অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১৩

খ ম হারূন

প্রকাশিত: ০৩:৫৮ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ১০:৪৩ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।

[পর্ব-১৩]

 

১৯৭৮ এ ছোটো পরিসরে ‘বাংলাদ্শ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এ্যন্ড আর্কাইভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়, যে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন শিল্পী আব্দুর রউফ। বাংলাদেশের সংবিধানের একটি হস্তলিপি তিনি তৈরী করেছিলেন নিজ হাতে। ১৯৮১ সালে শিল্পী আব্দুর রউফের উদ্যোগে এবং চিত্র পরিচালক আলমগীর কবীরের তত্ত্বাবধানে ইন্সটিটিউটে চালু হয় চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষা কার্যক্রম। আমাকে সেখানে পাঠদানের সুযোগ দেয়া হয়। 

মোরশেদুল ইসলাম, তারেক মাসুদসহ পরবর্তি সময়ে প্রতিষ্ঠিত অনেক চিত্রনির্মাতা ওই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নের সুযোগ পান। আমি মুলত চলচ্চিত্রের সেট, কস্টিউম ও ডিজাইনের ক্লাস নিতাম। তখন থেকেই আলমগীর কবির ভাইকে কাছ থেকে জানার সুয়োগ হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ছিলো অনন্য ভূমিকা। স্টপ জেনোসাইড চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। কবির ভাইয়ের অকাল মৃত্যু আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। 

২০ জানুয়ারি ১৯৮৯, নগরবাড়ীঘাটে এক দুর্ঘটনায় মাত্র ৫০ বছর বয়সে তাঁর মতো একজন প্রতিভাবান চলচ্চিত্র পরিচালককে আমরা হারাই। ওই দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে ছিলেন অভিনেত্রী টিনা খন্দকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম এবং তার সদ্যবিবাহিত স্ত্রী মুনিরা মোরশেদ মুন্নী। নগরবাড়ী ঘাটে এসে ফেরীর জন্য গাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন আলমগীর কবির ও টিনা খন্দকার। তারা দুজন সামনের সিটে ছিলেন। পিছনের সিটে ছিলো মোরশেদ ও মুন্নী। ফেরির সময় হলে মোরশেদ গাড়ি থেকে নেমে যায় ফেরির টিকিট কাটার জন্য। কিছুক্ষনের মধ্যে একটা ট্রাক পিছন থেকে এসে গাড়ীকে ধাক্কা দেয়। চালক আলমগীর কবির কিছু বোঝার আগেই গাড়ীসহ মেঘনার পানিতে ছিটকে পরেন। মোরশেদ লোকজনের চিৎকার শুনে দৌড়ে ঘাটে এসে দেখে এই দৃশ্য। সে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা করলে লোকজন তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। মুন্নী সাঁতার জানতো না, অন্য দুজন জানতেন। কয়েকজন ভালো সাঁতার জানা ব্যক্তি নদীতে নেমে ডুব দিয়ে গাড়ী থেকে তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করেন। এর মাঝে আকস্মিকভাবে মুন্নী পানিতে ভেসে ওঠে। তাকে উদ্ধার করা হয়। ক্রেন দিয়ে গাড়ী ওঠানোর পর আলমগীর কবির ও টিনা খন্দকারের লাশ সিটবেল্টে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া যায়।

মোরশেদের সাথে আমার সম্পর্ক অনেক পুরোনো সেই ১৯৮০ সাল থেকে। সে ঢাকা লিটল থিয়েটার থেকে নাটক করবে সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’। আমার কাছে সহযোগিতা চায়। সময়কাল সম্ভবত ১৯৮২। তখন আমি বিটিভিতে বেশ ব্যস্ত থাকলেও ওই নাটকের সেট ও কস্টিউম ডিজাইন করে দেই। ঢাকা লিটল থিয়েটারের ওই নাটকটি ছিলো একটি অত্যন্ত সফল প্রযোজনা। নাটক পরিচালনা করতে করতে সে চলচ্চিত্র নির্মাণকে পেশা হিসেবে নেওয়ার স্বপ্ন দেখে যখন সে ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগের ছাত্র।

১৯৮৫, বেগম মমতাজ হোসেন তার ধারাবাহিক নাটক ‘সকাল সন্ধ্যা’ শেষ করেছেন। প্রযোজক ছিলেন মোহাম্মদ বরকউল্লাহ্। নাট্যকার বেগম মমতাজ হোসেনকে আগে থেকেই চিনতাম মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনির্মাতা আলমগীর কবিরের বোন হিসেবে। 

একদিন টিভি ভবনে বসে ইমদাদুল হক মিলনের ধারাবাহিক নাটক ‘নায়ক’ এর স্ক্রিপ্ট দেখছিলাম। মামুন ভাই (আবদুল্লাহ আল মামুন) তখন নাটক বিভাগের প্রধান। তাঁর ইচ্ছা আমি ধারাবাহিকটি প্রযোজনা করি। সেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ পরিচালক (অনুষ্ঠান) খালেদা ফাহমী ডেকে পাঠালেন। তাঁর রুমে দেখি বেগম মমতাজ হোসেন বসা। হাতে বিশাল আকারের বাঁধাই করাা স্ক্রিপ্ট। খালেদা আপা পরিচয় করিয়ে দিলেন। মমতাজ আপার মুখে হাসি, যেনো কতোদিনের পরিচয়। মমতাজ আপা প্রথমেই তুমি বলে সম্বোধন করলেন। সকাল সন্ধ্যা’র সফল প্রযোজনার কারনে তিনি তখন খুব জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। সেই সাথে উদয়ন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবেও সুপরিচিত। সব মিলিয়ে খুব ভালো লাগলো মমতাজ আপার সাথে আলাপ করে। খালেদা আপাকে বললাম, ‘আমার হাতে ইমদাদুল হক মিলনের স্ক্রিপ্ট, মামুন ভাই দায়িত্ব দিয়েছেন। আমি এখন কি করবো।’ একদিকে মামুন ভাই অন্যদিকে খালেদা আপা। একদিকে মিলন অন্যদিকে মমতাজ আপা। খালেদা আপা বললেন, ‘যেহেতু শুকতারা একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ধারাবাহিক নাটক, সেহেতু এটি তুমিই প্রযোজনা করবে। নায়ক অন্য কেউ করতে পারবে। আমি মামুনকে বলে দিচ্ছি।’

শুরু হলো শুকতারা নির্মাণ কাজ। মামুন ভাই মনে মনে একটু কষ্ট পেয়েছিলেন হয়তো কিন্তু কাউকে বুঝতে দেননি। তখনো দেশে  কম্পিউটার কম্পোজ শুরু হয়নি। নাট্যকার হাতে লিখে স্ক্রিপ্ট দিতেন। টিভি ভবনে তা কপি করার ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু হাতে লেখা কপির মান ভালো ছিলো না। তাই যেটা করতাম, মমতাজ আপা স্ক্রিপ্ট দেবার পর আমি রাত জেগে তা আবার এডিট করতাম। সিকোয়েন্স অনুযায়ী সাজাতাম। নাটকটিতে আমার বন্ধু খলিলের স্ত্রী বাসন্তি গোমেজের সহযোগিতা ছিলে মনে রাখার মতো। সে তখন ইউএসএইডে চাকরী করতো। মতিঝিলে অফিস। রিহার্সেলে এসে বাসন্তী এক কপি স্ক্রিপ্ট নিয়ে যেতো, পরদিন ২০ টি ফটোকপি সেট করে নিয়ে আসতো। সদরুল পাশাকে একটি প্রধান চরিত্রের জন্য মনোনীত করলাম। সেও দিনরাত খাটতো নাটকটিকে সফল করার জন্য। 

সদরুল পাশার সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৩ থেকে। মমতাজ উদ্দীন আহমেদ এর 'ফলাফল নিম্নচাপ' এ সে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করতো। ওই নাটকের কয়েকটি প্রদর্শনীর জন্য থিয়েটার'৭৩ গ্রুপসহ সে ঢাকা এসেছিলো। চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াকালীন সময়ে সে ভারতের ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট-এর স্কলারশীপ পেয়ে পুনেতে যায় ১৯৭৬ সালে। একই বছর আমিও দিল্লি চলে যাই এনএসডি’তে। সুতরাং ভারতেও আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা ভালোই ছিলো। ১৯৭৯ তে আমাদের লাস্ট সেমিস্টারটা ছিলো পুনের ফিল্ম ইন্সটিউটে। সুতরাং সেখানেও তাকে পেয়ে সময়টা আরো আনন্দে কাটে। 

দিল্লির পড়াশুনা শেষ করে আমি ঢাকা ফিরে এলেও সদরুল পুনে থেকে যথসময়ে ফিরে আসে না। সে বোম্বেতে থেকে যায়, বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্র নির্মাণ করে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করে। মনে আছে ১৯৭৯ এর জুলাই মাসে যখন আমি ঢাকা ফিরে আসছি তখন কলকাতার এসপ্লানেডে হঠাৎ তাকে আবিষ্কার করি কবি দাউদ হায়দারের সাথে। কিছুক্ষণ আড্ডা দেই একসাথে। এরপর আমি আর পাশা যাই নাট্যকার-পরিচালক-অভিনেতা রূদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত'র সাথে দেখা করতে তাঁর ‘নান্দীকার’এর অফিসে। স্বাতিলেখা সেনগুপ্তও ছিলেন সেখানে। পাশা আলাপের মাঝে রূদ্রদার কাছে ছবি বানাবার জন্য একটি স্ক্রিপ্ট চেয়ে বসে। রূদ্রদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। আমি আগ্রহ দেখাই। ‘নান্দীকার’এর ফুটবল নাটকটি সে সময়ে খুব জনপ্রিয়, কিছুদিন আগে দিল্লিতেও শো করে এসেছেন। আমি ফুটবল-এর কথা বললাম। তিনি কোনও সঙ্কোচ না করে নাটকটির একটা স্ক্রিপ্ট আমার হাতে তুলে দেন। পাশা স্ক্রিপ্টটি এতো সহজে পেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। রয়্যালিটির কথা উঠলে রূদ্রদা বললেন বাংলাদেশে ছবিটি নির্মিত হলে তিনি কোনো সম্মানী নেবেন না। 

এরপর বিদায় নিয়ে আমরা ট্রামে করে ফিরে আসি। ট্রাম থেকে নেমে সদরুল ও আমি যখন হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের কাছে চলে এসেছি, তখন তার চিৎকার, ‘হারূন আমিতো ‘ফুটবল’এর স্ক্রিপ্ট ট্রামে ফেলে রেখে এসেছি’। একটা ছোটো ব্যাগে অত্যন্ত যত্ন করে সে স্ক্রিপ্টটি রেখেছিলো। ব্যাগটাই সে নামার সময় নিতে ভুলে গেছে। এরপর ট্রাম অফিসসহ অনেক স্থানে সে স্ক্রিপ্টের জন্য ছোটাছুটি করেছে, স্ক্রিপ্টটি আর পাওয়া যায়নি। লজ্জায় আরেকবার সে রুদ্রদার সাথে দেখা করেনি। পাশারও আর ওই ছবি নির্মাণ করা হয়নি। 

এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। সদরুল বোম্বেতে বিয়ে করেছে আনিস পাশাকে, অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন উচ্চশিক্ষিত মহিলা, যে পাশার জীবনে অনেকটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছিলো। সে সময়ে সদরুল পাশা বোম্বেতে থেকে যাবে বলে মনস্থির করেছিলো। এরপর ১৯৮৩ এর এক সন্ধ্যায় ধানমন্ডি’র বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এ্যন্ড আর্কাইভের অফিসে হঠাৎ দেখি পাশাকে, সে চলে এসেছে বোম্বে থেকে। জানালো সে এখন ঢাকাতেই থাকবে। এখানেই কাজের চেষ্টা করবে। অতপর আমার বিভিন্ন কাজে সে যুক্ত হয়। আমিও তার বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্র নির্মাণে সঙ্গী হই। আমার বেশ কয়েকটি নাটকে অভিনয় করে। ‘সৃষ্টি’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সে। বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনী চলচ্চিত্রে সদরুল পাশা শতভাগ প্রফেসনালিজম যুক্ত করে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। সে সব সময় বলতো কোয়ালিটির কোনো বিকল্প নেই। 

ধারাবাহিক নাটক 'শুকতারা' প্রসঙ্গ উঠলেই আমি অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই নাটকের এক একটি পর্ব কতো প্রতিকুলতার মধ্যে এক বছর ধরে নির্মাণ করেছিলাম। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ ‘শুকতারা’ নাটকটি নিয়ে পত্রিকায় লিখেছেন একাধিকবার। তাঁর একটি লেখা থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। 

“খ ম হারূনের নাম শুনলেই আমার মনে পড়ে তাঁর প্রযোজিত সিরিয়াল নাটক ‘শুকতারা’র কথা। এক যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সিরাজের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সৈয়দ আহসান আলী সিডনি। প্রতি পর্ব ৬০ মিনিটের, ২৬ পর্বে নাটকটি শেষ হয়েছিলো। সিরাজের প্রেমিকার নাম ছিলো হাসিনা, অভিনয় করেছিলেন রওশন আরা হোসেন।”
“মনে আছে, বাংলাদেশের উত্তরের এক জেলা, কুড়িগ্রাম সফরকালে এই নাটকের একটি পর্ব দেখার জন্য এখানে-ওখানে অনেক খোঁজখবর করে এক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের সম্মতিতে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম। কিন্তু হা হতোস্মি, ‘লোডশেডিং’ এর কারনে বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং নাটকের সেই পর্বটি আর দেখা হলো না।”
“আরও একটি স্মৃতি এই প্রসঙ্গে- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইটির প্রধান চরিত্র রুমীর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা পড়ছিলেন ‘শুকতারা’র সিরাজ একটি পর্বে। জাহানারা আপা তখন তাঁর ছোটো ছেলে জামীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পর্বটি তিনি দেখতে পারেননি তখন। কিন্তু আমি তখন ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার- ‘ভিসিআর’এ টিভিতে প্রচার করার সময় প্রতি পর্ব রেকর্ড করতাম। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগের ডাইরেক্টর জেনারেল তখন আমি, আমাদের বিদেশি দূতাবাসগুলোতে নিজ উদ্যোগে এই পর্বগুলো আমাদের ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে পাঠাতাম। আমার কাছে মাস্টার কপি আছে জানিয়েছিলাম জাহানারা আপাকে, তাঁর দেশে ফেরার পর তাঁর বাসা ‘কণিকা’য়। আগ্রহী হলেন তিনি দেখতে এই পর্বটি। শেরেবাংলা নগরে আমার মিনিস্টার্স হোস্টেলের বাসায় এক সন্ধ্যায় এসে এই বিশেষ পর্বটি দেখতে দেখতে তিনি নীরবে কেঁদেছিলেন।”

মহিউদ্দিন আহমেদ যে সময়ের কথা বলছেন, সে সময়ে আমি তাঁকে চিনতাম না। পরিচয় হয় অনেক পরে এক সন্ধ্যায় চৈত্রসংক্রান্তির এক অনুষ্ঠানে প্রজ্ঞা লাবনীর ইন্দিরা রোডের বাসায়। কাজী আরিফ সে সময়ে মহিউদ্দিন আহমেদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। ভদ্রলোক আমার পরিচয় পেয়ে অত্যন্ত আবেগে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি বিস্মিত কি করে আমি এরশাদ আমলে মুক্তিযুদ্ধের উপর এতো বিশাল একটি কাজ করলাম। এরপর তিনি তাঁর একাধিক বক্তব্যে এই ‘শুকতারা’ নিয়ে কথা বলেছেন। এখনো আমার খোঁজ খবর রাখেন। তাঁর কন্যা লন্ডন প্রবাসী অরু মহিউদ্দিন এর সাথেও আমার যোগাযোগ আছে।

শুকতারা নাটকের প্রধান কিছু চরিত্রের কথা স্মরণ না করে পারছি না। সৈয়দ আহসান আলী সিডনি, রওশন আরা হোসেন, সদরুল পাশা, লুবনা আহমেদ, জাহানারা আহমেদ, নিলুফার আহমেদ, ফরিদ আলী, কে এস ফিরোজ, আব্দুল মতিন, ড. ইনামুল হক, সৈয়দ মহিদুল ইসলাম, এস এম মহসিন, ওবায়দুল হক সরকার, সৈয়দ আমির আলী, বাসন্তী গোমেজ, মহসিন মুনীর, শুভ্র দেব, মুনমুন, অপি করিম, আইরিন পারভীন লোপা, কিযী তাহনিন সহ অনেকের অভিনয় এখনো দর্শকদের মনে আছে।

১৫ অক্টোবর ১৯৮৫, শুকতারা নাটকের চতুর্থ পর্ব প্রচারের সময় যে দুর্ঘটনা ঘটে তা প্রতি বছর অত্যন্ত শোকাবহ পরিবেশে পালিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি স্মরণ করছি ‌জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডি'র সেই সব ছাত্রদের যারা এই ধারাবাহিক নাটকটি দেখতে গিয়ে করুণ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। নিহত সেই ৩৯ জন সহ আহত তিনশতাধিক ছাত্রদের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিলো ধারাবাহিকের পরবর্তী পর্বগুলো।  

আসলে আমি নিজেও আজ অবাক হই কি করে ওই প্রতিকুল অবস্থার মাঝে ‘শুকতারা’ ধারাবাহিকটি নির্মাণ করেছিলাম কোনো কম্প্রোমাইজ না করে। সে সময়ে সেনাবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন (নাম উল্লেখ করলাম না) ‘শুকতারা’র প্রতিটি পর্ব প্রচার হবার আগে তা প্রিভিউ করতেন। কোনোদিন তিনি কোনো পর্ব আটকে দেননি। নাটকটি শেষ হবার পর তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে যান। যাবার আগে টিভি ভবনের তিন তলায় একদিন আমাকে চা খেতে আমন্ত্রণ জানান। কথায় কথায় তিনি বলেন, “আপনার নাটকের প্রধান দুটি চরিত্র, একটির নাম সিরাজ, আরেকটি হাসিনা। কেনো এই নামকরণ আমি জানতাম। আমি এও জানতাম ‘শুকতারা’র হাসিনা এই নাটকে যে শাড়ি পরে তা ধানমন্ডি ৩২ নাম্বার থেকে আসে।’ তারপর মৃদু হেসে বলেন ‘হারূন ভাই আপনার সাহসের প্রশংসা করি। তবে আমি না থাকলে ধারাবাহিক নাটকটি আপনি শেষ করতে পারতেন না।’ এখনো সেই তরুন ক্যাপ্টেনের কথাগুলি আমার কানে বাজে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে অন্যত্র চলে যাবার পর ঐ ক্যাপ্টেন ভদ্রলোককে আর আমি কখনো খুঁজে পাইনি। পেলে ভালো লাগতো। 

আরেক দিনের কথা। আমার বন্ধু জাদুশিল্পী জুয়েল আইচ আমাকে ফোন করে বলে, 'হারূন তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। আজ সন্ধ্যায় কাকরাইলে চলে আসো। বিপাশা তোমাকে চাইনিজ খাওয়াতে চায়। হঠাৎ কেনো জিজ্ঞাসা করাতে সে বলে, 'তোমার নাটকের জন্য।' নির্দিষ্ট সময়ে কাকরাইলের সেই রেষ্টুরেন্টে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখি এক টেবিল ঘিরে বসে আছে আমার জন্য জুয়েল আইচ ও বিপাশা। সঙ্গে আরেকজন মহিলা। ভালো করে তাকাতেই উনি আমাকে কাছে টেনে নিয়ে আমার হাতে একগুচ্ছ ফুল তুলে দেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। অনেক গল্প করলেন শুকতারা নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ সহ আমার অন্যান্য কাজ নিয়ে। কথা বলতে বলতে আমাকে পুত্র সম্বোধন করে একসময় কেঁদে ফেলেন। তিনি আর কেউ নন, আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় জাহানরা ইমাম। 

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন:

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৮

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৬

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৫

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৪

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৩

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ২

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১