখনতো প্রতিটি দেশই ওটিটি প্লাটফর্মে সয়লাব। বাংলাদেশেই যেমন আছে আইফ্লিক্স বা বায়োস্কোপ। 

কতজন মানুষ ওটিটি প্লাটফর্মে আছে তা জানলে অবাকই হবেন পাঠকরা। শুধু নেটফ্লিক্সের সাবক্রাইবার সংখ্যাই ১৯৩ মিলিয়নের উপেরে। দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। মাত্র ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যেই পুরো মাস জুড়ে যে কোন অনুষ্ঠান দেখতে পারে একজন দর্শক। অন্যান্য গুলোর ক্ষেত্রে তা কিছুটা কম। 

কোভিট-১৯ পরিস্থিতিও এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে।  কারণ এই সময়ই দুনিয়া জুড়ে খেলাধুলা, সিনেমা হল বন্ধ থাকায় মানুষ ঘরে বসেই বিনোদন নেয়ার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় কম খরচে ওটিটি প্লাটফর্মের চেয়ে ভালো বিনোদন দেখার তো সুযোগ সেই। হল বন্ধ থাকায় অনেক নতুন ছবিও মুক্তি দেয়া হয় ওটিটিতে। ফলে নতুন কিছু নেই সেই অভিযোগও দিতে পারেনি দর্শকরা।  

সুবিধা কেবল দর্শকদের হয়েছে তাই নয়। অনেক পরিচালক্ও সুবধা পেয়েছেন। ভারতের অনুরাগ কাশ্যপের কথাই ধরুন, বলিউড হাঙ্গামার এক ইন্টারভিউতে তিনি বলেন- মানুষ আমার ছবি পছন্দ করলেও তা দেখতে পেতোনা। কারণ বড় বাজেটের ছবি আসলেই হলগুলোতে ছবি বন্ধ হতো। সেটা টের পাই ‘সেক্রেড গেমস’ নেটফ্লিক্সে প্রচার হওয়ার পর। কারণ আমার ছবি যারা পছন্দ করে তাদের অনেকের হলে যাওয়ার সময় হয়না ।  নিজেদের মতো সময় করে তারা ডাউনলোড করে সেগুলো দেখতেন। এখন ওটিটি প্লার্টফর্ম আসার ফলে তাদের জন্য দেখা সহজ হয়েছে। রিভিউ পড়ে আমি অবাক হয়েছি যে আমার ছবি এত মানুষ দেখে?

ভারতের অভিনেতা রনবির কাপুর আবার ভাবছেন ঠিক উল্টোটা। তিনি ওটিটি প্লাটফর্মের কোনো কন্টেন্টে কাজ করেন না কারন তিনি ভাবেন এর ফলে মানুষ হল বিমুখ হয়ে পড়বে। এমন বৈচিত্র হয়তো আরও আছে। কিন্তু তাতে কান না দিয়ে মহামারীর সময়ে ওটিটি প্লটফর্মে সহজেই  মানসিক প্রশান্তি নিচ্ছে কয়েক কোটি মানুষ।