অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

গাছে লাগানো পেরেক তুলতে ঢাকায় এসেছেন ওয়াহিদ সরদার

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৭:৫৮ পিএম, ১২ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ০৬:৩২ পিএম, ১৪ জানুয়ারি ২০২১ বৃহস্পতিবার

রাতে ফোন দেওয়া হলে, বারবার ওপাশ থেকে ব্যস্ত পাওয়া যায় ওয়াহিদ সরদারের মোবাইল। আধাঘন্টা চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া গেলো না। মোবাইলে তাকে না পেয়ে চায়ের অর্ডার দিলাম দোকানীকে। সেলফোনটা পকেটে রাখতেই ফোন বেজে উঠলো। কল ব্যাক করেছেন ওয়াহিদ সরদার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কথা বলতে লাগলেন তিনি।

ভাই ঢাকায় আসছিতো। বাড়ির লোকজন খুব চিন্তা করছে। বউ ছেলে মেয়ে সবার সঙ্গে কথা বললাম। তাই ফোন ব্যস্ত। 
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে হো হো হো করে হেসে উঠলেন ওয়াহিদ সর্দার। বুঝতে পারলাম ওয়াহিদ ভাই দীর্ঘদিন গাছ নিয়ে কাজ করতে করতে গাছের মতোই উদার আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছেন। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, ভাই কাল একটু সময় দেন। আপনার সঙ্গে কথা বলবো। সময় দিলেন পরের দিন সকালবেলা। 

ওয়াহিদ সরদারের পরিচয়টা বলা যাক। তার বাড়ি যশোর জেলায়। একটা সাইকেল, লোহার রড, একটা ব্যাগ, আর মাথায় মাথাল (কৃষকরা মাথায় পড়েন) নিয়ে সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান। তিনি একসময় সারা যশোর জেলা ঘুরে বেড়াতেন। গাছে অন্য মানুষরা নির্দয়ের মতো যে লোহার কাঁটাতার (পেরেক), নাইলন দড়ি, ইত্যাদি গেঁথে দিয়ে যেতেন, গাছ থেকে সেসব তুলে গাছকে শান্তি দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ২০১৮ সালের জুলাই মাস থেকে গাছের পেরেক অপসারণ শুরু করেন ওয়াহিদ সরদার। যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা, মেহেরপুর চারটি জেলার বিভিন্ন রাস্তার ধারে থাকা গাছ থেকে পেরেক অপসারণ করে যাচ্ছেন তিনি। সারাদেশের প্রায় পঁচিশ হাজার গাছ থেকে তিনি পেরেক তুলেছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ কিলোমিটার সাইকেল দিয়ে ঘুরে রাস্তার গাছ থেকে ৪৪০ কেজি অর্থাৎ প্রায় ১১ মন পেরেক তুলেছেন ওয়াহিদ সরদার। 

যশোর থেকে সাইকেল নিয়ে গাছের পেরেক তুলতে তুলতে তিনি গত শুক্রবার ঢাকায় এসেছেন। এবার তিনি ঢাকার গাছকে লোহার পেরেক, দড়ি, কাঁটাতার ইত্যাদি মুক্ত করবেন। 

পরেরদিন সকালে ওয়াহিদ সরদারকে সেলফোনে কল দেয়া হলো। আবারও ফোন ব্যস্ত। পরে তিনিই ফোন ব্যাক করলেন। বললেন, তিনি শাহবাগের জ্যামে সাইকেল নিয়ে বসে আছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাবেন। সেখানেই চলে আসতে বললেন। জ্যাম এতটাই তীব্র ছিল কথা বলতে বলতেই শাহবাগ মোড়ে তার দেখা পেলাম। চিনতে কষ্ট হলোনা । কারণ, মাথায় পতাকার রঙের মাথাল। পায়ে পুরনো ময়লা কেডস।  গাছ থেকে পেরেক তোলার জন্য হাতে তৈরি বিভিন্ন সরঞ্জমাদি। আর সাইকেলের সামনে একটা ব্যানার। তাতে, মানুষকে গাছকে কষ্ট না দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। রিকশা নিয়ে পিছু নিলাম ওয়াহিদ সরদারের।  

চলতে চলতে হঠ্যাৎ তিনি একজায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন। সাইকেলটা রেখে, লোহার যন্ত্র হাতে নিয়ে গাছের দিকে তাকিয়ে গুনতে লাগলেন এক... দুই... তিন...। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখছেন, কম পক্ষে ৩৭টা পেরেক গাঁথা আছে এই গাছে। এত বড় কাঁটাতার দিয়ে নৌকা বানানো হয় গ্রামদেশে। আর এসব সাংঘাতিক পেরেক গাছটার বুকে ঠুঁকছে। গাছটা বাঁচবে ক্যামনে! কথা শেষ করে গাছ থেকে পেরেক তুলতে লাগলেন তিনি। 

পেরেক তুলতে গিয়ে শীতের দিনেও ঘামছেন ওয়াহিদ সরদার। কপাল থেকে ঘাম তার থুতনিতে নামছে বেয়ে বেয়ে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। বোঝা যাচ্ছে বড় বড় পেরেকগুলো এমনভাবে গাছে গাঁথা হয়েছে, গাছের খুব ভিতরে চলে গেছে সেসব। গুণে গুণে ৩১ টা বড় পেরেক বের করলেন তিনি গাছ থেকে। 

তিনি এবার কিছুটা ক্লান্ত হয়ে গাছে হেলান দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, এতো কাজ থাকতে কেন এই কাজ করেন? কপালের ঘাম মুছে ওয়াহিদ সরদার অপরাজেয় বাংলাকে বললেন, ২০০৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত নিজ খরচে এবং বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় প্রায় ৩০ হাজার গাছ লাগিয়েছেন তিনি। গাছকে ভালবাসেন তিনি। গাছই তার বন্ধু। কিন্তু নিরাপত্তাহীনতায় গাছ ভুগছে কাঁটার আঘাতে। বিজ্ঞান বলছে গাছের জীবন আছে, যেহেতু জীবন আছে তার মানে তার যন্ত্রণা, ব্যথা আছে। এ কারণে তিনি নেমে পড়েছেন গাছের বুক থেকে কাঁটা তুলতে। 

সাইকেলে রাখা ব্যাগে গাছ থেকে তোলা কাঁটাগুলো তুলে রাখলেন। তারপর সাইকেল ঘোরালেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্ত্বরের দিকে। জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাচ্ছেন। তিনি বললেন, সামনের দিকে অনেক গাছ আছে মনে হয়। আমি বললাম, আপনিতো এই জায়গা চেনেন না, বুঝলেন কিভাবে গাছ আছে। তিনি বললেন, ভাই, অনুভূতি আছে বলেইতো বুঝতে পারি গাছের কষ্ট। আমার গাছ বন্ধুরা কোথায় কষ্টে আছে, অনুভূতিই আমাকে সেখানে নিয়ে চলে যায়। সাইকেল প্যাডেল ঘুরিয়ে সাইকেলে উঠে পড়লেন তিনি। পিচঢালা রাস্তায় মাথায় মাথাল নিয়ে ছুটছে একজন গাছের বন্ধু। অনেকেই মোবাইলে ছবিও তুলছেন ওয়াহিদ সরদারের। সাইকেল চালাতে চালাতেই তিনি বললেন, ২০১৮ সাল থেকে একই কাজ করছি, কেউ দাম দিতোনা। এখন মিডিয়ায় আসছি বলে লোকজন ছবিও তুলে। কিন্তু প্রচারের জন্য আমি কাজ করিনা। 

মল চত্বরের বিভিন্ন গাছ থেকে প্রায় দেড়কেজি পেরেক তুললেন ওয়াহিদ সরদার। পেরেক তোলার সময় কিছু কাঁটাতার তার মাথায় পড়ছে, কপালে পড়ছে, বুকে পড়ছে। জিজ্ঞেস করলাম, আহত হয়েছেন কখনো? বললেন, অনেকবার কপাল ফেটেছে, হাত-পা কেটেছে। 

ব্যাগে রাখা পানি দিয়ে মুখ ধুলেন তিনি। গামছা দিয়ে মুখ মুছে আবার তাকালেন গাছের দিকে। একটা বড় গাছের দিকে তাকিয়ে অপলক চোখে কি যেন ভাবতে লাগলেন।  বিড়বিড় করে বললেন, কিছু শিক্ষিত মানুষ গাছের সাথে বৈরি আচরন করছে। এরমধ্যে পলিটিশিয়ান আছে, ডাক্তার আছে, কোচিং সেন্টার আছে, এর ভিতরে ভর্তি চলিতেছে আছে, পাত্র চাই আছে, কলিকাতা হারবাল আছে যারা গাছে নিজেদের প্রচারণার জন্য কাঁটাতার গাঁথেন। ২০০৮ সাল থেকে ১৪০০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে , রাস্তায় থেকে গাছের কাঁটা তুলেছি। এরপরও গাছের কাঁটা কমছেনা। তুলি আবার মানুষ গাছের পেরেক ঠুঁকে যায়। 

কথা বলতে বলতে দুপুর হয়ে যায়। ওয়াহিদ সরদারকে বললাম চলুন দুপুরের খাবার খাই। কথাটি শুনে মাথাল মাথা থেকে নামিয়ে মুখে থাকা সাদা দাঁড়িতে হাত দিয়ে বললেন, আমার ব্যাগেই খাবার আছে। মানুষের দেয়া খাবার খেলে মানুষ মনে করবে, আমি খাবারের জন্য এসব করি। আমি কোন ধান্দা করিনা। কারো কাছে কোনো সুবিধা নেইনা। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্ত্বরের গাছগুলো থেকে পেরেক অপসারন শেষ। এবার তিনি যাবেন রমনা পার্কের দিকে। সাইকেলে ঝোলানো ব্যাগে অনেক পেরেক জমা হয়েছে প্রায় ৫ কেজি হবে ওজনে। জিজ্ঞেস করলাম, এসব পেরেক কি করেন? জানালেন, অনেকেই বিশ্বাস করেননা যে তিনি এসব বিক্রি করেন না। একটা মানুষ যে এমন কাজ করতে পারে তা কিছু মানুষ বিশ্বাসই করতে চান না। 
 
কথা বলতে বলতে সাইকেলে উঠে পড়লেন ওয়াহিদ সরদার। বিদায় নিয়ে কিছু দূর গিয়ে আবার ফিরে আসলেন। বললেন, গাছ থেকে যা বের হয়, আপনারা তাকে কি বলেন? কষ বলেন, কেউ বলে আঁঠা। আসলে, ওসব হচ্ছে হচ্ছে গাছের রক্ত। গাছের বুক দিয়েও রক্ত বের হয়। কারণ গাছেরও প্রাণ আছে। 

কথাটা শেষ করে সুন্দর একটা হাসি দিয়ে সাইকেল চালিয়ে রাস্তার শেষ বিন্দুতে হারিয়ে গেলেন ওয়াহিদ সরদার। আমার মাথায় ঘুরতে থাকে তার শেষ কথা, গাছেরও প্রাণ আছে।

ভিডিও স্টোরিটি দেখুন: