অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পথ থেকে পাওয়া

‘বিকট’ শহরে একজন সুরের ফেরিওয়ালা…

কাইসার রহমানী, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৪:৪৬ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার   আপডেট: ০৭:৫৫ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ রোববার

ঢাকা শহরের রাস্তা, ছোট আর বড় গাড়িতে ঠাঁসা। যেন একটি আরেকটির উপর উঠে পড়বে। আবার রাস্তায় ছুটন্ত মানুষের শরীর বাঁচাতে রুদ্ধশ্বাসের এঁকেবেঁকে ছুটে চলা। এর মাঝেই, গাড়ির ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে সুরেলা এক শব্দ যেন কানে এসে প্রশান্তি দিয়ে গেলো। চিকন একটা কাঠির মতো কি যেন দেখা গেলো ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে। একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল, শ্যামলা গড়নের এক লোক কাঁধে ব্যাগ আর ঘাড়ে বেহালা ঠেকিয়ে কাঠি দিয়ে সুর তুলে এগিয়ে আসছে। দূষিত বাতাসে তার বেহালার সুর, অল্পক্ষণের জন্য হলেও মুগ্ধ করছে ব্যস্ততায় নাকাল শহরের পথচারীদের। বাহ! ইট-পাথর আর ব্যস্ততার এই শহরেরও আছে একজন রাস্তার বেহালার ফেরিওয়ালা।

ফুলহাতা চেক শার্ট, পুরনো প্যান্ট, রঙচটা জুতা, মাথার গোছানো অল্পচুলের বেহালা ফেরিওয়ালার নাম নূরু মিয়া চিশতী। তাকে নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বলা শুরু করলাম রাজধানীর জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের রাস্তায়। তার কথায় বুঝতে পারলাম, সুর ফেরিকরা মানুষটির ব্যক্তিত্ত্বও সুরেলা। মিষ্টি সুরের মতোই তার ব্যবহার ও কথা। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনের নিরপত্তা দেওয়াল ঘেঁষে বসলাম দুজনে। নূরু চিশতী যত্ন করে তার কাঁধের ব্যাগটি পাশে রাখলেন। পরম মমতায় ব্যাগের মধ্যে রাখা নিজের বানানো বেহালাগুলো ছুঁয়ে দেখলেন। বললেন, এগুলোই আমার জীবন।

আরও পড়ুন: করোনায় কোথাও নেই কল রেডী

জিজ্ঞেস করলাম, এগুলো কি আপনি বানান? তিনি জানালেন, তার নিজের তৈরি বেহালা। বাঁশ, গরুর ঝিল্লি, কাঠ আর একটা তার দিয়ে তিনি বেহালা তৈরি করেন। তার কিনে নিয়ে আসেন সূত্রাপুর থেকে। কথা শেষ করে একটা বেহালা কাঁধে দিয়ে, নিস্প্রাণ একতারে ঢেউ তুললেন তিনি। সুর শুনেই বুঝে নিলাম, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম শত শহীদ স্মরণে’ গানটির সুর তুলছেন তিনি। সুরেলা সুরের তরঙ্গে অদ্ভুত সুন্দর এক অনুভূতি জাগলো মনে। সুরের মূর্ছনায় আশে পাশে অনেক লোক জমে গেছে। কেউ কেউ এসে দামও জিজ্ঞেস করে গেলো হাতে তৈরির বেহালার। 

নূরু চিশতী জানালেন, বেহালা বিক্রি ও বাজানোর পেশায় তিনি এসেছেন তার বাবার হাত ধরে। তার জন্ম ঢাকাতেই, ঢাকা শহরের আদি বাসিন্দা তারা। বাবা বেহালা বিক্রি ও বাজানোর ব্যবসা করতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠান, মেলা, উৎসব-পার্বন, পারিবারিক অনুষ্ঠানেও তার বাবা বেহালা বাজাতেন আর বিক্রি করতেন। বাবার হাত ধরেই নুরু মিয়াও যেতেন বেহালা ফেরী করতে। অবসর সময়ে শিশু নূরু মিয়া বেহালার তারে ঢেউ তুলতেন। এভাবে কখন যেন বাজাতে শিখে ফেলেন তিনি।  

কথার ফাঁকে চা খেলাম দুজনে। নূরু চিশতী তার সুরেলা বেহালার মতোই, যখন কথা বলেন তখন অনেক কথা বলেন, নিশ্চুপ থাকলে, অপলক চোখে কি যেন ভাবেন। জিজ্ঞেস করলম কি ভাবছেন? একটা বড় শ্বাস টেনে বললেন, সারা ঢাকা শহরের অলি-গলিতে সেই ১৯৮০ সাল থেকে বেহালা বাজাচ্ছি। বয়স এখন প্রায় ৬৫। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই বেহালার সঙ্গেই থাকবো। আমার ভালবাসা আমার বেহালাগুলো। বেহালার ফেরিওয়ালাকে বললাম, আপনি যেমন আপনার বাবার কাছ থেকে এই পেশায় এসেছেন, আপনার ছেলে-মেয়ে কি এ পেশায় আসবে? কাঁধে থাকা বেহালার তারে টুংটাং শব্দ করতে করতে তিনি বললেন, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে । কেউই এ পেশায় নেই। তারা পড়াশোনা করে ব্যবসা করে। তাদের যা ভাল লাগবে তারা তাই করবে। তবে তার এক ভাই সালাউদ্দিন। তিনিও এ পেশার সঙ্গে যুক্ত বলে জানালেন নূরু মিয়া চিশতী। 

আরও পড়ুন: কি আছে টিএসসি`র ভাগ্যে

কথা বলার মাঝে মাঝেই কয়েকটা গানের সুর বেহালায় শুনে নিলাম। পরিচিত সব গানেরই সুর তিনি বেহালায় তুলতে পারেন। সুরের মাধুর্য্য এতোটাই সুন্দর, তা যে ১০০ টাকা দামের হাতে তৈরি বেহলা তুলছে তা বোঝা অসম্ভব। নূরু চিশতী জানালেন, তাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগঠকরা নিয়ে যান বাজানোর জন্য। এছাড়া ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেল, ঢাকা ক্লাব, আমেরিকান ক্লাব, উত্তরা-বনানী ও গুলশানের বিভিন্ন ক্লাবের অনুষ্ঠানে তিনি বেহালা বাজিয়েছেন। বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠানেও তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বাজানোর জন্য। এছাড়া কোথাও কোন জাতীয় অনুষ্ঠান, মেলা থাকলে তিনি সেখানে চলে যান বেহালা বিক্রির জন্য। 

বেহালা বিক্রি করে কেমন উপার্জন হয় এই প্রশ্ন করতেই, নূরু চিশতী বেহালায় সুর তুললেন, শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের আমার সারা দেহ খেয়োগো মাটি। তার অসাধারণ সুর হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো সড়কের পথচারীদের টেনে নিয়ে আসলো আমাদের কাছে। বাজানো শেষ করে মিষ্টি হাসি দিয়ে নুরু চিশতী আমার কাছে জানতে চাইলেন, এই যে মিষ্টি সুর শুনে আপনার ভাল লাগলো, এই ভাললাগা কোটি টাকা দিয়ে কিনতে পারবেন? বললাম, না পারবোনা। তিনি বললেন, বেহালা বিক্রি করে আর বাজিয়ে খুব বেশি উপার্জন হয়না। তবে, কোনমতে সংসার চলে যায়। কিন্তু এই পেশার কারণে মানুষ তাকে যে সম্মান দিয়েছে, তার মূল্য অনেক, এটা অনেক টাকা দিয়েও এই সম্মান কেনা যাবেনা। তাই উপর্জন কম হলেও, তিনি তার ভালবাসার এই পেশাতেই ছিলেন, থাকবেন। নূরু চিশতী জানালেন, আগে তার বেহালা অনেক বিক্রি হতো, পুরনো আমলের মানুষদের মধ্যে আনন্দ ছিল, শেখার উৎসাহ ছিল। কিন্তু এসময়ে আগের মতো বিক্রি হয়না। ছেলে-মেয়েদের আগ্রহ কম তার হাতে তৈরি বেহালার প্রতি। আর করোনার কারণে, এখন একদম ব্যবসা হয়না বললে চলে।  

বড়দিনের অনুষ্ঠানে ফার্মগেট গীর্জায় বেহালা বিক্রি করতে যাবেন নূরু চিশতী। সময় হয়ে গেছে সেখানে যাওয়ার। পাশে রাখা বেহালা ভর্তি ব্যাগ কাঁধে তুলে বিদায় চাইলেন। একটা বেহালা কাঁধে তুলে, কাঠি দিয়ে সুর তুলে হালকা বাঁকা হয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগলেন নূরু মিয়া চিশতী। ফার্মগেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি আর আর তার বেহালার সুর পেছনের তরঙ্গে ভাসছে। ফেলে যাওয়া মিষ্টি সুরে প্রশান্তি আসছে ব্যস্ত পথচারীদের। 

শেষ বিন্দুতে মিলিয়ে গেলো শহরের বেহালার ফেরিওয়ালা, কিন্তু তার সুর থেকে গেলো অন্তরে।

ভিডিও স্টোরি দেখুন: