অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

খেলনায় বিষ

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১১:২৫ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ১১:৩৬ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০২১ শুক্রবার

আদরের সন্তানের মুখে হাসি দেখার জন্যে বাবা-মা শিশুদের হাতে তুলে দেন সুন্দর খেলনা পুতুল। কিন্তু শিশুদের খুব প্রিয়, হাসি হাসি চেহারার কিছু পুতুল খেলনার মধ্যে ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান লুকানো থাকতে পারে বলে পরিবেশবাদী সক্রিয় গোষ্ঠী গ্রীনপিস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। গ্রীনপিসের গবেষক রিক হিল্ড জানান, ভঙ্গুর প্লাস্টিককে নরম ও নমনীয় করার জন্য প্যাথালেটস নামক এক ধরণের রাসায়নিক উপাদান ভিনাইলের সঙ্গে মিশিয়ে শিশুদের খেলনা বানানো হয়। শিশুরা যখন প্লাস্টিকের এসব খেলনা মুখে নিয়ে চুষতে থাকে কিংবা চুমু খায় তখন প্যাথালেটস উপাদান প্লাস্টিক থেকে বের হয়ে এসে শিশুদের মুখে প্রবেশ করে। প্যাথালেটসের মতো ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ খুব সহজেই শিশুর নরম শরীরে শোষিত হয়ে ভয়ানক ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই শিশুদের জন্য প্লাস্টিকের খেলনা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছে গ্রীনপিস।

গবেষকরা জানান, প্লাস্টিকের পুতুল খেলনা তৈরি হয় মূলত হালকা ও ভারী প্লাস্টিক দিয়ে। প্লাস্টিকের পুতুল খেলনার উপাদানকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে সফট পিভিসি বা প্লাস্টিসাইজড পিভিসি। সফট পিভিসির অন্যতম উপকরণ হচ্ছে প্যাথালেটস জাতীয় যৌগ। প্যাথালেটসকে বলা হয় পলিমারের তুলনায় অনেক কম আণবিক ওজন সম্পন্ন যৌগ। পিভিসি প্লাস্টিকের সুন্দর আকার দেওয়া বা আকর্ষণীয় করতে খুব সহজেই প্যাথালেটস ব্যবহার করা যায়। যা অন্য কিছু দিয়ে করতে গেলে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। আবার তৈরিকৃত পণ্যটিও দীর্ঘমেয়াদি হয় না। রাসায়নিক যৌগের আকৃতি ও প্রকৃতিভেদে প্রায় পঁচিশ রকমের প্যাথালেটস হতে পারে। কিন্তু সব প্যাথালেটসই কম-বেশি শরীর, পরিবেশ ও পানির জন্য বিপজ্জনক। তারপরও প্লাস্টিক ও ভিনাইল দিয়ে তৈরি হচ্ছে জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্রের পুতুল, মিকি মাউস, মুখোশ, ফলমুল, কীটপতঙ্গ, খেলনা বল, পাজল, বন্ধুক গাড়িসহ শিশু খেলনার সবকিছু। 

বিংশ শতাব্দী ধরে বিভিন্ন দেশে রাবার বা প্লাস্টিকের বিষাক্ত প্যাথালেটস এর ভয়াবহতা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা চলছে। প্যাথালেটসকে বলা হয় অ্যান্ডোক্রাইন ডিসরাপটর সম্পন্ন রাসায়নিক যৌগ। প্যাথালেটসযুক্ত এসব খেলনা পুতুল শিশুরা হাতে নিলে কিংবা মুখে দিলে এতে থাকা প্লাস্টিকের ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ শিশুর শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং নানান দুরারোগ্য রোগের সৃষ্টি হয়। শিশুদের খেলনায় এই উপাদান থাকলে তা শিশুর ওজন এবং মানসিক বিকাশ বাঁধাপ্রাপ্ত করে। এই প্যাথালেটস রাসায়নিক শিশুর শরীরে প্রবেশ করে হাঁপানি, টিউমার, ফুসফুস, কিডনী আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি, শারীরিক বৃদ্ধিজনিত ত্রæটিসহ ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে৷ এমন আশংকা থাকা সত্তে¡ও অনেক খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান খেলনায় রাসায়নিক দ্রব্যমিশ্রিত ভিনাইল ব্যবহার অবাহত রেখেছে বলে গ্রীনপিস জানায়। 

উল্লেখ্য, এই ভিনাইল দিয়ে করোনাকালে তৈরি হয় করোনার হ্যান্ড গ্লোভস। এর আগে পিভিসি জাতীয় প্লাস্টিকের মধ্যে মিশ্রিত বিষাক্ত প্যাথালেট জাতীয় পদার্থের কারণে পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি কতটা তা অনুসন্ধানে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষার অংশ হিসেবে দু’টো শহরের জনমানবশূন্য অংশে ঘরবাড়ির অব্যবহৃত প্লাস্টিক জাতীয় মালামাল ডাম্প করেন। তারপর প্রায় বছর দশেক পরে ওই এলাকার মাটি, পানি ও বাতাস পরীক্ষা করেন। কিন্তু ভয়ংকর খবর হচ্ছে, সেখানকার মাটি, পানি ও বাতাসে প্যাথ্যালেটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এমনকি ওই এলাকার জলজ প্রাণির টিস্যু পরীক্ষা করেও প্যাথালেটের মতো যৌগ পাওয়া যায় বলে বিজ্ঞানীরা জানান। দ্য কনজিউমার প্রোডাক্ট সেফিটি কমিশন এক রিপোর্টে বলেছে যে, ল্যাবরেটরি গবেষণায় দেখা গেছে ইঁদুরের ক্যানসারের সঙ্গে উচ্চ মাত্রার প্যাথালেটস এর যোগসূত্র রয়েছে। সন্দেহ করা হচ্ছে, ল্যাবরেটরির এ প্রাণীগুলোর যকৃৎ ও কিডনি নষ্ট হবার জন্যে প্যাথালেটস দায়ী। নিউইয়র্ক পাবলিক ইন্টারেস্ট রিসার্চ গ্রæপের আইনজীবী ট্রেসি শেলটেন বলেন, আমাদের শিশুরা যা নিয়ে খেলছে, জড়িয়ে ধরছে, বুকে নিয়ে ঘুমোচ্ছে এবং চুষছে তার মধ্যে বিষ থাকতে পারে তা চিন্তা করতেও ভয় হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রের খেলনা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মিলার বলেন, ভিনাইল খেলনা সম্পূর্ণ নিরাপদ। এটি গ্রীনপিসের আতঙ্কিত করার কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। তবে দ্য কনজিউমার প্রোডাক্ট সেফিটি কমিশন প্যাথালেটস উপাদান রয়েছে এমন ধরণের যে কোনো শিশু খেলনা বিক্রি বন্ধ করার আহবান জানায়। গ্রীনপিসের রিক হিল্ড বলেন, ভিনাইলের পরিবর্তে অনেক ধরণের পচনশীল জৈব প্লাস্টিক রয়েছে যা খেলনা তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। গ্রীনপিস এবং আরও কয়েকটি সক্রিয় গোষ্ঠী যেমন জেনারেশন গ্রীন এবং মাদার্স অ্যান্ড আদার্স গোষ্ঠীর সঙ্গে যৌথভাবে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে তারা প্যাথালেটসযুক্ত ভিনাইল পণ্য বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্তের জন্যে দু’টো উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করে।

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক।