অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

একদিনের কসাই

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান 

প্রকাশিত: ০৪:৩৭ পিএম, ৩০ জুন ২০২৩ শুক্রবার   আপডেট: ০৪:৩৯ পিএম, ৩০ জুন ২০২৩ শুক্রবার

কার্টুন সংগৃহিত

কার্টুন সংগৃহিত

ছোটবেলার কথা চিন্তা করুন। কী আনন্দ  সেই সব ঈদে। সাত ভাগের সেই কোরবানীর গরু সবাই মিলে যখন কাটাকুটি করতাম। এলাকার সকল পুরুষ তখন একদিনের কসাই। মাংস কাটায় যে যত দক্ষ তার কদর তত বেশি। বিশেষ করে যে চাপাতি চালাতে পারতো সে হিরো কসাই।

কসাইয়ের শরীরে ভেজা গেঞ্জি, ঘাম আর মাংসের ছিটেফোটা। মাঝে মাঝে প্রশংসার ফুলঝুরি চারপাশে।কী দারুন সময় ফেলে এসেছি, যখন সবাই ছিলাম একদিনের কসাই।

কোরবানির ঈদ এলেই রাজধানীর অলিগলি, মোড়ে মোড়ে ঘুরতে থাকেন “এক দিনের কসাই”রা। কেউ কেউ বলেন, ‌‌অপেশাদার মাংস শ্রমিক। সারাবছর বিভিন্ন ক্ষুদ্র পেশায় জড়িত থাকলেও তারা মাংস তৈরির কাজ করেন কোরবানির দিনে। অদক্ষতায় তারা মাংসের সাইজ ছোট বড় করে ফেলে, চামড়া নষ্ট করে। আর সময়মতো কাজ শেষ করতে পারে না। এ রকম নানা অভিযোগ থাকলেও শহুরে জীবনে এসব মানুষের সহযোগিতায় কোরবানি দেয়া সহজ হয়েছে নগরবাসীর।

ঢাকা শহরে সাত আট লাখেরও বেশি গরু কোরবানি দেওয়া হয়। ২০ হাজারের মতো পেশাদার মাংস শ্রমিমের সাথে বাকি কাজ করেন “এক দিনের কসাই”রা। দিন দিন পেশাদার কসাইয়ের সংখ্যা কমে আসছে। বৃষ্টিমুখর ঈদে আজ আমার কসাই বলছিলেন একথা। পৃথিবীর সব দেশে কসাইয়ের সম্মান বাড়লেও আমাদের দেশে ঠিক উল্টো। আমি মনোযোগ দিয়ে ওর কথা শুনছিলাম আর বুঝলাম জাতির আজ বড় প্রয়োজন এক দিনের কসাইয়ের ।

আমার মনে পড়লো কয়েকদিন আগে পত্রিকার পাতায় ভাইরাল হয়েছিলো “মানবিক” কালু কসাই। চাপাতিটা কাঠের গুঁড়ি বা তোন্দাতে কোপ মারে আর দম নিয়ে বলে ছুরি চাপাতির দাম বাড়তি হাজারে ২০০ টাকার বেশি না হলে পোশায় না। 

কসাইয়ের এই সংকট মেটাতে অনলাইন বিপণন শপগুলো কসাই বুকিংয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিক্রয় ডটকম, এখানেই ডটকমসহ বিভিন্ন ধরনের শপ ‘কসাই বুকিংয়ের’ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংকটে ও “কসাই “পাঠিয়ে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে ‘কিসি কা ভাই কিসি কি জান’।

কসাই কি খুনী নাকি সিরিয়াল কিলার?
যে কেউ কি কসাই হতে পারে? সব কসাই কি নৃশংস? আমি তো কত নিরীহ গোবেচারা কসাই দেখেছি। তারপর ও যুগ যুগ ধরে শুধু ডাক্তার নয় স্বৈরাচার রাষ্ট্রপ্রধানদেরও কসাই বলে লোকে।

আমি ও একজন কসাই
আমি একজন রিটায়ার্ড একদিনের কসাই। আমার বড় ছেলের আকিকার সময় আমাকে কসাই হতে হয়েছিল। অনেকটা বাধ্য হয়েই। খাসি আমি নিজ হাতেই জবাই দিয়েছিলাম। তারপর যে কসাই ঠিক করেছিলাম সে এতটাই ধীরগতির এবং অদক্ষ ছিলেন যে আমাকে বাধ্য হয়েই ছুরি চাপাতি হাতে নিতে হয়েছিল। যদিও আমি তখন এমবিবিএস উত্তর এমডি কোর্সে অধ্যয়নরত ছিলাম।

আমার কসাই ভাগ্য
সেমাই ছাড়া রোজার ঈদ আর কসাই ছাড়া কোরবানীর ঈদ ভাবা যায় না। তারপর ও কী নৃশংস গালি" কসাই"। চারিদিকে একদিনের কসাই- নয়া হোক আর পুরানো। 

বেশ কয়েক বছর আগে ঈদ উল আযহার কথা বলছি। আমার ফ্লাটের কেয়ারটেকার ফরিদের মাধ্যমে ঠিক হলো আমার গরু বেলা ১১ টায় কোরবানি হবে। তবে তার আগে সকাল থেকে ফ্লাটের অন্য মালিকদের গরু কোরবানি হবে। ফরিদই কসাই ঠিক করেছে। ও জানালো গত কয়েক বছর ধরে একজন এক্সপার্ট কসাই ফ্লাটের সবার কোরবানির পশু বানানোর কাজ করেছে। তাই রাজি হয়ে গেলাম। 

আমি ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় বসে আছি নিশ্চিন্তে।  বেলা ১১ টায় ফরিদকে ফোন দেই। ফরিদ খবর কি? স্যার, খবর খারাপ। কসাই সকালে আসেনি। কারো গরুই এখনো জবাই হয়নি। কসাই খোঁজা হচ্ছে। আমি নিচে নেমে ধানমন্ডি ৪ থেকে ৫-এ আসতেই দেখা হলো জাহাঙ্গীর  ভাইয়ের সাথে। জাহাঙ্গীর ভাই  বললেন,  ভাই, কি খবর?  বললাম, এই হচ্ছে খবর।
জাহাংগীর ভাই বললেন, আপনি আমার কসাই নিয়ে যান। আপনার গরু আগে বানিয়ে নিন। তারপর দেখা যাবে।
যথারীতি ওই কসাই দল আমার গরু সোয়া এক ঘন্টায় বানিয়ে ফ্লাটের অন্য দুই জনের গরু বানানোর কাজে হাত দিল। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে এক্সপার্ট কসাই ম্যানেজ করায় ফ্লাটের মালিক সমিতি আমাকে বাহবা দিলেন আর সঙ্গে আবদার করলেন, ভাই, আপনাকে এই ফ্লাটের সেক্রেটারির দায়িত্ব নিতে হবে।
সেই থেকে এখনো আমি এই ফ্লাটের সেক্রেটারি। কসাই ভাগ্যে ফ্লাটের সেক্রেটারি। 


অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান: ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিস্ট, বিএসএমএমইউ।