অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ঢাকায় পথ চলতে সচেতন হোন!

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১২:৩৫ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ১২:৫৫ পিএম, ২৫ নভেম্বর ২০২২ শুক্রবার

নামে ‘তিলোত্তমা শহর ঢাকা’ হলেও রাস্তাঘাটে চলার সময় উটকো ঝামেলা ঘাপটি মেরে বসে থাকে রাজধানীর এখানে সেখানে। এই তো সেদিন রাজধানীর গুলশানে ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলে পড়ে আহত হলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মানির উপ-রাষ্ট্রদূত ইয়ান ইয়ানোস্কি। হুইলচেয়ারে বসা অবস্থায় আঘাত পাওয়া পায়ের ছবি দিয়ে টুইট করেন জার্মানির উপ-রাষ্ট্রদূত। এরপর ম্যানহোলটি মেরামত করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।

টুইটে ইয়ানোস্কি লিখেন, ‘আমি ঢাকাকে পছন্দ করি, কিন্তু আমি সবসময় জানতাম, কোনো না কোনো সময় রাতের বেলা ঢাকনাবিহীন কোনো ম্যানহোলে পড়ে যাবো। যদিও আমি সবসময় রাস্তায় চলার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করি।’ এই কুটনীতিক আরও লিখেন, ‘আমার জন্য প্রার্থনা করুন, যেনো আমি বাংলাদেশ ঘুরে দেখার জন্য দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারি।’ টুইটারেই সাড়া দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি জার্মান উপ-রাষ্ট্রদূতের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে খোলা ম্যানহোলের অবস্থান জানতে চান। উত্তরে ইয়ানোস্কি লিখেন, ‘আপনার প্রতিক্রিয়ায় অভিভূত। ওই জায়গাটি গুলশান-২ নম্বরের ৮০ নম্বর সড়কের ডান দিকটায়। নর্ডিক ক্লাবের কাছে, যেখানে সন্ধ্যায় অনেক বিদেশি হাঁটতে বের হন।’ এরপর রাত পৌনে ১১টার দিকে ওই টুইটের লুপে দুটি ছবি প্রকাশ করে মেয়র জানান, সিটি করপোরেশনের কর্মীদের সেখানে পাঠিয়েছেন তিনি। তিনি লিখেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে, দুর্ভাগ্যবশত লোহার ঢাকনা চুরি হয়ে গেছে আরও কয়েকটি জায়গার মত।’ জার্মান উপ-রাষ্ট্রদূতের টুইটের লুপে একইভাবে ম্যানহোলে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানান ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের উপ-রাষ্ট্রদূত বার্নড স্পানিয়ের। জার্মান বংশোদ্ভূত এই কুটনীতিক লিখেন, ‘আপনি কি জানেন, এটার আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে? দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন।’ পরে নিজের ছেঁড়া স্যুটের ছবি দিয়ে বার্নড স্পানিয়ের লিখেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান, কেবল আমার (পুরাতন) স্যুট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’ ‘তার মানে, এক বছরের মধ্যে ঢাকার রাস্তার ভিকটিম হয়েছেন তিনজন জার্মান।’ এ তো গেলো ঢাকার ম্যানহোলে নিত্য আহত হবার ঘটনার কথা।

এই তো গত সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুরে বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেলো নবম শ্রেণির স্কুল শিক্ষার্থীর। নিহত হৃদয় মিরপুর আদর্শ স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। মঙ্গলবার দুপুরে মিরপুরের কাজীপাড়ার আল হেলাল হাসপাতালের সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। হৃদয় মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় পেছন থেকে বাস ধাক্কা দিলে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হয়। রাজধানীতে বেপরোয়া একটি পরিবহনের নাম পাগলা লেগুনা। সরকারি খাতায় হিউম্যান হলার নামে পরিচিত। জানা যায়, ঢাকার ২৫১টি রোডের ১৫৯ টিতেই চলছে লেগুনা। অধিাকাংশ ক্ষেত্রেই লেগুনার চালক অপ্রাপ্ত বয়স্ক। অদক্ষ হাতে বেপরোয়া গতিতে পাগলা গাড়ি লেগুনা চালানোর কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণ হারাচ্ছেও মানুষ। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও লাইসেন্স বিহীন এই চালকরা ব্যস্ত রাজধানীর সড়কগুলোতে লেগুনা চালায় ট্রাফিক প্রশাসনের নাকে ডগায়। জিগাতলা, ফার্মগেট, ষাট ফিট, আজিমপুর, ট্যানারি মোড়, নিউমার্কেট, ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হল, মোহাম্মদপুর থেকে শ্যামলী, গুলিস্থান থেকে আজিমপুর, ট্যানারি মোড়, মিরপুর ১ নম্বর থেকে মিরপুর ১২ নম্বর ইত্যাদি। এসব গাড়ির কারণে প্রায়ই পথে-ঘাটে চলতে সামান্য অসর্তকতায় ঘটে যায় দূর্ঘটনা। তাই পথচারী, যাত্রী, কিংবা চালক আপনি যে ভূমিকায় থাকুন না কেনো, সব সময় সজাগ থাকতে হবে। জীবন যুদ্ধের অসীম ভাবনা অন্তত পথ চলার সময় ভাবতে যাবেন না। জীবনের ভুল ভ্রান্তির হিসাব নিকাশের জায়গা নিশ্চয়ই রাস্তাঘাট নয়। তাই চলতি পথের বিপদ থেকে রক্ষা পেতে সতর্ক ও সাবধান থাকা খুবই জরুরি।

অফিস, স্কুল বা কর্মস্থলে যেতে হলে হাতে একটু বেশি সময় নিয়ে বাসা থেকে বের হোন। জীবন বিপন্ন করে রূদ্ধশ্বাসে কর্মস্থলে ছোটা মোটেও সুবিবেচনার কাজ নয়। মাথা ঠান্ডা রাখুন। ঝুঁকি নিয়ে বাসের দরোজায় ঝুলতে যাবেন না। সামনে পিছে ডানে বামে কোনো দিকে না তাকিয়ে এমনকি মোবাইলে কথা বলতে বলতে বেহুশের মতো রাস্তা পার হতে গেলে অ্যাক্সিডেন্টের সম্ভাবনা থাকে শতভাগ। তাই রাস্তা অতিক্রমের সময় ডানে বামে দেখে নিন। প্রয়োজনে অপেক্ষা করুন। রাস্তা ফাঁকা হলে তারপর পার হোন। জেব্রাক্রসিং বা ফুট ওভারব্রীজ ব্যবহারে নিজেকে অভ্যস্থ করে নিন। পায়ে হাঁটা পথ হলে রাস্তায় না হেঁটে ফুটপাথ বেছে নিন। ফুটপাতেও আজকাল ট্রাফিক প্রশাসনের সামনে দিয়েই মোটর সাইকেল চলতে দেখা যায়। তাই ফুটপাতও পথচারির জন্য নিরাপদ নয়। 

রাজধানীতে আজকাল ছিনতাইকারীরা যেনো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আগে শোনা যেতো ছিনতাই হয় টাকা কড়ি। এখন মানুষও ছিনতাই হয়। স্বয়ং পুলিশের হাত থেকে। গত ২০ নভেম্বর মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি ছিনতাই হয় ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ থেকে। পথচারীদের মনে রাখতে হবে- ট্যাক্সি, বাস ও ট্রেনের জানালায় ছদ্মবেশি ছিনতাইকারী ঘোরাফেরা করতে থাকে। ট্রেন বা বাস ছেড়ে দেয়া মাত্রই তারা আপনার হাতঘড়ি, ব্যাগ, স্বর্ণের চেইন বা কানের দুল, মোবাইল সেট ইত্যাদি টান দিয়ে ছিনিয়ে নিতে পারে। সুতরাং এ বিষয়ে সতর্ক থাকা অত্যাবশ্যক। যানজটে আটকা পড়লেই সতর্কতামূলক দৃষ্টি নিয়ে যানবাহনে অবস্থান করুন। স্মার্টফোন সেট হাতে না রেখে পকেটে বা ব্যাগে রাখাই ভালো। একান্তই যদি হাতে রাখতে হয় তাহলে চোখ কান খোলা রাখুন।

আপনি রিকশার আরোহী হলে অবশ্যই রিকশার হুড তুলে নিন। মহিলারা শাড়ির আচঁল কিংবা ওড়না দিয়ে কান ও গলা জড়িয়ে বসুন। পুরুষদের ক্ষেত্রে মোবাইল, মানিব্যাগ, ঘড়ি সাবধানে রাখুন। আর গলায় চেইন থাকলে শার্টের বোতাম বুক পর্যন্ত লাগিয়ে নিন। সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে অনেকেই শেয়ারে ওবার, পাঠাও, সিএনজি, স্কুটার বা ট্যাক্সি ক্যাবে উঠে গন্তব্যে পৌঁছাতে চান। এভাবে শেয়ারে যাতায়াত করাটাও আজকাল খুব বিপজ্জনক। চালক এবং যাত্রীর ছদ্মবেশে অনেক ছিনতাইকারী ইদানিং শিকারের সন্ধানে রাস্তায় বের হয়। মাঝখানে চলন্ত অবস্থায় দূর্বৃত্তরা আপনার বুক বরাবর চাকু বা পিস্তল চেপে ধরতে পারে। অথবা নিয়ে যেতে পারে নির্জন কোনো স্থানে। তারপর লুট করে নিতে পারে আপনার সবকিছু। থানায় জিডি করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না আপনার। সুতরাং শেয়ারে অন্তত: কোন যানবাহনে উঠতে যাবেন না। আর সন্ধ্যার পর তো নয়ই।

আপনি সিএনজি, ট্যাক্সি ক্যাব আরোহী হলে সিটের মাঝামাঝি জায়গায় বসুন। সামনের দিকে ঝুঁকে না বসে পেছনে হেলান দিয়ে বসুন। মহিলারা পার্স, ভ্যানিটি ব্যাগ সামলে রাখুন। যারা মোটর সাইকেল বা বাইসাইকেল চালান, তাদের মনোযোগ সব সময়ই রাস্তার দিকে রাখতে হবে। এক হাতে হ্যান্ডেল ধরে আছেন তো অন্য হাতে জ্বলন্ত সিগারেট কিংবা কানের কাছে স্মার্ট ফোন ধরে কথা বলছেন, এটা ভীষণ বিপজ্জনক। ঢাকায় অনেক পথচারী স্মার্টফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়ায় দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তাই এমন কাজ ভুলেও করতে যাবেন না। আপনি কারের আরোহী হলে গাড়ির সবগুলো দরজার ভেতর থেকে লক করে দিন। সবগুলো জানালার কাঁচ তুলে দিন। প্যান্টের পেছনের ম্যানি ব্যাগে কখনো অতিরিক্ত টাকা রাখবেন না। শার্ট বা প্যান্টের পকেটের অন্তত দু’ জায়গায় টাকা ভাগ করে রাখতে পারেন। স্মার্ট ফোন সেটটি ব্যাগে বা পকেটে রাখুন। আর সব সময় খেয়াল রাখুন। আপনি নিজেই যদি প্রাইভেট গাড়ি ড্রাইভ করেন তাহলে স্টিয়ারিং ধরার পরপরই ব্রেক স্যুতে চাপ দিয়ে আগে পরখ করে নিন। ড্যাশবোর্ডে সবকিছু ঠিকঠাক দেখে নিন। ট্যাংকিতে ঠিকমতো এবং পর্যাপ্ত ফুয়েল রয়েছে কিনা। গাড়িতে উঠেই সিট বেল্ট বেঁধে নিন। রক্ষণশীল গতিতে ড্রাইভ করুন। মনে রাখবেন সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। দরকার মনে করলে, আরেকবার দেখে নিন ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, ডিজিটাল ব্লু বুক ইত্যাদি কাগজপত্র আপনার সঙ্গে ঠিকঠাক আছে তো? সবকিছু মিলিয়ে আপনি এমনভাবে প্রস্তুতি নিন যাতে আপনি কোন দূঘর্টনা এড়াতে পারেন। আর হ্যাঁ, পথচারীরা পথ চলতে সতর্ক হোন, যেনো ছিনতাইকারীরা টার্গেট হিসেবে আপনাকে নির্বাচিত না করে।

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।