অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

নাট্যপ্রযোজনা ‘ঊরুভঙ্গম’: ক্ল্যাসিক্যাল নাট্যভাষায় যুদ্ধবিরোধী মঞ্চবয়ান

ড. ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ০৯:৫৫ পিএম, ১১ মার্চ ২০২৪ সোমবার   আপডেট: ১১:০৮ পিএম, ১১ মার্চ ২০২৪ সোমবার

বেইলী রোডের ঐতিহ্যবাহী মহিলা সমিতি মঞ্চ বা সেগুনবাগিচার জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চ নয়, এবার রাজধানী বসুন্ধরায় অবস্থিত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মিলনায়তন সজ্জিত হলো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাব ১৯তম প্রযোজনা হিসেবে মহাভারতের কাহিনি অবলম্বনে মহাকবি ভাস রচিত ‘ঊরুভঙ্গম’ নাটকটি মঞ্চে এনেছে। ক্ল্যাসিক্যাল এই নাটকটিকে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটের সাথে সমসাময়িক করে মঞ্চরূপ দিয়েছেন নির্দেশক আতিকুল ইসলাম জয়। প্রথম প্রদর্শনী হয় ৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার সন্ধ্যায়। 
সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এসেছে চারদিকে। ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের বিপরীতে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তন অসংখ্য থিয়েটারপ্রেমী দর্শকবিভায় আলোকিত! কানায় কানায় পূর্ণ মিলনায়তন। ভারতীয় আল্পনা ও কাঠখোদাই করা নকশাশিল্পের মটিফের সমন্বয়ে প্রোসেনিয়াম আর্চ ও পশ্চাদপট সজ্জিত হয়েছে সাজেসটিভ ধ্রুপদী সৌন্দর্যকে ধারণ করে। সন্ধ্যা ৬.৫৫ মিনিটে উচ্চস্বরে বেজে উঠল যুদ্ধভূমির পবিত্র শঙ্খধ্বনি। সংস্কৃত নাট্যপরিবেশনা কৌশল অবলম্বনে নৃত্যগীতবাদ্য সহযোগে অসাধারণ কোরিওগ্রাফি সহযোগে নাট্যবন্দনা দিয়ে শুরু হয় ‘ঊরুভঙ্গম’ নাট্যাখ্যান। 

মহাকবি ভাসের লেখা বিখ্যাত একাঙ্ক নাটক ‘ঊরুভঙ্গম’। কালিদাস-পূর্ববর্তী যুগের নাট‍্যকার ভাস। ‘ঊরুভঙ্গম’ নাটকটিতে ভাস তুলে ধরেছিন হিংসা ও লোভে আবৃত দুর্যোধনের স্বরূপ। দুর্যোধন ছল ও মিথ্যার দ্বারা পঞ্চপাণ্ডবদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে এবং তাদের অর্ধাঙ্গিনী দ্রৌপদীকে চরম লাঞ্ছনা ও অপমান করে যা পরে মহাযুদ্ধে রূপ নেয়। সর্বকালের অন্যতম ভয়াবহতম যুদ্ধ হিসেবে সবসময় বিবেচিত হয় মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অধর্মকে ধ্বংস করে ধর্মরক্ষার পাঠ দেওয়া হয়। আঠার দিন ধরে চলা এই যুদ্ধের শেষ দিনে দুর্যোধন ও ভীমের মধ্যে গদাযুদ্ধ হয়। দ্বৈপায়ন হ্রদের পাশে ভীম ও দুর্যোধনের গদাযুদ্ধে দুর্যোধনের ঊরু ভেঙে দিয়েছিল মধ্যপাণ্ডব ভীম। পরাজিত ও সর্বহারা দুর্যোধন মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে এসে নিজের সব মোহ, অহংকার ও অন্যায় উপলব্ধি করেন এবং জাগতিক পাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন। কৌরবদের শোচনীয় পরাজয়ের সেই অধ্যায়টিকে নিয়েই প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় লেখা হয়েছিল ‘ঊরুভঙ্গম’ নাটকটি। নিরপেক্ষ সঞ্জয় বা বিজয়ী পাণ্ডব নয়, কুরুপতি দুর্যোধনের চোখ দিয়ে বর্ণিত হয়েছে এই নাটকের কাহিনি। 


দীর্ঘ পাণ্ডুলিপি থেকে সময় উপযোগী করে পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করা হয়েছে। পাণ্ডুলিপি সম্পাদনায় ছিলেন সৈয়দা ইফাত আরা, এ. বি. এইচ.  স্বপ্ন. রিফা তামান্না, উম্মে হাবিবা খান, জয়জিৎ সাহা; সহযোগী নির্দেশক, মঞ্চ ও পোশাক পরিকল্পনা করেছেন সৈয়দা ইফাত আরা; সহকারী নির্দেশক কামরান আনান্দ; আলোক পরিকল্পনা আতিকুল ইসলাম জয়; সংগীত পরিকল্পনা করেছেন মেহফুজ আল ফাহাদ; সংগীত সহযোগী কুমার প্রতিবিশ্ব, সোহেনী মজুমদার, আদিবা আনজুম আলমগীর; সংগীত সমন্বয়কারী সাবিবা রহমান ফরায়েজি; কোরিওগ্রাফি করেছেন জুয়েরিয়া মৌলি, প্রপস পরিকল্পনা কামরান আনান্দ; মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন- মোহতাসিম আন নাফি, সারতাজ ইৎমাম চৌধুরী, আজিজুল হক হিমেল, রাহাত জামান, রাহাত বিন বারি রুদ্র, সোহেল রানা রনি, নাফিম নাজি, আসিফ আলম, আব্দুর রহমান সাকিব, ফারিহা আহমেদ মিম, কেশব দাশ, ফাইরোজ আনিকা মিতু, রিফাহ্ তামান্না, আব্দুল্লাহ আল হাসান, মুহতাসিম হোসেন রুহান, মেহেদী হাসান বাপ্পী, সামিয়া জাহান সিন্থিয়া, রাইসা হাসিন চৌধুরী, নিন্দিনী দেব দিয়া, জয়জিৎ সাহা, ইসরাত জাহান এশা, মাসকুরা নাহার চৌধুরী, সুমাইয়া জান্নাত ঐশী, মাহির শাহরিয়ার পূণ্য, ইসতেহারুল মান্নান ইরফাত প্রমুখ। প্রযোজনার শিক্ষক উপদেষ্টা প্রিয়াংকা নাথ। প্রযোজনার অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ‘ঊরুভঙ্গম’ এর মতো জটিল ও বড় ক্যানভাসের নাটকটির সফল মঞ্চায়ন সম্ভব হয়েছে। সাধুবাদ জানাই নির্দেশক আতিকুল ইসলাম জয়কে। অসাধারণ একটি ক্ল্যাসিক নাট্যপ্রযোজনায় মাধ্যমে নাট্যশিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্য। সাধুবাদ জানাই নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সিনে অ্যান্ড ড্রামা ক্লাবকে।

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা বিশ্ববাসী হতবাক হয়েছে। আধূনিক বিশ্ব কোনোভাবেই যুদ্ধ দেখতে চায় না। যুদ্ধ মৃত্যু ও দুঃখ নিয়ে আসে। ঘরহীন আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন করে এক অবর্ণনীয় অস্বাভাবিক জীবনে নিয়ে যায় মানুষকে। পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ শান্তিকামী। তারা যুদ্ধের ভয়াবতার বিরুদ্ধে। মৃত্যু এক অমোঘ সত্য, জন্ম নেয়া সব প্রাণিকূলকেই সেই অমোঘ সত্যের মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু তা হোক জীবন ও প্রকৃতির স্বাভাবিক চলনে, যুদ্ধের নির্মমতা ও নৃশংসতায় নয়। নাট্যনির্দেশক আতিকুল ইসলাম বিশ্ববাজার ও শান্তি বিনষ্টকারী চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে মঞ্চভাষায় প্রতিবাদ করছেন ভাস রচিত ‘ঊরুভঙ্গম’ নাটকটি বর্তমান সময়ে মঞ্চায়নের মাধ্যমে।

ড. ইসলাম শফিক: শিক্ষক, নির্মাতা ও গবেষক।