অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

শিল্পসমালোচনা

থিয়েটার প্রযোজনা ‘পুণ্যাহ’:  মহাকাব্যিক ক্যানভাসের ট্র্যাজিক দৃশ্যকাব্য

ড. ইসলাম শফিক

প্রকাশিত: ১১:১৬ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২২ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ১১:২২ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২২ বৃহস্পতিবার

বাংলাদেশের অন্যতম থিয়েটার দল ‘নাট্যকেন্দ্র’ দীর্ঘ সাত বছর বিরতির পর মঞ্চে এনেছে দলের পঞ্চদশ থিয়েটার প্রযোজনা। নতুন এই নাট্যপ্রযোজনার নাম ‘পুণ্যাহ’। নাটকটি রচনা করেছেন বদরুজ্জামান আলমগীর। নির্দেশনা দিয়েছেন অধ্যাপক ড. ইউসুফ হাসান অর্ক। 

ইউসুফ হাসান একাধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক, নাট্যনির্দেশক, মঞ্চাভিনেতা ও সংগীত পরিচালক। থিয়েটার শিল্পমাধ্যমে ইউসুফ হাসান-এর নির্দেশনা মানে ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা করেন দুই বাংলার মঞ্চনাটকের দর্শক, নাট্যতাত্ত্বিক ও নাট্যসমালোচকবৃন্দ। বলতে গেলে সবাই এই নাট্যঅধ্যাপকের নির্দেশনাশৈলী দেখার জন্য বেশ আগ্রহের সাথে অপেক্ষায় থাকেন। ইতোমধ্যে ইউসুফ হাসান থিয়েটারের নির্দেশনা শিল্পে স্বতন্ত্র একটা সিগনেচার তৈরি করেছেন। ইউসুফ হাসান-এর থিয়েটার সিগনেচার দেখতেই বহু সাধারণ মানুষ নাট্যদর্শকে রূপান্তরিত হয়েছেন; এমনকি নতুন করে মঞ্চমুখী হয়েছেন বহু পুরোনো দর্শক। নাট্যসমালোচকগণ মনে করেন, প্রযুক্তির নয়াবিপ্লবের নিউ-মিডিয়ার দাপটের কালে ইউসুফ হাসান অর্ক থিয়েটারের স্বকীয় শক্তিকে প্রধান অবলম্বন করে নতুন রূপে থিয়েটারের পুনজ্জাগরণে নব্য-রেঁনেসার ডাক দিয়েছেন! তিনি বাংলাদেশের মঞ্চনাটকের বাঁকবদলের অন্যতম কারিগর হিসেবে ইতিহাসে সমাদৃত হবেন। ইউসুফ হাসান নির্দেশিত উল্লেখযোগ্য নাট্যপ্রযোজনা  ‘একলব্য আখ্যান’, ‘সাবয়াহ্ জ্যা থু’, ‘চাঁদ বণিকের পালা’,  ‘সীতায়ন’, ‘তোতাকাহিনী’, ‘ডালিম কুমার’, ‘কবি’, ‘নীলাখ্যান’, ‘মাতব্রিং’, ‘দেবদাস’, ‘বাত্য আমি মন্ত্রহীন’, ‘জেরা’, ‘ম্যান অব লা মাঞ্চা’, ‘গীতিচন্দ্রাবতী’, ‘দহনদয়িতা’, ‘জলপলকের গান’ এবং সর্বশেষ ‘পুণ্যাহ’। নির্মাণ নান্দনিকতায় প্রত্যেকটি প্রযোজনাই স্বতন্ত্র, পরিবেশনার আঙ্গিকগত বৈচিত্র্যময়তায় একেকটি প্রযোজনা অতিক্রম করেছে অপরটিকে। 

নাট্যকেন্দ্রের ‘পুণ্যাহ’ প্রযোজনা নিয়ে আলোচনার প্রাক্কালে দলের দীর্ঘ ৩২ বছরের অভিযাত্রায় প্রযোজিত নাটকগুলোর প্রাসঙ্গিক ভিত্তিমূলের ইতিহাস জেনে নেয়া প্রয়োজন। নাট্যকেন্দ্র ১৯৯০ সালের ১১ অক্টোবর ধানমণ্ডিতে অবস্থিত জার্মান কালচারাল সেন্টার-এ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে থেকে যাত্রা শুরু করে। তিন দশকের অধিককাল সময়ে সর্বমোট ১৪টি প্রযোজনা নাট্যকেন্দ্র সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেছে।‘বিচ্ছু’ নাট্যকেন্দ্র’র প্রথম প্রযোজনা। ১৯৯১ সালে মলিয়ের’র দ্যাট স্কাউড্রেল স্ক্যাপিঁ অবলম্বনে ‘বিচ্ছু’ নাটকের রূপান্তর ও নির্দেশনা দেন তারিক আনাম খান। গিরিশ কারনাড এর ‘তুঘলক’ দলের দ্বিতীয় প্রযোজনা।  তারিক আনাম খান-এর নির্দেশনায় ১৯৯২ সালে নাটকটি মঞ্চে আসে। ‘সুখ’ ও ‘জেরা’ দুটি প্রযোজনা তারিক আনাম খান এর নির্দেশনায় ১৯৯৩ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রযোজনা হিসেবে মঞ্চায়ন হয়। ১৯৯৫ সালে পঞ্চম প্রযোজনা গিরিশ কারনাড-এর ‘হয়বদন’ নাটকটির নির্দেশনা দেন তৌকির আহমেদ। ১৯৯৮ সালে নাট্যকেন্দ্রর  ষষ্ঠ প্রযোজনা আর্থার মিলার-এর ‘ক্রুসিবল’ মঞ্চে আসে, নির্দেশকের দায়িত্ব পালন করেন তারিক আনাম খান। মাসুম রেজা’র  ‘আরজ চরিতামৃত’ মঞ্চে আসে ২০০০ সালে;  দলের সপ্তম নাট্যপ্রযোজনা ‘আরজ চরিতামৃত’র নির্দেশক ছিলেন তারিক আনাম খান। অষ্টম প্রযোজনা ‘প্রতিসরণ’ ২০০৩ সালে মঞ্চে আসে ;  রচনা ও নির্দেশনায় তৌকির আহমেদ। থর্নটন ওয়াইল্ডার-এর 'দ্য ম্যাচমেকার' অবলম্বনে ‘প্রজাপতি’ নাট্যকেন্দ্রর  নবম প্রযোজনা  হিসেবে ২০০৪ সালে মঞ্চে আসে, নাটকটির ভাষান্তরসহ নির্দেশনা দিয়েছেন তারিক আনাম খান। শুভাশিষ সিনহা রচিত ‘ডালিমকুমার’ দলের ১০ম প্রযোজনা। ২০০৯ সালে মঞ্চে আসা এই নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। ১১তম প্রযোজনা হেনরিক ইবসেন-এর  ‘মৃত মানুষের ছায়া’; নির্দেশনায় তারিক আনাম খান; ২০০৯ সালের প্রযোজনা এটি। কার্লো গোলদোনি-এর ‘দ্য সার্ভেন্ট অব টু মাস্টারস’ অবলম্বনে ১২তম প্রযোজনা ‘দুই যে ছিল এক চাকর’ নাটকটি মঞ্চে আসে ২০১৩ সালে;  নাটকটির রূপান্তর ও নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করেন তারিক আনাম খান। ২০১৪ সালে মঞ্চে আসে  ১৩ ও ১৪  তম প্রযোজনা আলাদা আলাদা দুটি নাটক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘গাধার হাট’। দুটি নাটকই রূপান্তর ও নির্দেশনা দিয়েছিলেন তারিক আনাম খান। 

ঐতিহ্যবাহী এই নাট্যদলের নতুন প্রোডাকশনের জন্য পাণ্ডুলিপি বাছাই ও চূড়ান্তকরণ প্রক্রিয়া সমুদ্রমন্থনের মতো কঠিন কর্মযজ্ঞ। নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক ও নাট্যকেন্দ্রের  সদস্যবৃন্দ এবার সমুদ্রজল সিঞ্চন করে খুঁজে বের করেছেন ‘পূণ্যাহ’ নাটকের পাণ্ডুলিপি। ‘পুণ্যাহ’ নাট্যকেন্দ্রের  সদ্যজাত প্রযোজনা। সংখ্যার ধাপে এর অবস্থান ১৫তম এবং বর্তমানে ঢাকার নাটকপাড়ার সবচেয়ে আলোচিত মঞ্চনাটক। নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর-এর লেখা ‘পুণ্যাহ’ নাটকের পাণ্ডুলিপি নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক-কে আন্দোলিত করে। মহাকাব্যিক আখ্যানের এই নাট্যগল্পকে তিনি মঞ্চরূপ দেবার সিদ্ধান্ত নেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতেই বদরুজ্জামান আলমগীর-এর রয়েছে সদর্প বিচরণ। বদরুজ্জামান আলমগীর খুব বেশি নামজাদা, নামকরা, বিখ্যাত বা খ্যাতির চূড়ায় বসে থাকা কোনো নাট্যকার নন! তবে তাঁর  লেখনীর গভীরতা,  ভাব-দর্শন ও গ্রন্থনশৈলী তাঁকে খ্যাতির চূড়াতেই বসাবে। নাট্যকেন্দ্র প্রযোজিত ‘পূণ্যাহ’ নাটক দেখার পর যেকোন দর্শক নাট্যকারের পরিচয় ও কর্মপরিধি প্রসঙ্গে কৌতুহল করে জানতে চাইবেন। সেই কৌতুহল-তৃষ্ণা মেটাতে বক্ষ্যমাণ আলোচনায় ‘পূণ্যাহ’ নাটকের রচয়িতার পরিচয় ও কর্মপরিধি তুলে ধরা হলো- বদরুজ্জামান আলমগীর একাধারে কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, অনুবাদক ও নাট্যসংগঠক। পথনাটক বা খোলা নাটক নিয়ে তিনি বহু কাজ করেছেন। সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন নাট্যবিষয়ক পত্রিকার। নাট্যকার বদরুজ্জামান আলমগীর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরের ভাটিঅঞ্চলে ১৯৬৪  সালের ২১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগে পড়াশুনা করেন। প্রায় দুই যুগ পূর্বে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান; বর্তমানে তিনি ফিলাডেলফিয়ায় বসবাস করছেন। বদরুজ্জামান আলমগীর ১৯৯২ সালে প্রথম নাটক রচনা করেন। নাটকের নামটি বেশ চমকপ্রদ ‘নননপুরের মেলায় একজন কমলাসুন্দরী ও একটি বাঘ আসে’। লেখার ক্রমের দিক থেকে ‘পুণ্যাহ’ বদরুজ্জামান আলমগীর-এর দ্বিতীয় নাটক; ১৯৯৩/৯৪ সালে তিনি ‘পুণ্যাহ’ নাটকটি লেখা সম্পন্ন করেন। দেশে ও বিদেশের মঞ্চে তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য নাট্যাখ্যানগুলো হচ্ছে-‘আবের পাংখা লৈয়া’, ‘জুজুবুড়ি’,  ‘অহরকণ্ডল’,  ‘চন্দ্রপুরাণ’, ‘পানিবালা’,  ‘বাঘ’, ‘পরীগাঁও’, ‘এক যে আছেন দুই হুজুর’, ‘ডুফি কীর্তন’, ‘ভাসিয়া যায় লাল গেন্দাফুল’ ও ‘যোজনগন্ধা মায়া’।

কোভিড-১৯ মানব ইতিহাসে সবচেয়ে মরণঘাতী মহামারীতে পরিণত হয়েছিল। কোভিডোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিশ্বপ্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক থিয়েটারের স্বকীয় শক্তিতে কিছু কথা বলতে চান! থিয়েট্রিক্যাল ভাষায় যোগাযোগ ভাষ্য বিনির্মাণ করতে চান। বৈশ্বিক দুর্যোগ-মহামারীর ফলে পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতি, পরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনীতি, পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থা, স্বার্থসিদ্ধির কৌশল পরিবর্তনের কূটচাল, শাষণ-শোষণের আদিম প্রথার আধুনিকায়ন, ধর্মনীতির খোলসে অধর্মের চাষবাস, ধর্মজীবীদের মুখোশের আড়ালেও আরেক মুখোশের উন্মোচন প্রভৃতি বিষয় ‘পুণ্যাহ’ মঞ্চভ্রমণের মধ্যদিয়ে নাট্যনির্দেশক রূপক-সাংকেতিকভাবে দর্শকের কাছে পৌঁছানোর অভিপ্রায়ে নাটকটি নির্বাচন করেন। সভ্যতার আবর্তন-বিবর্তনের মোড়ে মোড়েই থমকে দাঁড়াতে হয়েছিলো মানুষকে। ঈদিপাসের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো 'কোন পথে যাই'। সেই দায় থেকেই ‘পুণ্যাহ’ নিয়ে কাজ করার তাগিদ অনুভব করেন নির্দেশক। নাটকের বিধ্বস্ত কাকরগাছি জনপদ একটি সাদা সাইক্লোরামা মাত্র!

‘পুণ্যাহ’  শব্দের আভিধানিক অর্থ পুণ্যকর্ম সম্পাদনের পক্ষে শুভ দিন। জমিদার কর্তৃক প্রজাদের নিকট হতে নববর্ষের খাজনা আদায়ের বার্ষিক বন্দোবস্তের একটি উৎসব। এটি রাজস্ব আদায় এবং বন্দোবস্ত সংক্রান্ত বিষযের প্রাক-ব্রিটিশ সময়ের পদ্ধতি। ‘পুণ্যাহ’ শব্দটিকে নাট্যঘটনার সাথে ট্র্যাজিক সংশ্লেষ ঘটিয়ে নাট্যকার রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন। ‘পুণ্যাহ’ নাটকের গল্পটি সত্যঘটনা নয়, তবে সত্যমূলক। কাকরগাছি গ্রাম হঠাৎ একদিন ভয়াবহ ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। ঝড় থেমে গেলেও থামে না গ্রামবাসীর মনের জ্বর। ঝড়ের তাণ্ডবে পুরো গ্রামটি একটি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। সক্রিয় উঠে কতিপয় মুখোশধারীর দল, যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় বর্তমান। গ্রামের মানুষের পাপ পুণ্যের হিসেব নিকেশের হিংস্র থাবায় বিপর্যস্ত হয় গোটা জনপদ। সংস্কারের জালে আবদ্ধ হয় জনপদ থেকে জনপদ, সর্বোপরি গোটাবিশ্ব। বিধ্বস্ত জনপদের মানুষের অস্তিত্বের সংকট ও সংগ্রামের এই চিত্র যেন কাকরগাছি গ্রামের প্রতীকী অনুরণন!

অতিসংস্কার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনপদবাসী অভিশপ্ত দুর্যোগের নেপথ্যের পাপ খুঁজেতে থাকে মসজিদের ঈমাম মাওলানা খায়রুল বাশারের পূণ্যময় নির্দেশে। কাকরগাছি গ্রামের রাতে বয়ে যাওয়া ঝড়কে কেন্দ্র করে সাজানো হয়েছে গল্পের সুবিশাল ক্যানভাস। নাম না জেনেও নাট্যদৃশ্য শেষ হবার সাথে সাথে মনে হবে, নাটকটি যিনি লিখেছেন তিনি নিঃসন্দেহে কিংবদন্তি লেখকদের একজন। নির্দেশক সুনিপুণ দক্ষতায় দৃশ্যকাব্যের ভাষার বয়ান করছেন নাট্যকাহিনী। ‘পুণ্যাহ’ পরিবেশনায় নিরাভরণ মঞ্চে অভিনয় ও সুরসঙ্গীত এই প্রযোজনার প্রাণভোমরা। নন-লিনিয়ার গল্পকথনে মহাকাব্যিক ট্র্যাজিক উপাখ্যানের স্বর্গীয় দৃশ্যকাব্য বিনির্মাণ করেছেন নির্দেশক। অভিনয়, বর্ণনা, সংলাপ, সঙ্গীত, কোরিওগ্রাফ, আলোক রঙ সহযোগে বিবৃত গল্পকথনের যথার্থ প্রয়োগবিন্যাসে ভিন্ন ভিন্ন অনুঘটনা অভিন্ন রূপে মূর্ত হয়ে ওঠেছে থিয়েটারের সুবিশাল ক্যানভাসে। তিনজন বর্ণানাকারী নাট্যকাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যান। বর্ণানাত্ত্বক নাট্যাভিনয় রীতির আশ্রয়ে শব্দ-বাক্য-ভাবের উচ্চারণ প্রকাশ ও দেহভঙ্গিতে তিনজন কথক বা ন্যারেটরকে দর্শক অভিন্নরূপে খুঁজে পায়। নাট্যঘটনা বয়ানকারীর ভূমিকায় সংগীতা চৌধুরী, হাবিব মাসুদ ও ইবতেসাম মাহমুদ শ্যামা- এই তিনজনের অসাধারণ অভিনয় ও বর্ণনায় চিত্রকল্প সৃজন পুরো প্রযোজনাকে শক্তগাঁথুনীতে মজবুত ভীতের উপর প্রতিষ্ঠা করেছে।

এক রাতে বারো খুন ও তেরো নম্বর সামাদের খুনী  জেলফেরত ডাকাত সর্দার জঙ্গুর মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাগৈতিহাসিক পৌরুষত্ব, সেই আদিমতা। ডাকাত সর্দার জঙ্গু চরিত্রে ইকবাল বাবু’র অসাধারণ অভিনয় দর্শকহৃদয়ে কম্পন তৈরি করে। মর্তুজি নিষ্পাপ চপলতা সমাজসৃষ্ট সমকালের নারী প্রতিনিধির  রঙ-তুলিতে আঁকা মানবছবি। মসজিদের ঈমাম মওলানা খায়রুল বাশারের চরিত্রে থাকা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে ধর্মের জুজুর ভয় দেখিয়ে পরিশুদ্ধির নামে নিজ স্বার্থসিদ্ধিতে  নিয়োজিত থাকেন। ঝড়ে তছনছ গ্রাম। কার পাপে এমন ঘটলো? পাপ না হলে তো খোদার গজব পড়ে না। মওলানা খায়রুল বাশার সাহেব যে পাপ করে তার কোনো সুরাহা হয়না। কিন্তু অন্যায়ভাবে আম্বিয়াকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়। এ কেমন নিষ্ঠুর বাস্তবতা! না-কি এটি নিষ্ঠুর নিয়তি! সিলেটের অঞ্চলিক ভাষায় মওলানা খায়রুল বাশারের চরিত্রে ঝুনা চৌধুরীর অভিনয় এতোটাই জীবনলগ্ন যে তা দর্শকের চোখে অভিনয় মনে হয়নি, সত্যি মনে হয়েছে! নাম-পরিচয়বিহীন রঘু ঝড়ের মাঝে ভেসে আসা ছেলেটির আশ্রয় হয়েছিল ভাগ্যকূলের কাছে, যে কিনা সামান্য স্নেহ আর নামের বিনিময়ে বাবু হয়ে উঠতে পেরেছিল। ভাগ্যকূলের প্রয়াণে রঘুর কান্নার দৃশ্য  দর্শকের মর্ম স্পর্শ করে। অসহায় রঘু  আশ্রিত পিতা ভাগ্যকূলের মৃতদেহের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য বিশ্বনাথ চণ্ডালের কাছে যায়। বিশ্বনাথ চণ্ডাল সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের বিষয়টি সামনে আনেন। উচ্চারণ করেন কঠিন এক সত্য বাস্তবতা- “আমি তো তোর বাপেরে পুড়ায়া দিমু। তুই কি আমারে পুড়াইবি?”

নাট্যগল্পের মূল চরিত্র আম্বিয়ার  জীবনের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজবাস্তবতার এক নির্মম চিত্র। তৈয়বে আলীরা সকল অপকর্ম করে আজও আমাদের সমাজে নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তৈয়ব আলী চরিত্রে শহিদুল্লাহ সবুজের অভিনয় দর্শক দীর্ঘসময় মনে রাখবে। তৈয়বেরা গ্রাম ও সমাজকে পাপমুক্ত করতে আম্বিয়াকে ব্যভিচারিণী চিহ্নিত করে পাথর নিক্ষেপের অন্যায়দৃশ্যটি আমাদের সমাজের আজও বিদ্যমান। নিজেদের স্বার্থরক্ষায় বটকৃষ্ণ কবিরাজ-মৌলভী- তৈয়ব আলীরা মুহূর্তে হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে এক সারিতে দাঁড়ায়¾ “এক সুতায় মেপে খুঁজে বের করেছি এই গায়ের পাপ এবং পাপী।” সামজের চোখে পাপীরূপে চিহ্নিত আম্বিয়াকে স্কুলের মাঠে সমাবেত সকলের উপস্থিতিতে শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে গ্রামকে পাপমুক্ত করার অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। আম্বিয়ার প্রতি অন্যায় মিথ্যা একতরফা অভিযোগ দিয়ে একপাক্ষিক বিচারের মাধ্যমে যে প্রহসন করা সেই বিষয়টিকেই নাট্যকার রূপকার্থে ‘পুন্যাহ’ অভিধায় অভিহিত করেছেন। আম্বিয়া চরিত্র অভিনয় করছেন মানামী ইসলাম কনক। গল্পের মূল চরিত্রে থাকা আম্বিয়ার মাধ্যমে আমরা দেখতে পেয়েছি অনাচারের এক অকল্পনীয় নির্মম দৃশ্য। মহাকালের সামনে একবিন্দু আম্বিয়া! একবিন্দু আম্বিয়া এক মহাসমুদ্র গভীর বেদনা রচনা করতে পারে! আত্নহনন করে সমাজ ও বিচারব্যবস্থার প্রতি তীব্র ঘৃণা ব্যক্ত করেন আম্বিয়া। বিষপানে আত্মহননকালে মৃত্যুকষ্টে আম্বিয়া পেচ্ছাব করে দেয়। পেচ্ছাবের জলে আম্বিয়া তার  কথিত প্রেমিক লম্পট তৈয়ব আলীর ঘৃণ্যচেহারা দেখতে পায়। আম্বিয়া ভাবে¾ “পেচ্ছাবের জলে হলেও তৈয়ব আলী তার মুখ ধুয়ে ফেলুক, নইলে রক্তের দাগ বসে যাবে যে!” অভিনয়-সঙ্গীত-বর্ণনা অপূর্ব ত্রয়ী মেলবন্ধনের একক শিল্পপ্রকাশ মানামী ইসলাম কনক-এর অভিনয়শৈলী। আম্বিয়া চরিত্র রূপায়নে মানামী ইসলাম নিজেকে নিষ্ঠাবান হিসেবে প্রমাণ করেছেন। থিয়েটার শিল্পের ‘গাহনাভিনয়’-এর জন্য ঢাকার মঞ্চশিল্পে মানামী ইসলাম কনক একটি আর্শিবাদ-এর নাম। ‘পুণ্যাহ’ প্রযোজনার অভিনয়শিল্পীরা একেকজন স্ফূর্ত রঙের ফোয়ারা, প্রতি মুহুর্তে নব নব রূপে অভিভূত করছেন দর্শকদের। বলা যায়¾ নাট্যকেন্দ্রের একদল শক্তিশালী দক্ষ অভিনয়শিল্পীর নিবিঢ় অনুশীলনের ফসল এই যুথবদ্ধ নান্দনিক পরিবেশনা। নেপথ্যে ছিলেন ইউসুফ হাসান অর্ক দ্রোণাচার্যরূপী একজন যোদ্ধা-শিক্ষক-প্রশিক্ষক-নির্দেশক। এই নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করছেন- ঝুনা চৌধুরী, ইকবাল বাবু, শেখ মাহবুবুর রহমান, রামকৃষ্ণ মিত্র হিমেল, সাইফুল, হাবিব মাসুদ, নুরে আলম নয়ন, সংগীতা চৌধুরী, ইবতেসাম মাহমুদ শ্যামা, মনামী ইসলাম কনক, শহিদুল্লাহ সবুজ, কৌশিক বিশ্বাস, সাজিদ উচ্ছ্বাস, এস আই রাজ, ইফফাত আরা, লিনসা, ঐন্দ্রিলা, তন্ময়, রুমি প্রমুখ। নাটকটির প্রযোজনা উপদেষ্টা তারিক আনাম খান এবং প্রযোজনা অধিকর্তা হিসেবে রয়েছেন ঝুনা চৌধুরী। আলোক পরিকল্পনা করেছেন অম্লান বিশ্বাস, পোশাক পরিকল্পনা করেছেন সাজিয়া আফরিন, প্রপস পরিকল্পনায় আছেন রেফায়েত আরা এবং কোরিওগ্রাফি করেছেন প্রান্তিক দেব।  মঞ্চ ও সংগীত পরিকল্পনা করেছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। প্রশান্ত স্বর্ণকার, নির্ঝর অধিকারী, রেফায়েত আরা, ইউসুফ হাসান মঞ্চেভূমিতে সর্বদা আসীন চারজন সংগীতশিল্পীর সরাসরি গান, সুর, লয়, কোরাস, হামিং, বাঁশি, বাদ্য সঙ্গত এই ট্র্যাজিক নাট্যপ্রযোজনাকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যান। বিশেষ করে ইউসুফ হাসান-এর গান ও নির্ঝর অধিকারীর বাঁশির যুগলমিশ্রণের আবহসঙ্গীত স্বর্গীয় সুর রচনা করে!

অভিনয়কালীন স্পেসের ব্যবহার, শুধু মঞ্চভূমি নয়, প্রেসেনিয়াম লাইন ভেঙ্গে পুরো মিলনায়তনকে অভিনয়ভূমিতে রূপান্তর করে কোরিওগ্রাফ ও আলোক পরিকল্পনা করার ফলে নাট্যঘটনাটিকে দর্শকের আপন মনে হয়েছে, নিজের মনে হয়েছে। দর্শক নিজেকে নাটকের অংশ হিসেবে মেনে নিয়ে নাট্যকাহিনীর বিধ্বস্ত কাকরগাছি জনপদের একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে বিশ্বাস করেছে। অভিনয়, সংগীত পরিকল্পনা কোরিওগ্রাফ, আলোক পরিকল্পনা ও ব্যবহার, পোশাক পরিকল্পনা, সাজেসটিভ সেট, প্রপস-এর ব্যবহার,  ভিডিও প্রজেকশন সবকিছুর নিপুন প্রয়োগ ও পরিমিত ব্যবহারের কারণে নাটকটি মেদহীন একটি স্মার্ট প্রযোজনার  মর্যাদা লাভ করেছে।

থিয়েটারের শিল্পসমালোচনা লিখতে বসে প্রচলিত নিয়ম-নীতি অনুসরণ থেকে সরে এসেছি। কিছু ভালোলাগা, ক্ষাণিকটা মন্দবলা, কিছু প্রশংসা করা, কিছু স্তুতিকরা আর প্রযোজনার সামান্য কয়েকটি ক্রটি-বিচ্যুতি উল্লেখ করে ফরমেটেড আলোচনা করা। শিল্পসমালোচক হিসেবে এতোক্ষণ এই বলয়ের বাইরে কথা বললাম। ক্রটি-বিচ্যুতির অন্ধকার দিক না খুঁজে আলো নিয়ে কথা বলি, যা পরবর্তীতে প্রযোজনার জন্য কাজে লাগবে। বেশ কয়েকটি  দৃশ্যান্তরে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে দর্শক আলো খুঁজতে থাকে। টানটান উত্তেজনার গল্পটিও ক্ষণিক সময়ের জন্য অন্ধকারে চলে যায়। আশা করছি দৃশ্যকাব্যকে আলো-আঁধারীতেই রাখা যাবে। টাকা উড়িয়ে দিয়ে পরবর্তীতে নাট্যের কথক টাকা কুড়িয়ে কুড়িয়ে বর্ণনা করেন,  যা নাট্যগতিকে মন্থর করে দেয়। মঞ্চেভূমিতে টাকা না উড়িয়ে কথক বা অভিনেতা বর্ণনায় চিত্রকল্প তৈরি করলে দর্শক নিজের কল্পনায়সেই দৃশ্য এঁকে নেবেন! এতোটুকু আস্থা দর্শকের উপর করা যেতে পারে। ভিডিও প্রজেকশনের আলো অভিনেতাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সাইক্লোরামায় বড় ছায়া তৈরি করে এবং ভিডিও কেনটেন্ট দেখতে তখন দর্শকের অসুবিধা হয়। মঞ্চের সম্মুখভাগ থেকে ভিডিও প্রজেকশনের জন্য ব্যবহৃত ল্যাপটপের মনিটরের আলো প্রথম দিকের দর্শকসারিতে সমস্যা তৈরি করে, এতে মনোযোগ বিঘ্নিত হয়। প্রত্যাশা করছি নাট্যসামালোচক,  নাট্যতাত্ত্বিক, নাট্যগবেষক, সম্মানিত দর্শকবৃন্দ সকলের গঠনমূলক সমালোচনা ও পর্যালোচনা গ্রহণ-বর্জনের মধ্যদিয়ে ‘পুণ্যাহ’ প্রযোজনা আরও শিল্পসমৃদ্ধ হবে, আরও পূর্ণতা পাবে। 

মিলনায়নের ‘পুন্যাহ’ নাটকটি দেখতে আসা দর্শকবৃন্দ নির্দেশকের সৃজনবুননের জাদুকরী মায়ায় প্রবেশ করেন। দর্শক গল্পে নিমজ্জিত হয়,  নাট্যস্নাতক হয়ে থিয়েটারের আলোতে দর্শক অবগাহন করেন, ভাব বিমোক্ষণে ডুবেন-ভাসেন, কাঁদেন-হাসেন, করতালি দেন, নিশ্চুপ থাকেন, দার্শনিক অভিপ্রায়ে নিজেকে প্রশ্ন করেন, নিজের দিকে তিনি তাকান, নিজেকে স্পর্শ করেন, কষ্ট পান, বেদনার্ত হন, চোখ মুছেন বারবার নিজের অজান্তে। আমি দর্শক হিসেবে নির্দেশনাশৈলীর সুনিপুন উপস্থাপনায় ভুলে যাই নিজের অবস্থান। মনে হয়¾ আমি একটি বিশাল ক্যানভাসের চলচ্চিত্র দেখছি, আবার মনে হয় আমি গল্পপাঠ করছি, কোনো কোনো সময় মনে হচ্ছিল মহাকাব্যের মহাট্র্যাজেডির পাতা উল্টে লাইনের পর লাইনের অক্ষর-বর্ণে আঙ্গুল রেখে চরিত্রগুলোর কষ্টগুলো ভাগ করে নিচ্ছি। মনে হচ্ছিল¾ চিত্রকলায় গল্প দেখছি! আবার মনে হচ্ছিল¾ এসব আমি কিছুই দেখছি না, আমি কাকরগাছি গ্রামে ঘটমান বাস্তবতার মধ্যদিয়ে আমি নিজে একটি চরিত্র হয়ে উঠছি! মনে হচ্ছিল¾ আমি গল্পের ঘটনার একমাত্র সাক্ষী। পুরো মিলনায়তন একটি কাকরগাছি গ্রামের ইকোধ্বনি; আর আমি সেই বিরুদ্ধসময়ের একমাত্র নিরব দর্শক। প্রতিটি দর্শকের চিত্রকল্পে-মগজে-মননে নির্দশক অত্যন্ত সুকৌশলে সেই বীজ বুনে দিয়েছেন নাটকের শুরুতে। নাটকের শেষান্তে প্রতিটি দর্শক নিজেকে খুঁজে পায় কবিরাজ-ঈমাম পোশাকী চরিত্রের ভেতরে অথবা কঙ্করহাতে তৈয়ব আলীদের দলে! ‘পুণ্যাহ’ নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক’র এক অনবদ্য মহাকাব্যিক সৃষ্টি! বাংলাদেশের থিয়েটারের দর্শক ও ইতিহাস একদা গৌরব ও ঈর্ষা করবে ‘পুণ্যাহ’ প্রযোজনার সময়কালকে!সর্ববিচারে ‘পুণ্যাহ’ সমকালে ঢাকার মঞ্চে আমার দেখা সেরা থিয়েটার প্রযোজনা। নাট্যকেন্দ্রের এই মঞ্চপ্রযোজনা বাংলাদেশের চলমান থিয়েটারচর্চার বাঁকবদলের অন্যতম শিল্পশক্তি হিসেবে অবদান রাখবে।

ড. ইসলাম শফিক: গণমাধ্যম গবেষক ও পরামর্শক।
[email protected]