অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘সৃজিলা’র ‘নিউজ কেমিস্ট্রি’ বনাম বাংলার ‘ফেসবুক ফিজিক্স’!

রাজীব নন্দী, শিক্ষক ও গবেষক

প্রকাশিত: ০৯:৩৮ পিএম, ৭ ডিসেম্বর ২০২০ সোমবার   আপডেট: ০৭:৪৮ পিএম, ৮ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার

পৃথিবীর সব পদার্থের একটি গুণগত ও পরিমানগত পরিবর্তন ঘটে। যাকে বলে বস্তুর রূপান্তর। তেমনি সংবাদেরও রূপান্তর ঘটে তার ভিন্ন-ভিন্ন উপাদানের কারণে, সেটিই সংবাদ রসায়ন। ‘সংবাদ রসায়ন’ বা ’নিউজ কেমেস্ট্রি’ সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। আমার আজকের আলোচনার প্রসঙ্গঃ সাংবাদিকতার বিদ্যায়তনিক পরিসর থেকে সৃজিলা’র (সৃজিত+মিথিলা) সম্পর্ক সমীকরণ এবং বাঙালির ফেসবুক ট্রোলের মাত্রার সন্ধান করা।

‘কালপেঁচার নকশা’ বইয়ে উপন্যাসিক লেখক বিনয় ঘোষ লিখেছেন- ‘প্রেম নিয়ে যুগে যুগে কত কবি কত কাব্য ও সাহিত্য রচনা করেছেন। কিন্তু কবির কাছে প্রেমের মূল্য যাই থাকুক, খবরের কাগজের সাংবাদিকদের কাছে তার কোন মূল্য নেই। একমাত্র কোন রাজপুত্র যদি প্রেমের জন্য সিংহাসন ছেড়ে চলে যান, যেমন অষ্টম এডওয়ার্ড গিয়েছিলেন, তাহলেই সেটা খবরের কাগজের উল্লেখযোগ্য প্রেম হয়। এছাড়া অন্যকোন প্রেমেরই নিউজ ভ্যালু নেই। আমার আপনার প্রেম, তা যতই গভীর ও চণ্ডীদাসতুল্য হোক না কেন, সাংবাদিকদের কাছে তা চিরাচারিত, সুতরাং নিউজ হিসেবে তা বোগাস। যে কোন প্রেমের সাহিত্যিক মূল্য আছে, কিন্তু সংবাদমূল্য নেই। প্রেমটা যতক্ষণ না আজগুবি ঘটনায় পরিণত হয়, ততক্ষণ তার কোন সাংবাদিক মূল্য থাকে না।’ 

বিশ্লেষণের খাতিরে একটু পেছনের কাহিনী টেনে আনা। মিথিলা এবং তাহসান’র ‘সুখি দাম্পত্য’র গল্প আমাদের প্রজন্মের জন্য আশা-জাগানিয়া খবর ছিলো। দু’জনের সুন্দর আর গোছানো পরিপাটি ছবি ও গল্পগুলো দেখে ভাবতাম- ইশ, কত্ত স্মার্ট ওরা। ওদের সংসারের পরিপাটি গল্প পড়ে ‘আমরা’ অনেকেই আদর্শ দম্পত্তি হতে চাইতাম। কারণ, মিডিয়া খবরগুলো সেভাবেই প্রচার করতো। আমি আমার অনেক বান্ধবীকে দেখেছি, তাহসানের ‘কঠিন ফ্যান’। ভাবছি, মিথিলা-তাহসানকে ‘আদর্শ’ হিসেবে খাড়া করলো কারা? এই যে ওনারা ‘আদর্শ সুখী দম্পতি’, সেটা কে নির্মাণ করেছে?

বিনীত উত্তর: মিডিয়া! তাই, মিথিলার সংসার ভাঙ্গার খবরও অবধারিত মিডিয়ার আইটেম। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে, বিরক্ত হওয়ারও কিছু নেই। কারণ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই দিনে কলকাতার সিনেমা পরিচালক সৃজিত মুখার্জির সাথে মিথিলার বিয়ের ঘটনাটি চারটি মোক্ষম উপাদানের সংমিশ্রণ ছিলো। চারটি পৃথক উপাদানের রাসায়নিক বিক্রিয়াই ‘সৃজিত-মিথিলা’কে জাতীয় সংবাদে পরিণত করেছিলো। যেমন: গুরুত্ব (মিথিলার আদর্শ দাম্পত্য জীবন)+ প্রসিদ্ধি (সৃজিত মুখার্জি টালিউডের পরিচালক) + নৈকট্য (যৌনতা বা ব্যক্তিগত নির্জনতার ছবি ফাঁস)+ )+ খ্যাতি (ঘটনার শিকার সবাই নিজেরা তারকা)= সংবাদ! 

এইভাবে সংবাদের একটি উপাদানের সাথে অপরটির মিলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ‘সংবাদ-রসায়ন’। লেখার শুরুতেই আমি রসায়ন বিদ্যার দোহাই দিয়ে বলেছি, রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পদার্থের বিক্রিয়া। সাংবাদিকতায়ও এই ধরণের রসায়নের বিক্রিয়া দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, আলী আর রাজী ‘সংবাদ-রসায়ন’ (‘সাংবাদিকতা- প্রথম পাঠ’ গ্রন্থের ১৭৩ পৃষ্ঠায়) আলোচনায় বলছেন, ‘রসায়নের এই প্রক্রিয়ায় অনুরূপ ঘটনা ঘটে যখন সংবাদের একটি উপাদানের সাথে আরেকটি উপাদান সংযুক্ত হয়।... অধিকাংশ সংবাদই তৈরি হয় একাধিক সংবাদ উপাদানের সংমিশ্রণে। এমন সংবাদের উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায় যেখানে একটি মাত্র উপাদান দিয়ে সংবাদ প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে।... এইভাবে এক সংবাদ উপাদানের সাথে আরেকটি সংবাদ উপাদান সংযুক্ত হয়ে সংবাদের নতুন মাত্রার শক্তি লাভ লাভের প্রক্রিয়াকে বলে সংবাদ-রসায়ন।’ হ্যাঁ, রসায়ন বিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা- পদার্থের বিক্রিয়া। সংবাদের একটি উপাদানের সাথে অপরটির মিলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে ‘সংবাদ-রসায়ন’। সাংবাদিকতায় এই ধরণের ঘটনা প্রায়শই দেখা যায়। ‘সংবাদ-রসায়ন’র সহজ উদাহারণে বলা যায়,পান + চুন + জর্দা + সুপারি = লাল রঙের পিক! এখানে পান, চুন, জর্দা কোনটারই স্বতন্ত্র লাল রঙ উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। কিন্তু এসব উপাদানের চিবুনি [যৌথ বিক্রিয়ায়] লাল পিক উৎপন্ন হয়। যোগাযোগবিদ্যার হলো বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের সবচেয়ে সৃজনশীল অধ্যায়ের নাম রসায়ন। মানুষের মানুষের সম্পর্ক যেমন মনের রসায়ন, তেমনি সংবাদে একটি উপাদানের সাথে ভিন্ন একটি উপাদানের সমন্বয় হলে তাকে সংবাদ রসায়ন বলা হয়। সংবাদ রসায়ন ব্যাখ্যার আগে তাই আমাদের জানতে হবে রসায়ন শব্দের অর্থ কী? উপরে উল্লেখিত বিনয় ঘোষের কথাটি আমি প্রথম খেয়াল করি যখন প্রিন্সেস ডায়ানার নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ রাজপরিবারের ‘দ্রোহী দ্রৌপদী’র পিছু পিছু সাংবাদিকদের কৌতুহলের শেষ ছিলো না। সেই সাংবাদিকদের ধাওয়া করা গাড়ির মুখে ডায়ানা প্রাণ বিসর্জন দিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছিলেন। সেই সংবাদ পরিবেশনার হিড়িক তা আমার দৃষ্টিতে সংবাদ রসায়নের একটি মোক্ষম উদাহারণ। ব্যক্তিগত জীবনের অন্দরমহলে উঁকি দেয়া সাংবাদিকদের খপ্পরে পড়ে যে ডায়ানা প্রাণ দিয়েছেন, সেই ডায়ানা’র নাতিও পাপারাজ্জীদের সক্রিয়তায় আজ সংবাদ উপাদান হয়েছেন।

আমরা ‘আম জনতা’ মিডিয়ার তালে তালে ঘোরগ্রস্থের মতো মেতে উঠি। মিডিয়ার দেখানো পথে হাঁটি। সেই  যাপিত জীবনের ‘ভার্চুয়াল বিনোদনে’ মেতে উঠি। আমাদের সামনে মিডিয়া নতুন এক ‘বাস্তবতা’ নিয়ে আসে, যা আসলে ‘ছদ্মবাস্তবতা’! ভার্চুয়াল বিনোদনের কবলে একচুয়াল বিনোদন আমাদের জীবন থেকে লগ আউট হয়ে যায়। তাই আমাদের নিজের সংসারের খবর নাই, বেজায় চিন্তিত সৃজিলার সংসার নিয়ে। সৃজিলার ফেসবুক, ইনস্টায় গিয়ে দেখি ‘সারকাজমে’ কমেন্ট বক্সে উঠেছে হাসির রোল।কটু কথাকে পুরো একটা বছর পাত্তা না দিয়ে চলেছেন সৃজিলা। বিয়ের পর যে যার কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তবুও থেমে নেই ট্রোলিং!

মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় কোনো দৈনিক সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বা ফেসবুকের মতো সামাজিক নেটওয়ার্ক ছিল না। তাই পুরো মহাভারতে সঞ্জয়-ই হয়ে উঠেছিল একমাত্র বক্তা আর ধৃতরাষ্ট্রই ছিলেন একমাত্র শ্রোতা। এক ঘরে বসেই তথ্য আদান-প্রদান সীমাবদ্ধ ছিল বলেই হস্তিনাপুরের প্রজাবৃন্দ রাজনীতি সচেতন হতে পারেনি। হাতে-হাতে মোবাইল না থাকায় কুন্তি ও সূর্য’র বিবাহ বহিভূর্ত সম্পর্ক নিয়ে অনলাইন এক্টিভিস্টরা ফেসবুকে ঝড় তুলতে পারেননি। আজ আমাদের জাতীয় জীবনের সৌভাগ্য যে, মহাভারতের দিন শেষ। দেশের ক্রান্তিকালে অনলাইনে মত দেয়া যায়, সাংবাদিকরা লিখে যায়, জনতা-জনার্ধন সে সব লেখা পড়ে, গিলে, তার ভিত্তিতে কথা বলে; শেয়ার আর লাইকের বন্যা বসায়। বাঙালি আজ  যাকে বন্দনা করে, কাল তাকে বন্দী করে।কথায় আছে, ‘যার কেউ নেই তার ফেসবুক আছে’। কিন্তু যার শুধু ‘ফেসবুকই আছে’- তার আসলে ‘কেউ নেই’। এই ‘কেউ না থাকা’রাই ভালো থাকাদের নিয়ে ট্রোল করে নিজের অবদমিত ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়/ঘটাই। সৃজিলার কাণ্ড যেহেতু কেমিস্ট্রি, তাই অপদার্থ বাঙালির ফেসবুক ট্রোলকে আমি ‘কঠিন ফিজিক্স’ ছাড়া কীই বা বলতে পারি? কারণ, বিশ্বের সমস্ত বাজার দখলের জন্য পুঁজিপতিরা পন্য নিয়ে তাদের নিজ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চালু আছে সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা। এই সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টাটি মূলত মিডিয়াসৃষ্ট। অপ্রয়োজনীয় পন্যকে প্রয়োজনীয় করে তোলা, অ-খবরকে মহা গুরুত্বপূর্ণ খবরে পরিণত করাসহ আরো অ-হেতুকে হেতু করে তোলার মহান দায়িত্ব নিয়েছে মিডিয়া। গণসমাজের কঠিন বাস্তবতার সামনে কর্পোরেট কালচার এইভাবে কখনো ঐশ্বরিয়ার সন্তান প্রসব, কখনো অ্যাঞ্জোলিনা জোলির স্তন কর্তন, কখনো বা কেট মিডলটনের সন্তান প্রসবের ফ্যান্টাসি ‘ব্রেকিং’ বা ‘প্রথম পৃষ্ঠা’র মহাগুরুত্বপূর্ণ খবর করে তুলছে। মিডিয়ার এসব ‘সংবাদ রসায়ন’কে নিয়ে বাঙালির শুরু হয় ‘কঠিন ফিজিক্স’!

লেখক: *রাজীব নন্দী*
সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ ভারতের গণমাধ্যম গবেষকদের প্ল্যাটফর্ম ‘ইন্দো-বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক’ এবং দুই বাংলার গণমাধ্যম, গণপিটুনি এবং জনসংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ইমেইল: [email protected]