অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বদিকে শেষ পর্যন্ত ভালোবেসে গেছে দেশের মানুষ!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০১:২৭ পিএম, ২৬ ডিসেম্বর ২০২০ শনিবার   আপডেট: ০৯:৪৯ পিএম, ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ রোববার

কোথাও কেউ নেই নাটকের বদি, বাকের ভাই ও মজনু

কোথাও কেউ নেই নাটকের বদি, বাকের ভাই ও মজনু

"আবার মাথা নাড়ছেন? শব্দ করে সবাইকে শুনিয়ে বলুন, বাকের কি খুন করেছেন?" কোর্টরুমে আইনজীবী কড়া ধমক লাগালেন বদিকে। বদি অনেক কষ্টে মাথাটি থামিয়ে উচ্চারণ করলো একটি শব্দ, 'জ্বি'। ব্যস মুহুর্তেই নাটকের মোড় ঘুরে গেল। রাজসাক্ষী বদির জবানবন্দিতে ফাঁসি হলো বাকের ভাইয়ের।

কার না মনে আছে সেই দৃশ্য। অতি বড় পারঙ্গমতায় নাট্যকার সেদিন স্পষ্ট করতে পেরেছিলেন, এত্তবড় ভুলকাজটি বদি ইচ্ছা করে করেননি। ছিলো অন্য কারণ। আর ততোধিক পারদর্শীতায় বদি চরিত্রে সেদিন কষ্ট ও ঘৃণাবোধের সকল প্রকাশ মুখে মেখে, নিজেকে 'গাদ্দারের' ভূমিকায় তুলে ধরেছিলেন গোটা দেশের কোটি কোটি চোখের সামনে।

পড়ুন: ২০২০: বিনোদনে যতো শূন্যতা

হ্যাঁ বাকের ভাইয়ের ফাঁসির বিরুদ্ধে তখন রাজপথে নেমেছিল মানুষ। কিন্তু বদিকে কি তারা ঘৃণা করতো? উত্তর হলো 'না'। এদেশের দর্শক মনে বদি অর্থাৎ আব্দুল কাদেরের জায়গা হলো আরও পাকাপোক্ত, শক্ত। তার অসামান্য সাবলীল অভিনয় দক্ষতায় অগুনিত ভক্তের মনের মনি কোঠরে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সে ভাবমূর্তি এমনই ছিলো বদি ভুল করলেও আবদুল কাদের কোনো ভুল কাজ করতে পারে না। ডাকঘরের সেই অমল চরিত্র দিয়ে সেই যে শুরু তার পর হাজার দুয়েক নাটকে তাকে মানুষ সেভাবেই চিনেছে।

পড়ুন: শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী: সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আবদুল কাদের মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন

‘কোথাও কেউ নেই’ ধারাবাহিক নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। লিখেছেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। ধারাবাহিকটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন ‘বাকের ভাই’। পাড়ার গুন্ডা বাকের ভাইয়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন ‘বদি’ আর ‘মজনু’। নাটকে বদি চরিত্রে অভিনয় করে অসামান্য জনপ্রিয়তা পান অভিনেতা আবদুল কাদের। বদি ছাড়া বাকেরকে ভাবা যেত না যায়ও না! এক চক্রান্তে তিনজনেই ফেঁসে গেল খুনের মামলায়। 

নাটক জুড়ে পর্বে পর্বে বদির মুখের সংলাপ, 'তেড়িবেড়ি করলে ভুঁড়ি গালাইয়া দিমু' দর্শক মনে ভয় কখনোই ধরিয়ে দিতে পারেনি। বরং কৌতুকময়তায় আচ্ছন্ন করেছে। কারণ নাট্যকার সেটাই চেয়েছিলেন। আর বদি চরিত্রে আবদুল কাদেরও সেটাই তুলে ধরতে পেরেছেন। 

সেদিনে নাটকে মজনু আর বদীকে একা করে চলে গিয়েছিলেন বাকের ভাই। আর আজ জীবনের দৃশ্যপটে দুই সঙ্গীকে ফেলে চিরস্থায়ী গন্তব্যে পাড়ি দিয়েছেন বাকেরের প্রিয় বদি।

জনপ্রিয় এই অভিনেতা ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে যখন ভারতের চেন্নাইয়ের একটি হাসপাতালে ক্যানসারের সঙ্গে লড়ছিলেন, খবর পেয়েই তাকে ফোন করেছিলেন বাকের ভাই চরিত্রের আসাদুজ্জামান নূর। সে সময় অনেকটাই ছিলেন নিদ্রাচ্ছন্ন বদি। তার সেই নীরবতা ভাঙে বাকের ভাইয়ের ভিডিও কলে।

ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন. সেদিনের সেই একটা ফোনেই অনেকটাই সেরে উঠেছিলেন বাংলা নাটকের এই রত্নপুরুষ।

পড়ুন: জনপ্রিয় নাট্যাভিনেতা আবদুল কাদের আর নেই

আবদুল কাদের ছিলেন নাটক, বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র—তিন মাধ্যমেই জনপ্রিয়। তিনি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’ নাটকে অমল চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার প্রথম নাটকে অভিনয়। টেলিভিশনে আব্দুল কাদের অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এসো গল্পের দেশে’। ১৯৭২ সাল থেকে টেলিভিশন ও ১৯৭৩ সাল থেকে রেডিও নাটকে অভিনয় শুরু হয় তার।

টেলিভিশনে দুই শতাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন কাদের। তার উল্লেখযোগ্য নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘মাটির কোলে’, ‘নক্ষত্রের রাত’, ‘শীর্ষবিন্দু’, ‘সবুজ সাথী’, ‘তিন টেক্কা’, ‘যুবরাজ’, ‘আগুন লাগা সন্ধ্যা’, ‘প্যাকেজ সংবাদ’, ‘সবুজ ছায়া’, ‘কুসুম কুসুম ভালোবাসা’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘আমাদের ছোট নদী’, ‘দুলাভাই’, ‘অজ্ঞান পার্টি’, ‘মোবারকের ঈদ’, ‘বহুরূপী’, ‘এই মেকআপ’, ‘ঢুলি বাড়ি’, ‘সাত গোয়েন্দা’, ‘এক জনমে’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘খান বাহাদুরের তিন ছেলে’ ইত্যাদি। 

বদির পরে একাধিক নাটকে আবদুল কাদেরকে হুমায়ূন আহমেদ ‘দুলাভাই’ চরিত্রে নিয়ে আসেন। টিভি নাটকে অনেকটা ‘কমন দুলাভাই’-এ পরিণত হন কাদের। করেছিলেন আমজাদ হোসেন, আবদুল্লাহ আল মামুন,ইমদাদুল হক মিলনসহ নামি লেখক ও নির্মাতাদের নাটকও।

থিয়েটারের প্রায় ৩০টি প্রযোজনার এক হাজারের বেশি প্রদর্শনীতে অভিনয় করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, এখনও ক্রীতদাস, তোমরাই, স্পর্ধা, দুই বোন ও মেরাজ ফকিরের মা। 

অভিনেতা আবদুল কাদেরের জন্ম ১৯৫১ সালে মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতা দিয়ে। অর্থনীতিতে সিঙ্গাইর কলেজ ও লৌহজং কলেজে শিক্ষকতা করেছিলেন। বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থায় এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকরির পর ১৯৭৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক কোম্পানি ‘বাটা’তে চাকরি করেন। সেখানে ছিলেন ৩৫ বছর। 

১৯৭২-৭৪, পরপর তিন বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মহসিন হল ছাত্র সংসদের নাট্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭২ সালে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন মহসিন হলের নাটক সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্দেশিত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’-এ অভিনেতা হিসেবে পুরস্কার পেয়েছিলেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ জ্ঞানের অনুষ্ঠান ‘বলুন দেখি’-তে চ্যাম্পিয়ন দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে পুরস্কার পাওয়া আবদুল কাদের ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ডাকসু নাট্যচক্রের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। 

আবদুল কাদের বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাট্যশিল্পী ও নাট্যকারদের একমাত্র সংগঠন টেলিভিশন নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদের (টেনাশিনাস) সহসভাপতিও ছিলেন।