অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

শীতে থাকুন সুরক্ষিত!

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ০১:৪৩ পিএম, ৭ জানুয়ারি ২০২৩ শনিবার   আপডেট: ০১:৪৭ পিএম, ৭ জানুয়ারি ২০২৩ শনিবার

সারাদেশে কনকনে শীত পড়েছে। বাতাসে কমে গেছে আর্দ্রতা। ঢাকার গরম প্রকৃতিতেও এখন প্রচন্ড শীতের আমেজ। সন্ধ্যা-সকাল কুয়াশার চাদর মুড়ে দিচ্ছে চারপাশ। এ সময় সূর্য দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থান করে বলে বাংলাদেশে সূর্যের রশ্মি তির্যকভাবে পড়ে। তাপমাত্রার পরিমাণ কমতে থাকে। রাত বড় আর দিন ছোট হয়। 

কালের অবগাহনে ডুব দিয়ে কুয়াশার আলপনা আঁকতে আঁকতে আমাদের দেশে ঘটে শীতের আগমন। শীত যেনো আসে এক বিধবা নারীর বেশে। মনে হয় প্রকৃতি তার সমস্ত দুঃখ-কষ্ট এই জগৎ-সংসার থেকে আড়াল করে রাখতে চায় কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। এই শীতে রূপ লাবণ্যের পাশে রিক্ত প্রকৃতিকে আমরা নতুন করে আবিষ্কার করি। এক অদ্ভূত আচ্ছন্নতা ঘিরে রাখে প্রকৃতিকে। দিনের সূর্য ঢেলে দেয় মায়াবী রোদ। গ্রামের খালবিল থেকে বর্ষার পানি শুকোয়। আকাশে ছন্নছাড়া ভেসে বেড়ায় নীল মেঘের ভেলা। শীতের প্রচণ্ড দাপট কখনো কখনো ক্ষণিকের জন্য আমাদের জীবনকে আড়ষ্ট করে তুললেও বাড়িয়ে দেয় মনের সজিবতা।

ক্যালেন্ডারের পাতায় পৌষ ও মাঘ দুই মাস শীতকাল। শীতকাল অন্য ঋতুগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা। অধিকাংশ মানুষেরই প্রিয় ঋতু হলো শীত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন : ‘শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে...’ ‘শীতের প্রবেশ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন : ‘শীত, যদি তুমি মোরে দাও ডাক দাঁড়ায়ে দ্বারে।/ সেই নিমেষেই যাব নির্বাক অজানার পারে।’ জসীম উদ্দীনের কবিতায় ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে/ সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’ ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘পউষের প্রবল শীত সুখী যে জন।/ তুলি পাড়ি আছারি শীতের নিবারণ। 

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, শীত নামার আগের সময়টা সাবধানে চলা উচিত। এ সময়ে জ্বর, সর্দি, কাশি, হাঁপানি, নিউমোনিয়া ব্রংকিওলাইটিস, ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের চর্মরোগ হয়। বলা বাহুল্য, শীতের শুরুতে আবহাওয়া শুষ্ক হওয়ায় ভ‚-গর্ভস্থ পানির স্তর নীচে  নেমে যায় এবং রাস্তাঘাট ধূলাবালিতে পূর্ণ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে আবহাওয়া পরিবর্তনের এ সময় মানুষের শরীরে তার প্রভাব পড়ে। অন্যান্য রোগ-ব্যাধি ছাড়াও শরীরের ত্বক শুষ্ক হয়ে ফাটতে শুরু করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, অসময়ে হালকা শীতের প্রভাবে সবচাইতে বেশী ক্ষতি হয় শিশুদের। ওদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। সে কারণে ওদের দেহে দ্রুত ভাইরাস বংশবৃদ্ধি করে এবং ওরা দ্রুত নানা রোগে আক্রান্ত হয়। 

এসময় সাবধানতা অবলম্বন না করলে নিউমোনিয়া, হাঁপানিসহ নানা প্রকার রোগে জনসাধারণ আক্রান্ত হতে পারেন। তবে শহরের লোকেরা বেশী সাবধান থাকায় এবং চিকিৎসা সুবিধা তাদের দরজার পাশে থাকায় তাদের পক্ষে রোগ প্রতিরোধ ও রোগ নিরাময় সহজ। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের চিত্র তার বিপরীত। সেখানে স্বাস্থ্য ও রোগ সচেতনতা শহরের চেয়ে অত্যন্ত কম। উপরন্তু উল্লেখযোগ্য অংশের লোকদের শারীরিক অপুষ্টির কারণে বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক অপুষ্টির দরুণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একেবারে কম। দেখা যায়, শীতের জামাকাপড় ও লেপতোষক তাদের থাকে না। একমাত্র কাঁথাই তাদের সম্বল। অপরদিকে পুকুরের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের পানির সংকট সৃষ্টি হয় এবং পানীয় জলের সংকট তীব্র হয়। ফলে গ্রামের লোকেরা ঋতু পরিবর্তনের এই সময়ই নানা রোগে আক্রান্ত হয়। ডায়রিয়া হওয়ার এটিই অন্যতম কারণ। 

পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেন, শীতে বায়ু দূষণ ঘটে সবচেয়ে বেশী। এজন্যেই এ সময় অসুখ-বিসুখ শিশুদের সহজেই কাবু করে ফেলে। শুধু শিশুরাই নয়, শীতের শুরুতে বয়স্করা বাতের ব্যথায় ও হাঁপানিতে ভোগেন। দারিদ্র্য, অসচেতনতা, অপুষ্টি, অযত্ন এ সবের কারণে রোগ-বালাই সহজেই পেয়ে বসে। অপুষ্টির দরুন শিশুরাই বেশী অসুস্থতায় ভোগে। কারণ ওদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। শীতের রোগ-বালাইগুলোর মধ্যে শিশুর নিউমোনিয়া অন্যতম। সাধারণ সর্দি-কাশিও অনেক সময় দুর্বল স্বাস্থ্য ও অযত্নের ফলে মোড় নেয় প্রাণঘাতি নিউমোনিয়ায়। 

প্রতি বছর আমাদের দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী অনেক শিশু নিউমোনিয়ায় মারা যায়। ইউনিসেফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সংখ্যা লাখের উপরে। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লে নিউমোনিয়ায় শিশু মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশের গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকেই রোগটি সম্পর্কে সচেতন নয়। ফলে অনেক সময় সাধারণ সর্দি জ্বর অযত্নের কারণে নিউমোনিয়ায় রূপ নেয়। আর নিউমোনিয়ার লক্ষণ বুঝতে না পারার কারণে শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিতে দেরী হয়ে যায়। ফলে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। শীতে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে হাঁপানি ও ব্রংকিওলাইটিসের প্রকোপ দেখা যায়। ব্রংকিওলাইটিস সাধারণত আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তিদের মাধ্যমে শিশুদের মাঝে ছড়ায়। কাজেই মা-বাবাদের শীতের প্রারম্ভে এ ব্যাপারে সাবধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। হাঁপানি হলে শিশুকে ধূলাবালি ও ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশে রাখতে হইবে। হাঁপানি আক্রান্ত শিশুদের হঠাৎ যেনো ঠান্ডা না লাগে সেদিকে সাবধান হোন এবং সতর্ক থাকুন।  

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।