অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ভিটামিন খাবেন? সাবধান!

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১০:০৩ এএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার   আপডেট: ১০:০৬ এএম, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ শুক্রবার

কাজের চাপ, মানসিক চাপ সবার ক্ষেত্রেই আজকাল ভীষণ রকম বেশি। নিজের জন্য সময় বলতে কিছুই পাওয়া যায় না। সারাক্ষণ চাপের মধ্যে থাকতে গিয়ে সাধারণ সব বয়সী মানুষের হচ্ছে অসংখ্য ভুল। এর পাশাপাশি রোজকার পুষ্টিকর খাবারেও ঘাটতি থেকে যায়। বর্তমান ডিজিটাল যুগে কাজের প্রয়োজনে বেশিরভাগ মানুষেরই ভরসা ফাস্টফুড। আর ফাস্টফুড খেতে যেমন বেশি মজা। তেমনই এর মধ্যে ক্যালোরির পরিমাণও থাকে বেশি। এসব কারণে শরীরে আজকাল নানান সমস্যা জেঁকে বসে। মস্তিষ্ক ঠিকমতো পুষ্টি না পেলে সেখান থেকেই সূত্রপাত ঘটে একাধিক সমস্যার। এসব কারণে এখন আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে ডিমনেশিয়া রোগ।

ডিমনেশিয়া হলো আমরা যা চিন্তা, অনুভব, বলি ও করি তার প্রায় সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে মস্তিষ্ক। এটি আমাদের স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করে থাকে। কিন্তু ডিমনেশিয়া হলে আমাদের মস্তিষ্ক ঠিকমত কাজ করা থেকে বিরত থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির বুদ্ধি, স্মৃতি ও ব্যক্তিত্ব লোপ পায়। যার লক্ষণ হলো- ক্ষণে ক্ষণে কথা ভুলে যাওয়া, উদাসীনতা ইত্যাদি। রোগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। বর্তমানে অসংখ্য মানুষ নিজের অজান্তে নীরবে ডিমনেশিয়া নামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিরা হঠাৎ করেই অনেক কিছু মনে করতে না পারা এ রোগে  বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। যখন কারো এরকম রোগ হয়ে থাকে, তাদের কোন কিছু মনে রাখা, চিন্তা করা ও সঠিক কথা বলা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। তারা এমন বিব্রত কথা বলতে বা করতে পারেন যা অন্যদের কাছে অদ্ভুত ঠেকে। তাদের জন্য দৈনন্দিন কাজ করা কষ্টকর হয়ে উঠে। আগে যেমন ছিলো তেমন তারা নাও থাকতে পারেন। এসবের কারণ হিসেবে পুষ্টি বিজ্ঞানীরা এক বাক্যে বলেন- যথাযথ ভিটামিনের অভাব। 

জী হ্যাঁ। শরীরের সামগ্রিক গঠনে ভিটামিনের ভ‚মিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রাকৃতিক ভিটামিনযুক্ত খাবার খেলে ভিটামিনের চাহিদা পূরণে দোকান থেকে ভিটামিন বড়ি কিনে খাওয়ার দরকার পড়ে না। সুস্থ থাকতে সুষম খাবারের কোনো বিকল্প নেই। সুষম খাবারে আবার যথাযথ পরিমাণে খনিজ লবণ ও ভিটামিন থাকতে হয়। ভিটামিন ও খনিজ লবণের কাজ হলো বিপাকক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে শরীরে শক্তি উৎপন্ন করা। এছাড়া ত্বক, হাড়, দাঁত, চুল, চোখ, স্নায়ু, মস্তিষ্কসহ দেহের অভ্যন্তরীণ তরল পদার্থের সমতা বজায় রাখে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন সুনির্দিষ্ট পরিমাণে খনিজ লবণ ও ভিটামিন খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ভিটামিন ছাড়া আমাদের পুষ্টি সব সময় অসম্পুর্ণ থেকে যায়। তাই, প্রতিদিনই আমাদের কোনও না কোনও উপায়ে ভিটামিন গ্রহণ করা অতীব জরুরি। যদিও, আমরা সবাই এই ভিটামিন গ্রহণ করেই থাকি। তবে, অনেকেই ঠিকঠাক জানি না আসলে, কোন খাবার থেকে কোন ধরনের ভিটামিন পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে বৈচিত্র্যময় শাকসবজি ও ফলমূলের যে বিপুল সম্ভার, তা অনায়াসেই পূরণ করতে পারে খনিজ লবণ ও ভিটামিনের প্রাত্যহিক চাহিদা। শর্করা এবং সামান্য পরিমাণে প্রোটিন ছাড়াও শাকসবজি ও ফলমূলে অবস্থিত খাদ্য-আঁশ, খনিজ লবণ ও ভিটামিন (মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট) দেহের অপুষ্টিজনিত রোগ (অ্যানিমিয়া, রাতকানা ইত্যাদি), কিছু ক্যানসার, স্থুলতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ ও ডায়াবেটিসের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।

অনেকেই ঠিকঠাক জানি না, দৈনিক আমাদের কী কী ভিটামিনের প্রয়োজন হয়? আর কোন কোন খাবার থেকে সেগুলো পাওয়া যায়? যেমন- ভিটামিন-এ পাওয়া যায় ছোট মাছ, দুধ, মাখন, কড লিভার ওয়েল, ঘি, মাংস, ডিম, গাজর, পালংশাক, বাধাকপি, ব্রকলি, লাল মরিচ, টমেটো, কুমড়া, লেটুস, আম, জাম্বুরা, পাকা পেঁপে ইত্যাদি থেকে। বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন-বি রয়েছে যেগুলোকে একসঙ্গে ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স বলে। ভিটামিন বি১ (থায়ামিন), ভিটামিন বি২ (রিবোফ্লাভিন), ভিটামিন বি৩ (নিয়াসিন), ভিটামিন বি৫ (প্যান্টোথেনিক এসিড), ভিটামিন বি৬ (পাইরিডক্সাইন, ভিটামিন বি৭ (বায়োটিন), ভিটামিন বি৯ (ফলিক এসিড), ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন) ইত্যাদি। এসব পাওয়া যায় ওটস, সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুধ ও দুধ জাতীয় খাবার, শিম ও মটরশুটি, মাশরুম, বাদাম ও বিভিন্ন প্রকারের বীজ, আস্ত শস্য, সবুজ শাক সবজি (পালং শাক), কলা, আভোক্যাডো, গুড়, মধু ইত্যাদিতে।

পুষ্টি বিশেষজ্ঞদের মতে, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের চাহিদা মেটাতে খাদ্যবৈচিত্র্য অনুসরণের মাধ্যমে দৈনিক দুই কাপ ফল ও আড়াই কাপ শাকসবজি গ্রহণ করা উচিত। তবে আড়াই কাপ শাকসবজির মধ্যে অন্তত এক কাপ শাক এবং দুই কাপ ফলের মধ্যে অন্তত আধা কাপ সাইট্রাসজাতীয় ফল (লেবু, জাম্বুরা, কমলা, মাল্টা ইত্যাদি) অন্তর্ভুক্ত করা ভালো। এছাড়া লেবু, আমলকি, পেয়ারা, আনারস, জাম্বুরা, চালতা, জলপাই, তেতুল, সবুজ আপেল, কমলা, আঙ্গুর, জাম, আমড়া, কাঁচা মরিচ, পুদিনা পাতা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। ভিটামিন-ডি পাওয়া যায় তৈলাক্ত বা চর্বিযুক্ত বিভিন্ন মাছ। পোনা মাছ, স্যামন মাছ, পাঙ্গাস মাছ প্রভৃতি। মাশরুম, দুধ, কর্ডলিভার ওয়েল, চিজ, কমলা লেবু, ওটস ও বাদামী চাল, ডিমের কুসুম, দই, গম, রাগী, বার্লি, পনির ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। চিনাবাদাম, আখরোট, বাদাম, উদ্ভিজ তেল, কুসুম, গম, সয়াবিন, সূর্যমুখী, সবুজ শাকসবজি (পালং শাক, বাধা কপি, ব্রকলি, কাঁচা শালগম), বিভিন্ন ধরনের মরিচ, মটর শুটি, লেবু, আভোকাডো, ডিম, স্যালমন মাছ, চর্বিবিহীন মাছ ইত্যাদি খাবারে ভিটামিন-ই পাওয়া যায়। ভিটামিন- কে জাতীয় খাবার হচ্ছে সবুজ রঙের শাকসবজি, লেটুস পাতা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ডিমের কুসুম, খাসির যকৃত, সয়াবিন তেল, শালগম, বিট, মুলা, লাল মরিচ, পালংশাক, বেদানার রস, গাজরের রস, বøুবেরি, রসুনের পাতা ইত্যাদি।
ভিটামিন সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক খাবার, শাক-সবজি, ফলমূল ইত্যাদি গ্রহণে কোনো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নেই। এবং তা স্বাস্থ্যপ্রদ। তারপরও অনেকেই দেহের পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য রক্ষার্থে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ভিটামিন ট্যাবলেট বা সিরাপ গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের ধারণা বেশী পরিমাণ ভিটামিন হয়তোবা শরীরের বেশী উপকার করে। আবার অনেক চিকিৎসক ক্যান্সার কিংবা হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন ই, ভিটামিন সি কিংবা ‘এ’ ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে পরামর্শ দেন। এসব ভিটামিন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। ফ্রি র‌্যাডিক্যালকে প্রতিহত করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোন ভিটামিন কতোটা মাত্রায় এবং কিভাবে ক্যান্সার বা হৃদরোগ প্রতিরোধ করে তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেক খাদ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের প্রক্রিয়াজাত খাদ্যদ্রব্য বেশী পরিমাণ ভিটামিন সংযুক্ত করা হয়েছে এই প্রচার করে পণ্য গ্রাহককে আকৃষ্ট করে থাকেন। অথচ ভিটামিনের মাত্রা নির্ধারণ বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কোন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত থাকে না। 

বাংলাদেশের মতো এতো বেশি পরিমাণ ওষুধ তৈরি ও বাজারজাতের প্রবণতা বিশ্বের অন্য কোনো দেশে নেই। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ওষুধকে জীবন রক্ষাকারী পণ্য না ভেবে লাভজনক পণ্য মনে করে। বাংলাদেশে অনেক নামি দামি কোম্পানির নকল ভিটামিন ওষুধে বাজার সয়লাব। অতিরিক্ত লাভের আশায় অনেক ওষুধের দোকানে নাম সর্বস্ব কোম্পানির নিম্মমানের ভিটামিন বিক্রি হয়। দেখা যায়, চিকিৎসক আপনাকে ভিটামিনের নাম লিখে দিলেন। আপনি পাশের ফার্মেসী থেকে ভিটামিন কিনে এনে নির্ধিদ্বায় নিয়ম মাফিক খেয়ে যাবেন। মাস খানেক খাওয়ার পরও আপনার কোনো উন্নতি হবে না। দিনদিন আরো অবনতির দিকে যাবে আপনার স্বাস্থ্য। এর কারণ ভিটামিনের নামে আপনি যা খেয়েছেন তা বেসন, আটা-ময়দা দিয়ে তৈরি করা ভিটামিন ছাড়া আর কিছু না।
 
এছাড়াও দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যপণ্য অতিরিক্ত ভিটামিন সংযুক্তির বিপণন বার্তা সন্দেহজনক। তাছাড়া অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ভিটামিনের বৃহৎ ডোজ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও সৃষ্টি করতে পারে। উচ্চ মাত্রায় অতিরিক্ত ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণের ফলে মাথা ব্যথা, ডায়রিয়া, অস্থি এবং লিভারের ক্ষতি হতে পারে বলে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের অতিরিক্ত ভিটামিন ‘এ’ শিশুর জন্মগত বৈকল্য সৃষ্টি করতে পারে। অনুরূপভাবে অতিমাত্রায় ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ কিডনী এবং মুত্রথলির সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। যাঁদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা রয়েছে, টানা অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হয় তাঁরা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ভিটামিন খাবেন না। কারণ এক্ষেত্রে থাকতে পারে বিপদের সম্ভাবনা। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।