অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ফ্রিজ কখন নীরব ঘাতক?

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ০২:৪০ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ০২:৪৯ পিএম, ৯ ডিসেম্বর ২০২২ শুক্রবার

রেফ্রিজারেটরের বাংলা নাম হিমায়ক যন্ত্র। প্রচলিত ভাষায় একে আমরা ফ্রিজ বলে থাকি। যা খাবার সংরক্ষনে ব্যাবহৃত হয়। সত্যি-সত্যিই বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। ডিজিটাল যুগে কথাটা বুঝিয়ে দিতে হয় না। আপন মনেই বুঝে নেয়া যায়। কী গ্রাম, কী শহর। প্রায় প্রতিটি মানুষের বাড়িতেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। খাবার ও পানীয় দীর্ঘদিন ভালো রাখার ও সঞ্চয়ের জন্যে পরিবারের ছোট বড় সকলের সার্বক্ষণিক কাজের জিনিস এই রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ অপরিহার্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। 

আজকাল অনেকেই এই রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজের নানান সমস্যা নিয়েও চিন্তিত। খাবার রাখলেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিংবা ফ্রিজ ঠিকমত কাজ করছে না। আরও কত্তো কী যন্ত্রণা! এ ব্যাপারে মার্কিন খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) তালিকা অনুযায়ী, কাঁচা মাংস রেফ্রিজারেটরে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত ভালো থাকে। এই সময়ের মধ্যে মাংসের পুষ্টিগুণে খুব একটা হেরফের হয় না। তবে এর চেয়ে বেশি সময় মাংস সংরক্ষণ করলে পুষ্টিগুণ আর স্বাদ-দুই-ই কমে যেতে পারে।
 
বিজ্ঞানীরা জানান, ফ্রিজের বাইরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকভাবে বেশি থাকার কারনে এর ভেতরের অংশকে সাধারন উপায়ে ঠান্ডা রাখা যায় না। কারন তাপ সবসময় উষ্ণতর বস্তু থেকে শীতলতর বস্তুতে সঞ্চালিত হয় এবং যান্ত্রিক শক্তি ব্যয় ছাড়া এর বিপরীতটা ঘটানো সম্ভব নয়। তাই এমন কোনো উপায় প্রয়োজন হয় যার মাধ্যমে ফ্রিজের ভেতরের তাপকে বাইরে বের করে আনা সম্ভব হবে।

আমরা জানি, তরল পদার্থ বাষ্পে পরিণত হওয়ার জন্য সুপ্ততাপ প্রয়োজন। ফ্রিজের ভেতরের অংশকে ঘিরে ফাপা নলের কুন্ডলী পেঁচনো থাকে। এই কুন্ডলীর মধ্যে ফ্রেয়ন বা হিমায়ক পদার্থ থাকে। এই নলের সঙ্গে সংকোচক পাম্প বা কম্প্রেসর লাগানো থাকে। পাম্প চালু করা করা হলে নলটির ভেতরে চাপ কমে যায়। আর চাপ কমে যাওয়ায় ফ্রেয়ন দ্রæত বাষ্পীভূত হয়। ফ্রেয়নের এই বাষ্পে পরিণত হওয়ার জন্যে সুপ্ততাপ ফ্রিজের ভেতরের অংশ থেকে শোষণ করে। এর ফলে তাপমাত্রা কমে যায় বা শীতলীকরণ ঘটে। বাষ্পীভূত ফ্রেয়নকে  কম্প্রেসারের সাহায্যে সংকুচিত করে ঘনীভবন কুন্ডলীর মধ্যে আনা হয়। এসময় ফ্রেয়ন গ্যাস সুপ্ততাপ বর্জন করে পুরোপুরি তরলে পরিণত হয়। তরল ফ্রেয়ন পুনরায় বাষ্পীভবনের জন্যে পাঠানোর আগেই এই তাপ বের করে দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কারন তা না হলে শীতলীকরণ প্রকোষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। কন্ডেন্সারের সঙ্গে সংযুক্ত তামার জালিতে এই তাপ পরিবহন প্রক্রিয়ায় সঞ্চালিত হয়। তারপর পরিবেশে ছড়িয়ে যায়। শীতল ফ্রেয়নকে পুনরায় বাষ্পীভবন কুন্ডলীর মধ্য দিয়ে পরিচালনা করে। এভাবে পুরো প্রক্রিয়াটির পুনারাবৃত্তি করা হয়। রেফ্রিজারেটরের ভিতরে একটি কম্প্রেসরের সুইচ অন-অফ করার মাধ্যমে রেফ্রিজারেটরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে। ফ্রিজের দেওয়াল তাপ কুপরিবাহী হওয়ায় বাইরের তাপ ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না।

কিন্তু বৈশি^ক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য-পণ্য থেকে শুরু করে জ¦ালানি তেলেও ভেজাল হচ্ছে। এতে গাড়ির ইঞ্জিনের ক্ষতি যাই হোক। তাতে কার কি? এটা যেমন সত্যি খাঁটি কথা। ঠিক তেমনি ভয়ংকর ব্যাপার হলো, সাম্প্রতিক সময়ে ফ্রিজের বাজারে বেশ কিছু কোম্পানি অধিক মুনাফার লোভে মানুষের নিত্য ব্যবহার্য পণ্য এই রেফ্রিজারেটরে সিএফসিযুক্ত ‘আর টুয়েল্ভ’ গ্যাস ব্যবহার করে বাজারে বিক্রি করছে। যা কী না ওজোনস্তর ধ্বংস ও ক্যান্সারসহ নানাবিধ গুরুতর জটিল রোগের কারণ হতে পারে বলে গবেষক, বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে আসছেন। তাই আশংকাজনক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে- খাদ্য সংরক্ষণের জন্য আমাদের বাসা-বাড়িতে যে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ রয়েছে বা ব্যবহার করছি, সেটা কি পরিবেশবান্ধব?

বিজ্ঞানীরা বর্তমানে প্রচলিত মানহীন ফ্রিজ সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এবং রেফ্রিজারেটর কোম্পানিগুলোকে ‘আর ১৩৪ এ’ এবং ‘আর ৬০০ এ’  মানের গ্যাস  বা রেফ্রিজেন্ট ব্যবহার করার আহবান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রযুক্তি গবেষকদের মতে, আমরা যেহেতু দেশে ফ্রিজ তৈরি করিনা, চীন ও ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে ফ্রিজ আমদানি করা হয়। সেহেতু সিএফসি গ্যাসের ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নেই। এদিকে গবেষকরা স্বীকার করেছেন, ফ্রিজের সিএফসি গ্যাস পরিবেশের নানান ক্ষতিসহ মানব দেহে ক্যান্সার ও অন্যান্য জটিল রোগের কারণ হতে পারে। 

তাই রেফ্রিজারেটর কেনার সময় বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া প্রয়োজন বলে গবেষকরা মনে করেন। যেমন-রেফ্রিজারেটরের কেবিনেট, বডি, ফোমিংয়ের পুরুত্ব কতটা? এই পুুরুত্ব বেশি থাকলে ঠান্ডা ধারণ করার ক্ষমতা বেশি হয়। এমনকি  বিদ্যুৎ চলে গেলেও ঠান্ডা বেশিক্ষণ বজায় থাকে। এতে কম্প্রেসার কম চলে এবং বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় হয়। শুধু তাই নয়, রেফ্রিজারেটরের ইনার কেবিনেট উন্নতমানের এবিএস প্লাস্টিক শিটের তৈরি কি না তাও দেখে নিতে হবে। এসব শিটের গুনগতমান ভালো এবং জোড়া না থাকায় ভাইরাস জাতীয় কোনো জীবাণু রেফ্রিজারেটরের মধ্যে সৃষ্টি হতে পারে না। কিন্তু বাজারে বেশ কিছু রেফ্রিজারেটর সাধারণ অ্যালুমিনিয়াম শিট বা সাধারণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। যাতে সহজে খাবার সামগ্রী জীবাণুযুক্ত হয়। এছাড়াও দেখতে হবে, রেফ্রিজারেটরের সামনের দরজা ‘ভিসিএম’ যুক্ত শিট অর্থাৎ মসৃণ, চকচকে দানাযুক্ত শিট দিয়ে তৈরি কি না? কুলিং ইভাপরেটরের স্তর পর্যাপ্ত পরিমাণে জায়গা রয়েছে কিনা এবং রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসারের পেছনে ফোমিং ও মেটাল শিটকে নিরাপদ রাখার জন্য গ্যালভানাইজড স্টিল কভার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে কি না ইত্যাদি খুব ভালো করে দেখে নেওয়া ভালো। 

ডিজিটাল এ সময়ে যে কোন পণ্য ক্রয় করার সময় ক্রেতা সাধারণের পণ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্য অবগত হওয়া প্রয়োজন। তাই একটি ভালো মানের রেফ্রিজারেটর কেনার আগে অবশ্যই অনলাইন সার্চ করে দেখে শুনে নিবেন। বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত আমদানি শর্তানুযায়ী পণ্যের পেছনের লেবেলে পণ্যের বিভিন্ন তথ্য যেমন- লিটার, ক্যাপাসিটি, গ্যাসের নাম ও নম্বর যেমন- ‘আর ৬০০ এ’ অথবা ‘আর ১৩৪ এ’ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে কি না তাও ভালো করে দেখে নেওয়া দরকার। 

বিশ্বায়নের আশীর্বাদে এবং নিত্য-নতুন আধুনিক প্রযুক্তির কারণে এক সময়কার বিলাস দ্রব্যসামগ্রী বলে কথিত প্রযুক্তি যন্ত্র রেফ্রিজারেটর এখন আর উচ্চবিত্তের হাতে সীমাবদ্ধ নেই। এখন এসব পণ্য সামগ্রী মধ্যবিক্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। প্রত্যেক পরিবারে রেফ্রিজারেটর এখন একটি প্রেেয়াজনীয় এবং আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। অতএব রেফ্রিজারেটর ক্রয়ের সময় সতর্ক থাকা জরুরি। পরিবারের প্রয়োজন বুঝে কত লিটারের রেফ্রিজারেটর কিনবেন? তারপর সিদ্ধান্ত নিন। রেফ্রিজারেটরে ইনভার্টার ব্যবহার করলে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। এছাড়া বেশিক্ষণ ফ্রিজ খুলে রাখা উচিত নয়। এতে কমপ্রেসারের ওপর বাড়তি চাপ পড়ে। ফলে ফ্রিজ আবার যখন নিজেকে ঠান্ডা করবে, তখন বিদ্যুৎ খরচ বেশি হয়ে থাকে। আর হ্যাঁ, যাঁরা অনেকদিন থেকে পুরোনো রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করছেন, তাঁদের রেফ্রিজারেটরের কনডেনসার বিশেষজ্ঞ মিস্ত্রি দ্বারা নিয়মিত পরীক্ষা করে নিবেন। কনডেনসারের কয়েলে ময়লা জমলে সঠিকভাবে সেটি তাপ বিকিরণ করতে পারে না। বিদ্যুতের বিল বাড়বে। বেশি বিদ্যুৎ খরচ হবে। তাই কনডেনসার পরিষ্কার রাখতে হয়। না হলে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ বাড়ি-ঘরের নীরব ঘাতক হয়ে দাঁড়ায়।

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।