অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১২

প্রকাশিত: ১১:২০ এএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০১:০৬ এএম, ৪ জানুয়ারি ২০২১ সোমবার

শঙ্কিত পদযাত্রা

ধারাবাহিক আত্মকথা

। খ ম হারূন ।

খ্যাতিমান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব খ ম হারূন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে সম্পৃক্ত রয়েছেন দেশের টেলিভিশন এবং মঞ্চের সাথে। বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বর্ণময় সময়ে যে কয়েকজন নির্মাতা-প্রযোজকের নাম ছোট পর্দার কল্যাণে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে খ ম হারূন তাদের একজন। দীর্ঘ বর্ণিল ক্যারিয়ারে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তিনি। এখনো রয়েছেন সমান সক্রিয়। দেশের গণমাধ্যম জগতের বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের আত্মকথা ‘শংকিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হচ্ছে অপরাজেয় বাংলা’য়।

 

[পর্ব-১২]

 

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধ পরবর্তি অবস্থা দেখতে ঢাকা আসেন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সঙ্গে তার স্ত্রী জোআন বেনেট কেনেডি ও ভাই রবার্ট কেনেডির ছেলে জোসেফ প্যাট্রিক কেনেডি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের বিজয় অভিনন্দন জানাতে তিনি ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ এর ১৪ তারিখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছান। সেখানে তাকে স্বাগত জানান সে সময়ের ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব, সাধারন সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার কয়েক ছাত্র।

 

বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের সামনে যে বিশাল বটগাছটি ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেটা সমূলে উপড়ে ফেলেছিলো। তাদের আক্রোশ ছিলো বটগাছটির প্রতি, কারন এখান থেকেই গর্জে উঠতো পাকিস্তান বিরোধী স্লোগান। সকল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিলো বটতলা। বাংলাদেশের প্রথম পতাকা ওঠানোর সময় ছাত্ররা এই বটতলাতেই এসে সমাবেত হয়েছিলো। সিনেটর কেনেডি নিজ হাতে পুরোনো বটগাছটির জায়গায় নতুন একটি বটগাছের চারা লাগান, তারপর ছাত্র সমাবেশে ভাষন দেন। মুক্তিযুদ্ধে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির অকুন্ঠ সমর্থন ছিলো আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বাংলাদেশ বিরোধী কর্মকান্ডের জন্য তখন মার্কিন বিরোধী মনোভাব ছিলো সকল মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-ছাত্রীদের মনে। 

সিনেটর কেনেডি চলে যাবার পর সে সময়ে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি নূরুল ইসলাম নাহিদ, সাধারন সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ছাত্রনেতা মাহবুব জামান এর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র সিনেটর কেনেডির লাগানো সেই বটগাছের চারাটি তুলে ফেলে সেখানে নতুন আরেকটি চারা লাগান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সামনে আজকের যে বিশাল বটগাছ সেটি সেদিনের সেই স্মৃতি বহন করে চলেছে। আজ আমি গৌরব বোধ করছি যে সেদিন সে স্থানে আমারও উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিলো।

১৯৭২, মে মাসের ২০ তারিখ। দেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসু সহ সবগুলো হলেই বিজয় লাভ করে শুধুমাত্র সূর্য সেন হল বাদে। সদ্যবিভক্ত ছাত্রলীগের আফতাব-আজাদ-হুমায়ূন প্যানেল সূর্য সেন হলে সবকটি আসনে জয়ী হয়। ডাকসু'র ভিপি নির্বাচিত হন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস মাহবুব জামান। 

৪ নভেম্বর ১৯৭৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বটতলাতে আমরা আবার সমবেত হলাম। বটগাছটি ততোদিনে বেশ বড় হয়ে গেছে। বটগাছটির উল্টো দিকে তখন ডাকসু'র তত্ত্বাবধানে 'অপরাজেয় বাংলা' ভাস্কর্যটি নির্মাণের কাজ চলছে। আমরা শঙ্কিত ছিলাম ১৫ আগস্টের পর এই বটগাছটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যৌথভাবে জাতীয় ছাত্রলীগের ব্যানারে তখন কাজ করে, কখনো প্রকাশ্যে কখনো গোপনে। বিভিন্ন হল থেকে কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রী বুকে পাহাড় সমান সাহস নিয়ে বটতলায় হাজির হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানানোর জন্য। এটিই ছিলো প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ। এর আগে ১৭ অক্টোবর রাতে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলা ভবনের দেয়ালে কাজী আকরাম হুসেন এর নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কয়েকটি স্লোগান অঙ্কিত করেছিলাম। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে, রক্তিম অক্ষরে লেখা এই স্লোগানগুলির কথা নিশ্চয়ই এখনো অনেকের মনে আছে। যা ছিলো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং দেয়াল লিখনের মাধ্যমে জোরালো এক প্রতিবাদ। 

ফিরে আসি ৪ নভেম্বরের বটতলায়। সূর্য সেন হল থেকে কাজী আকরাম হুসেন, সিরাজুল ইসলাম, আফগানী, জাহিদুল বারী সহ আমরা অনেকেই সেখানে জড়ো হলাম। ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও ডাকসুর সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এর নেতৃত্বে একটি সফল প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে আমরা যাই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর পর্যন্ত। ডাকসুর সাধারন সম্পাদক মাহবুব জামান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নুহ আলম লেনিন, অজয় দাশগুপ্ত, ম হামিদ, মৃনাল সরকার, কামরুল আহসান খান, কাজী রোকেয়া সুলতানা রাকা, নিনু নাজমুন আরা, নাজনিন সুলতানা নুনা, শওকত হোসেন জুলিয়াস, এসএএম শওকত হোসেন, নুরুল ইসলাম সহ ছাত্র ইউনিয়নের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ মিছিলে জড়ো হন। অন্যদিকে ইসমত কাদির গামার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ওবায়দুল কাদের (বর্তমানে মন্ত্রী), রবিউল আলম চৌধুরী, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, কেএম জাহাঙ্গীর, বাহালুল মজনুন চুন্নু, চন্দন চৌধুরীর নাম মনে আছে যারা আমাদের সাথে ছিলেন। মিছিল যখন নিউ মার্কেট পার হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সেখানে ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ থেকে আরো অনেক ছাত্র-ছাত্রী এসে যোগ দেয়। পুলিশি বাঁধা অতিক্রম করে যখন আমরা ৩২ নম্বরে পৌঁছাতে সক্ষম হই, ধানমন্ডি লেকের পাড়ে তখন এক আবেগময় দৃশ্যের সূচনা হয়। অনেকর চোখ তখন ভেঁজা, মেয়েদের চাঁপাকন্ঠে কান্নার শব্দ, কেউ কেউ বত্রিশ নম্বরের দেয়ালে মাথা ঠুকছেন, জনৈক আর্ট কলেজ ছাত্র দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকার চেষ্টা করছেন, এর মাঝে মাহবুব জামান কলাবাগান খেলার মাঠে মিছিল নিয়ে সকলকে আসতে বলেন। আমরা সেখানে এসে জড়ো হই। সেলিম ভাই বিশেষ ঘোষনা দেবেন। আমরা উদগ্রীব হয়ে আছি।

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তখন হাত উঁচু করে সবাইকে আরেকটি শোক সংবাদ শোনার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তিনি বলেন ‘এইমাত্র সংবাদ এসেছে, খন্দকার মুসতাকের নির্দেশে গভীর রাতে জেল খানায় জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হয়েছে।’ আঘাতের পর আঘাত। সমাবেশে তখন হাহাকার আর নিস্তবদ্ধতা। সেলিম ভাই এই শোকের পাহাড় অতিক্রম করার ডাক দিয়ে বলেন, আগামীকাল ৫ নভেম্বর সারাদেশে প্রতিবাদ ও সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালিত হবে।’ সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের বিশেষ অধিবেশন ছিলো বিকেলে। সিদ্ধান্ত অনুসারে সিনেট সদস্য ছাত্র প্রতিনিধি মাহবুব জামান, ইসমত কাদীর গামা ও অজয় দাশগুপ্ত সেদিন সিনেট অধিবেশনে উপস্থিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের উপর শোকপ্রস্তাব উপস্থাপন করেন। যা ছিলো আরেকটি কঠিন প্রতিবাদ।

১৯৯৬, আওয়ামি লীগ সরকার গঠনের পর জেল হত্যা দিবস উপলক্ষে আমি একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেই। পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে আমি একদিন তাজউদ্দিন কন্যা সিমিন হোসেন রিমি'র (বর্তমানে সংসদ সদস্য) সাথে কথা বলার জন্য তাঁদের সাত মসজিদ রোডের বাসভবনে যাই। তিনি যথেষ্ট আন্তরিকতার সাথে আমাকে নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করেন। তাজউদ্দিনের মতো এতো সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক একজন রাজনীতিবিদ উপমহাদেশে সত্যিই বিরল। যার কথা মনে করলেই মনে হয় একাত্তরে তাঁর দৃঢ় ও সাহসী নেতৃত্বের কথা। একটি নতুন দেশ সৃষ্টির জন্য তার আত্মত্যাগের কথা। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর যে দূরত্ব তৈরী করা হয়েছিলো তার পেছনে পঁচাত্তরের ঘাতকদের ভূমিকা ছিলো বলে সিমিন হোসেন রিমি সহ অনেকেই মনে করেন।

অক্টোবর ১৯৯৬, সেদিন আমার জন্মদিন ছিলো। একটি প্রামান্য অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য এসেছি ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে। বিভিন্ন এলাকার দৃশ্য ধারন করে চলেছি। বঙ্গবন্ধু যে সেলে থাকতেন সেটি দেখি। অনেক বছর তিনি কারাগারের একটি ছোটো ভবনে ছিলেন। মুগ্ধ হয়ে দেখি বেশ কিছু সুন্দর ফল ও ফুলের গাছ যা বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে লাগিয়েছিলেন। তিনি বাগানচর্চা করতে পছন্দ করতেন। মওলানা ভাসানী, কমরেড মনি সিংহ সহ বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের স্মৃতিচিহ্ন সহ অনেক ঐতিহাসিক স্থান দেখি। জেল সুপার মোশাররফ হোসেন সে সব ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনা করেন। দেখি বৃটিশ আমলে নির্মিত সেই ফাঁসির মঞ্চ যেখানে একরাতে শত সৈনিকের ফাঁসিও কার্যকর করা হয়েছে এই বাংলাদেশে। একজন আইজি প্রিজন তাঁর নিজ সন্তানের (ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের জন্য অভিযুক্ত) ফাঁসিও এখানে কার্যকর হতে দেখেছেন নিজের উপস্থিতিতে। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিলো সেদিন যেখানে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছিলো জাতীয় চার নেতাকে ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর রাতে। যাদের হত্যায় নেতৃত্ব দিয়েছিলো ক্যাপ্টেন মাজেদ, রিসালদার মেসলেহউদ্দিন। যে সেলে এনে তাঁদেরকে হত্যা করা হয় সেই সেলে তখনো আছে অনেকগুলো বুলেটের চিহ্ন। কি নির্মমভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিলো তা শুনছিলাম প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। আবেদ খান গ্রহণ করছিলেন সে সব মর্মস্পর্শী সাক্ষাৎকার আর সেসব দৃশ্য ধারন করছিলো কাওসার চৌধুরী। সঙ্গে সহ-উপস্থাপক জয়া আহসান, অনুষ্ঠান সহযোগী সুপন রায় ও ফাইজুল ইসলাম। 

সেদিন সেই সব ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেখতে দেখতে কখন যে গোধূলি লগ্ন পার হয়ে গেছে টেরও পাইনি। 

চলবে...

 

আগের পর্ব পড়ুন:

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১১

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ১০

ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৯