অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

রাসায়নিক মারণাস্ত্র লিপস্টিক

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১১:৪৮ এএম, ২১ অক্টোবর ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ১১:৫১ এএম, ২১ অক্টোবর ২০২২ শুক্রবার

লিপস্টিক এক প্রকার প্রসাধনী দ্রব্য। যা বিভিন্ন রকম রঞ্জক পদার্থ, তেল, মোম এবং ত্বক কোমলকারী পদার্থের সন্নিবেশে তৈরি হয়। মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে তা ঠোঁটে লাগানো হয়। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার নারীদের মাঝে মুখের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে ঠোঁটে লিপস্টিক ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। প্রাচীন মিশরীয়রা সামুদ্রিক আগাছা থেকে তৈরি পার্পল-লাল রংয়ের এক প্রকার পদার্থের সঙ্গে ০.০১% আয়োডিন, এবং কিছু ব্রোমিন মিশিয়ে এক ধরনের রঞ্জক পদার্থ ব্যবহার করতেন। যা লিপস্টিক হিসেবে প্রয়োাগ করা হতো। শুনতে অবাক লাগলেও কথাটা সত্যি-হলুদ, মরিচের গুঁড়া থেকে শুরু করে কীটপতঙ্গ এহেন কোনো উপাদান নেই যা ঠোঁটকে পছন্দসই রঙে রাঙাতে কাজে লাগানো হয় না। রানী ক্লিওপেট্রা তাঁর ঠোঁটে যে লিপস্টিক ব্যবহার করতেন, তা তৈরি হতো মেরুন রঙের গান্ধি পোকা বা বিটল থেকে। এছাড়া বেইজ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতো পিঁপড়া। এর ফলে ঠোঁটে এক গাঢ় লাল আভা ফুঁটে উঠতো। 

মেকআপ করার ক্ষেত্রে লিপস্টিক একটি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য। আজকাল আধুনিক নারী মাত্রই বাইরে বেরোবার আগে একবার ক্লিনজার, ময়েশ্চাইজার আর মেক-আপ দিয়ে মুখ বেশ চকচকে করে তারপর পছন্দসই লিপস্টিকে ঠোঁট রাঙিয়ে বেরোতে ভোলেন না। গবেষকরা বলছেন, এমনটা করা যদি প্রতিদিনকার রুটিন হয় তবে ওই সাময়িক উজ্জ্বলতা ঠোঁটে, শরীরে একটা স্থায়ী মালিন্যের ছাপ রেখে যায়। প্রতিদিন একটু আধটু করে অনেকটা পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ ত্বকের চামড়ার মধ্যে দিয়ে শরীরে ঢোকে। কৃত্রিম এসব প্রসাধনীর কোন কোনটা ক্যানসারের জন্ম দেয়। কোনটা অ্যালার্জি বা চুলকানি সৃষ্টি করে ও চামড়ায় অকালে বয়সের ছাপ এনে দেয়। 

প্রসাধনী শিল্প জগতের পত্রিকা ইন কসমেটিকস জানাচ্ছে, গড়পড়তা প্রতিটি নারী বছরে প্রসাধনী আর পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী বাবদ দশ পাউন্ড ছয় আউন্স করে রাসায়নিক কিনে আপন মনে নিজের শরীরে শোষণ করায়। বায়োকেমিস্ট রিচার্ড বেন্স তিন বছর ধরে প্রসাধনী আর শরীর পরিষ্কার রাখার দ্রব্যাদি নিয়ে গবেষণা করে জানিয়েছেন- দীর্ঘদিন রাসায়নিকযুক্ত প্রসাধনী ব্যবহারের ফলে ত্বকের ক্ষতি হয়। বিশেষ করে লিপস্টিকে ঠোঁটে কালচে দাগ পড়ে যায়। ম্যাট লিপস্টিক ঠোঁটের যে কোনও রুক্ষ দাগের মধ্যে স্থায়ী হয়ে থাকে। এতে ঠোঁটের ত্বকের অবনতি হয়। তাই এখন থেকে আমাদের সত্যি-সত্যিই জরুরি প্রশ্ন তোলা উচিত, লিপস্টিকের গুণমান কী? এবং এতে কী কী জিনিস মেশানো হয়? কারণ এসব পদার্থ আমরা প্রতিনিয়ত চামড়ায় প্রয়োগ করে চলেছি। তাই এসব সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকা দরকার। এগুলো কতোটা নিরাপদ? এই রাসায়নিক পদার্থগুলো শরীরে কি কি ক্ষতি করতে পারে? অথচ এসবে আমাদের কোন ধারণাই নেই। 

আগেকার দিনে প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে লিপস্টিক তৈরি করা হতো। লিপস্টিকের সর্বপ্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো সরাসরি মৌচাকের মোম। এর সঙ্গে থাকতো প্রাকৃতিক নানান পিগমেন্ট বা রঞ্জক। বর্তমান ডিজিটাল যুগের আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে লিপস্টিক উপকরণেও এসেছে আমূল পরিবর্তন। বর্তমানে আধুনিক উপায়ে অনেক রাসায়নিক দ্রব্য তথা উপকরণ ব্যবহারে তৈরি হচ্ছে লিপস্টিক। বিভিন্ন  ব্র্যান্ড বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে নানান উপায়ে তৈরি করছে লিপস্টিক। বিভিন্ন দামে সেগুলো বিক্রিও হচ্ছে। ক্রেতারা তাদের পছন্দের ব্র্যান্ডের মার্কার ও রঙের লিপস্টিক সাধ্য অনুযায়ী ক্রয় করে চলেছেন। তেমনই বিশ্বজনীন জনপ্রিয় কিছু  ব্র্যান্ড হচ্ছে- লরিয়্যাল, ল্যাকমি, গোল্ডেন রোজ, রেভলন, নিওর, রিভাজ, লোটাস, ডেভিস, জ্যাকলিন ইত্যাদি। 

সাধারণত আমরা লিপস্টিক কেনার সময়ে নিজেদের পছন্দের রঙ আর ব্র্যান্ড দেখে কিনি। কিন্তু তার সাথে সেই লিপস্টিকের উপাদানগুলোও দেখে নেয়া প্রয়োজন। ম্যাট লিপস্টিক তৈরিতে বেশি মোম, রঙ এবং কম তেল ব্যবহার করা হয়। ম্যাট লিপস্টিকে বেশি ফিলিং এজেন্ট হিসেবে থাকে যথা- সিলিকা, মিকা ইত্যাদি। দীর্ঘস্থায়ী লিপস্টিকগুলোতেও থাকে সিলিকন তেল। যা ঠোঁটে রঙ সিল করে দেয়। যে কারণে এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়। আবার তেল কম থাকায় অনেক সময় ঠোঁট শুষ্ক হয়ে যায়। মোমের কাজ হলো শক্ত লিপস্টিকের কাঠামো দেয়া। শিমেরি বা ফ্রস্ট লিপস্টিকে চকচকে বা ঝলমলে রূপ দেয়। চকচকে লিপস্টিকে ঠোঁটে চকচকে ফিনিস দেয়ার জন্য একটু বেশি পরিমাণে চর্বি থাকে। সন্দেহজন ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে প্যারাবেন্স। যা সংরক্ষক পদার্থ। এগুলো ব্যাপকভাবে ত্বক আর চুলের প্রসাধনী যেমন- সাবান, শ্যাম্পু, দূর্গন্ধনাশক আর বেবি লোশনে ব্যবহৃত হয়। প্যারাবেন্স জীবাণুর বংশবৃদ্ধি আটকাতে সক্ষম হলেও স্ত্রী হরমোন ইষ্ট্রোজেন এর মতো এর কিছু ধর্ম রয়েছে। যা থেকে টিউমার, ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। সম্প্রতি স্তনের টিউমারে ব্যাপক আকারে এসব রাসায়নিকের অস্তিত্ব ধরা পড়ছে বলে গবেষকরা জানান। 

গবেষকরা আরও বলেন-সাবান শ্যাম্পু, টুথপেস্ট ইত্যাদির ফেনা করে যে পদার্থ অর্থাৎ সোডিয়াম লরিল সালফেট, সেটাও চামড়ার পক্ষে ক্ষতিকর। সয়েল অ্যাসোসিয়েশন শরীরে এসব ব্যবহারকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এসব উপাদান অত্যাধিক ব্যবহারে শরীরের ক্ষতি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন রসায়ন বিজ্ঞানী অ্যান্ডি বার্নিং। তিনি পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে জানিয়েছেন প্রতিটি লিপস্টিকে মেশানো থাকে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস এবং ইমোলেটিনেট, মোম, বিভিন্ন তেল যেমন জলপাই তেল, খনিজ তেল বা পেট্রোক্যামিক্যাল বা পেট্রোলেটাম, কোকো, মাখন, ল্যানলিন এবং চর্বি বা পিগমেন্ট। সিন্থেটিক মুক্তো কণা, যেমন বিসমাথ এবং ইমোলেটিনেটও ব্যবহার করা হয় লিপস্টিকে। এছাড়াও সীসা এবং অন্যান্য ট্রেস ধাতু লিপস্টিকে পাওয়া যায়। আই শ্যাডো, মাস্কারা ইত্যাদিতে সিসা থাকে। তাছাড়াও ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, অ্যান্টিমনি, ক্রোমিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, অ্যালুমিনিয়ামের মতো ভারী ধাতুও ব্যবহার করা হয় লিপস্টিকে। যেগুলো অত্যাধিক মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে ক্ষতি করে। অত্যাধিক পরিমাণে সিসা শরীরে গেলে তা হরমোনের সমস্যা করতে পারে। সম্প্রতি মার্কিন খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এক সমীক্ষা চালায়। যেখানে কিছু লিপস্টিক নিয়ে তাতে সিসার পরিমাণ দেখা যায়। যা ৯৯% এর বেশি প্রসাধনীতে ১০ পিপিএম বা তার কম পরিমাণে লেড বা সিসা রয়েছে। তবে সেটা অবশ্যই মানবদেহের জন্য সহনীয় মাত্রায় বলা হলেও বেশিরভাগ প্রসাধন নির্মাতা এসব বিষয়ে সচেতন নয়।

ইন কসমেকিস বলছে- লিপস্টিকের রাসায়নিক ঠোঁটের মধ্য দিয়ে মুখে গেলে তবু লালা ও পাকস্থলির জারক রস তাকে ভেঙ্গে দেয়। কিন্তু এই রাসায়নিক ত্বক থেকে শোষিত হলে সোজা রক্তে পৌঁছে যায়। সমীক্ষায় প্রকাশ, কোন কোন নারী রোজ বিশটির মতো প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার করে থাকেন। তাদের শরীরে কি পরিমাণ বিষ ঢুকছে? কল্পনা করা যায়! চোখের পাতা সজীব রাখার জন্যে কন্ডিশনার কি এতোটাই জরুরি? আর কে না জানেন, পুরনো প্রসাধন দ্রব্যগুলো তো জীবাণুর চমৎকার আঁতুরঘর। অবশ্য প্রস্তুতকারকদের পক্ষে বরাবরই দাবি করে বলা হয়- এসবের ব্যবহার অনিরাপদ নয়। গবেষকদের মতে, এসব উপাদান এড়িয়ে চলাই ভালো। কারণ সীসা মানে বিষ। শরীরে অত্যাধিক সিসা যাতে না প্রবেশ করে সেজন্য দিনে খুব বেশিবার লিপস্টিক না ব্যবহার করাই ভালো। আর হ্যাঁ। লিপস্টিক ব্যবহারের আগে সবসময় লিপবাম লাগান। প্রয়োজনে লেডফ্রি লিপস্টিক ব্যবহার করুন। সিসা থাকে এমন লিপস্টিক শিশুদের হাতে দেবেন না। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। এম.ফিল স্কলার, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।