অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিশ্ব বদলে দেয়া ১৬ শিশু, আছে বাংলাদেশের সাদাতও

আতিক উল্লাহ

প্রকাশিত: ১২:১২ এএম, ২৩ নভেম্বর ২০২০ সোমবার   আপডেট: ০৪:২৭ পিএম, ২০ এপ্রিল ২০২১ মঙ্গলবার

তরুণদের সাইবার বুলিং বা অনলাইনে হুমকি ও হয়রানিমূলক আচরণ সম্পর্কে শেখাতে ‘সাইবার টিনস’ নামের একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছিলো নড়াইলের ছেলে সাদাত রহমান। মাত্র ১৭ বছরের তরুণ এই সাদাত। যে বয়সে তার নিজেরই তারুণ্যের তেজে হয়তো কোনো ভুল করে বসারই সুযোগ রয়েছে, যেমনটা অনেকরই হয়, সেই বয়সে সে বরং নেমেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে। তবে তা কোনো সম্মুখ সংঘাতের পথে নয়, বরং এমন এক পদ্ধতিতে যা তাকে, যে জগতে অন্যায়টি ঘটছে, সে জগতেই দিয়েছে প্রতিকারের সুবিধা। সাদাত রহমানের এই সাইবার টিনস অ্যাপের কথা এখন বিশ্বের অনেকেরই জানা। কারণ এই অ্যাপটি বানিয়েই সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার জয় করে এনেছে সাদাত রহমান। 

যে পুরস্কারের আরেক নাম ‘কিডসরাইটস চেইঞ্জমেকার অ্যাওয়ার্ড’। 

সাইবার টিনস এর সাহায্যে তরুণরা তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করে স্বেচ্ছাসেবী একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গোপনে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ দায়ের করতে পারে। আর সে অভিযোগ পেয়ে সাইবার টিনসের সদস্যরা অর্থাৎ সাদাত ও তার বন্ধু সহযোগী স্বেচ্ছাসেবীরা পুলিশ বা সমাজকর্মীদের কাছে যায় এবং বুলিংয়ের ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা দেয়।

এই অ্যাপটি চালু হওয়ার পর অনলাইনে হয়রানির শিকার তিন শতাধিক তরুণ সহায়তা পেয়েছে এবং অনলাইনে শিশুদের উপর যৌন হয়রানির দায়ে প্রাপ্তবয়স্ক আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সব অর্জনই সাদাত রহমানকে এনে দিয়েছে মর্যাদাপূর্ণ আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার। যার মূল্যমান ১ লাখ ইউরো। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ১ কোটি টাকার কাছাকাছি। আর এই অর্থ দিয়ে সাদাত তার তৈরি অ্যাপটিকেই আরো উন্নত করতে চায়। এবং তার সেবার পরিধি বিস্তার করতে চায়। 

বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান ইন্টারনেট ব্যবহারের সাথে সাথে বাড়ছে সাইবার বুলিং। তবে এই ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে কিশোর-কিশোরীরা। মানসিকভাবে শক্তিশালী না হওয়ায় অনেক টিনেজার আত্মহত্যা পর্যন্ত করেছে। তাই সাদাত রহমানের উদ্ভাবনের গুরুত্ব অত্যাধিক।
 
আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার নেওয়ার সময় সাদাতের বক্তব্যই জানিয়ে দেয় কোথা থেকে শুরু-

“সাইবার বুলিং-এর শিকার হয়ে দেশে ১৫ বছরের এক কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনা জানতে পেরে এমন একটি অ্যাপ তৈরির ভীষণ তাগীদ বোধ করি”।

অপর একটি উক্তি বলে দেয় গন্তব্য কোথায়- 

"সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে লড়াই অনেকটা যুদ্ধের মতো, এবং এই যুদ্ধে আমিও একজন যোদ্ধা। যদি সবাই আমাকে সমর্থন করে যায়, তবে একসাথে আমরা সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে জয়ী হব।"

সাদাতের মতো এমন সুবিবেচক ও লড়াকু শিশুদেরই মূলত দেয়া হয় কিডসরাইট চেইঞ্জমেকার অ্যাওয়ার্ড। যারা, তাদের কোনো না কোনো কাজ দিয়ে সত্যিকার অর্থেই পরিবর্তন এনেছে পৃথিবীতে। ইউনিসেফের সংজ্ঞামতে ১৮ বছরের কম বয়স্করা শিশু। এই বয়সের শিশুরাই পায় এই আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার। 

সাদাতের সঙ্গে আর যারা এই পুরস্কার পেয়েছে তাদের কথায় যাওয়ার আগে কিডস রাইডস ফাউন্ডেশন ও পুরস্কারটি সম্পর্কে একটু ধারনা নেওয়া যাক।

কিডস রাইটস ফাউন্ডেশন নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যার সদরদফতর আমস্টারডামে। শিশুদের সহায়তা ও অ্যাডভোকেসি করাই এর কাজ। ফাউন্ডেশনটি ২০০৩ সালে মার্ক ডুলার্ট এবং ইনেগ ইকিংক প্রতিষ্ঠা করেন।

সংস্থার লক্ষ্য হল বিশ্বজুড়ে অসহয়াত্বে পড়া শিশুদের সহায়তা ও ক্ষমতায়ন করা, ছোট-ছোট স্থানীয় প্রকল্পগুলোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করা এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে শিশুদের অধিকারের জন্য সচেতনতা বাড়ানো।

সে লক্ষ্য অর্জনে ২০০৫ সাল থেকে একটি বার্ষিক পুরস্কার দেয়া চালু করে ফাউন্ডেশনটি। শিশুদের অবস্থার উন্নতি, অধিকার আদায় ও সমস্যা মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য দেয়া হয় এই পুরস্কার। 

এ পর্যন্ত ১৬ শিশু বা প্রতিষ্ঠান এই পুরস্কার পেয়েছে। ২০১৮ সালে পুরস্কারটি পায় একটি আন্দোলন আর ২০১৯ সালে যৌথভাবে পুরস্কার পায় দুজন শিশু। সর্বশেষ বাংলাদেশের ১৭ বছরের তরুণ, নড়াইলের সাদাত রহমানের নামও যোগ হয়েছে সেই তালিকায়। 

** মেট্রোরেলের আদ্যোপান্ত, ডেডলাইন জয়ে ছুটছে কর্তৃপক্ষ

বিজয়ীরা আর্থিক পুরস্কারের পাশাপাশি পায় একটি স্ট্যাচুয়েট। স্ট্যাচুয়েটে দেখা যায় একটি গোলাকার বল ঠেলে সামনে নিয়ে যাচ্ছে শিশু। এর মাধ্যমে বুঝানো হয় ‘দেখুন একটি শিশু পৃথিবীকে কীভাবে গতিময় করে তুলছে’। 

পৃথিবীকে সামনে নিয়ে যাওয়া এই ১৭ জনের তালিকায় আছে নোবেল বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই ও পরিবেশ আন্দোলনে আত্মনিয়োজিত গ্রেটা থানবার্গের মতো নামও। 

২০০৫ এনকোসি জনসন (১২)

প্রথমবারের মতো এই পুরস্কার পায় দক্ষিণ আফ্রিকার এনকোসি জনসন। এইডস আক্রান্ত শিশুদের রক্ষায় কাজ করেছিলো এনকোসি। তাদের জন্য তৈরি করেছিলো একটি কেয়ারহোম।   এইচআইভি-এইডসের সচেতনতায় ডারবান এইডস কনফারেন্সে লক্ষ মানুষের সামনে বক্তৃতা করছিলো এই শিশু। কিন্তু পরে সেই এইচআইভি-এইডসেই তার মৃত্যু হয়। শিশুটি জানতো না জন্ম থেকেই সে এইচআইভি পজিটিভ। কারণ তার মায়েরও জানা ছিলো না এনকোসির জন্মের আগে থেকে তিনিও ছিলেন পজিটিভ। পুরস্কার দেয়ার সময় এনকোসি আর বেঁচে ছিলো না। তার নামেই নামকরণ হয় স্ট্যাচুয়েটটির। আর প্রথম পুরস্কারটি (মরনোত্তর)তাকেই দেওয়া হয়।

২০০৬ ওম প্রকাশ গুর্জার (১৪)

এ বছর পুরস্কারটি পায় ভারতের ওম প্রকাশ গুর্জার। ভারতের সরকারী স্কুলগুলোতে বিনা খরচায় শিক্ষাদান ও শিশু অধিকার রক্ষায় তাদের জন্ম নিবন্ধনের আন্দোলনের জন্য পরিচিত ছিলো গুর্জার। পুরস্কার পাওয়ার পর গুর্জার তার এক বন্ধুকে নিয়ে ‘পাঠশালা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করে যেখানে শিশুদের সান্ধ্যকালীন শিক্ষার ব্যবস্থা ছিলো। ওম প্রকাশ যখন পুরস্কারটি পায় তখন তার বয়স ছিলো ১৪। আর এক সময় নিজেও ছিলো অবৈধ শিশুশ্রমের শিকার। 

২০০৭ ঠান্ডিওয়ে চামা (৮)

জাম্বিয়ার ঠান্ডিওয়ে চামা পুরস্কার পায় এই বছর। ঠান্ডিওয়ের তখন মাত্র ৮ বছর বয়স যখন এইডসে আক্রান্ত হয়ে তার স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক মারা যান। ফলে বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুলটি। খেলার বয়সেই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে ঠান্ডিওয়ে। শিক্ষার অধিকার আদায়ে তার ক্লাসের ৬০ জন  শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করে লংমার্চ। এটিই তার হাতে এনে দেয় শিশু শান্তি পুরস্কার। পুরস্কার পাওয়ার পরেও থামেননি চামা। শিশুদের এইডস সম্পর্কে সচেতন করতে একটি বই লিখেন যার নাম ‘দ্য চিকেন উইথ এইডস’।

২০০৮ মায়রা অ্যাভেলর নেভেস (১৫) 
চতুর্থ বছরে পুরস্কারটি যায় ব্রাজিলের মায়রা অ্যাভেলর নেভেসের হাতে। রিও ডি জেনেরোয় সবচেয়ে গরীব ফাবেলাস বস্তিতে মায়রার জন্ম। সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ, সংঘাতও হত বস্তিটিতে। স্থানীয় পুলিশ ও মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রায় সময় স্বশস্ত্র সংঘর্ষ হতো। জোর করে শিশুদেরও যুক্ত করা হতো সংঘর্ষে। 
একসময় সেই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়। বস্তিতে ঢুকতে স্বশস্ত্র চেকপয়েন্ট পার হতে হতো। ফলে বন্ধ হয় সেখানকার স্কুল এবং হাসাপাতাল। বস্তিটির সবাই তখন এই অবস্থাকেই গ্রহণ করে নেন। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেনি মায়রা। 
তার সহপাঠি ও কিছু বন্ধুদের নিয়ে শুরু করে ‘মার্চ ফর পিস’। তাদের দাবি ছিল স্কুল চলাকালীন সময়ে ও ছেলে-মেয়েদের আসা যাওয়ার সময় কোন গোলযোগ সৃষ্টি না করা। সাড়াও মেলে তার মার্চে। চালু হয় স্কুল। মায়রার বয়স তখন মাত্র ১৫। 

** ধারাবাহিক আত্মকথা । শংকিত পদযাত্রা । খ ম হারূন । পর্ব ৭

২০০৯ বারুয়ানি এনডুমে (৭)
এই বছর পুরস্কার পায় তানজানিয়ার বারুয়ানি এনডুমে। সাত বছর বয়সে কঙ্গো থেকে তানজানিয়া পাড়ি দেয়ার সময় সে হারায় তার মা আর ছোট ভাইকে। শেষ পর্যন্ত শরণার্থী শিবিরে পৌছালেও মনে থেকে যায় গভীর ক্ষত। এক পর্যায়ে ক্যাম্পের এক অনুষ্ঠানে শুনতে পায় শিশুর অধিকারের বিষয়টি। তারপরই শুরু করে একটি রেডিও শো। নাম ‘চিলড্রেন ফর চিলড্রেন’। 
যার মাধ্যমে ২০ শিশু রিপোর্টারসহ শরণার্থী শিবিরের সমস্যাগুলো তুলে ধরা শুরু করে। তাদের প্রচেষ্টায়  প্রায় ৫৫ হাজার শিশুর শিক্ষার অধিকার নিশ্চত করেন। ৪ হাজারের উপর শিক্ষার্থী পায় ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার। এবং শরণার্থী শিবিরে শিশুদের জন্য গড়ে তোলা হয় আলাদা খেলার মাঠ। 

২০১০ ফ্রান্সিয়া সাইমন (১৬)

ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের ফ্রান্সিয়া সাইমন এই বছর পুরস্কারটি জেতে। হাইতি থেকে পালিয়ে আসা অনেকে থাকতো তাদের গ্রামে। মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হতে ‍গিয়ে জন্মসনদ নামক বিষয়টির সাথে পরিচিত হয় ফ্রান্সিয়ার। তখন তার বয়স ১৬। হাইতিয়ান শিশুরা কীভাবে পড়বে সেটা মাথায় আসার সাথে সাথেই শরণার্থীদের ঘরে ঘরে যেতে থাকে সে। সব শিশুর জন্মসনদ করতে কাজে নেমে পড়ে। কিন্তু হাইতিয়ান হওয়ায় শিশুদের জন্মসনদ দিচ্ছিলো না সরকার। পরে তার উদ্যোগেই শিশুদের জন্মসনদ ছাড়াই স্কুলে ভর্তির সুযোগ দেয় ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্রের সরকার।  
২০১১ মিশেল মাইক্রফ্ট (৯)
এবছর পুরস্কার পায় দক্ষিণ আফ্রিকার শারিরীক প্রতিবন্ধী মিশেল মাইক্রফ্ট। ৯ বছর বয়সে একটি মোটরচালিত হুইলচেয়ারের আশায় তার এক বন্ধুকে নিয়ে ক্যাম্পেইন করে মিশেল। মাত্র সাত সপ্তাহেই নিজের উদ্দেশ্য পূরণ হলেও মাথায় ঢুকে যায় তার মত আরও প্রতিবন্ধীদের কথা। তারপর বাকিদের জন্যেও শুরু করে ক্যাম্পেইন। যার মাধ্যমে প্রায় এক হাজার প্রতিবন্ধীকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করে মিশেল। 

২০১২ কেস ভলদেজ (১৩)
ফিলিপাইনের ১৩ বছর বয়সি কেস ভলদেজ এবছর জিতে নেয় আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার। বাবা তাদের ছেড়ে যাওয়ায় মাত্র ২ বছর বয়সে ময়লা কুড়িয়ে টাকা কামাতো কেস। চার বছর বয়সে ছেড়ে যায় ঘর। কিছুদিন পরই পায়ে মারাত্তক আঘাত পায় কেস। এক সমাজ কর্মী তাকে হাসপাতালে নিলে জীবনে প্রথমবারের মত পর্যাপ্ত খাবার আর পোশাক পায় সে। 
তারপর থেকেই পথশিশুদের জীবন বদলানোর আশায় কাজ করতে থাকে। তার সপ্তম জন্মদিনে পথশিশুদের জুতা উপহার দেয়। যাতে তার মতো কারও পা কাটা না যায়। এরপর প্রতিবছরই এরকম নানা উপহার দিতে থাকে শিশুদের। কখনও খাদ্য, কখনও পোশাক বা কখনও অন্য কিছু। এক পর্যায়ে তার উপহারের নাম দেয়া হয় ‘গিফ্ট ফর হোপ’। এভাবে হাজার হাজার পথশিশুকে সাহায্য করে কেস ভলদেজ।

২০১৩ মালালা ইউসুফজাই (১২)

এবছর পুরস্কার পায় পরবর্তীতে নোবেল জয়ী পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই। মালালার জন্ম পশ্চিম পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে। যেখানে একসময় মেয়েদের স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয় তালেবানরা।  ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে মালালা বিবিসির জন্য ছদ্মনামে একটি ব্লগ লিখতো, যেখানে তালিবান শাসনের অধীনে তার জীবন ও সোয়াত উপত্যকায় মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তার মতামত তুলে ধরতো। পরের বছর গ্রীষ্মকালে সাংবাদিক অ্যাডান এলিক তার জীবন নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের জন্য একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন।  
২০১২ সালের ৯ অক্টোবর, স্কুলের বাসে একজন বন্দুকধারী তাকে চিহ্নিত করে তিনটি গুলি করে, যার মধ্যে একটি তার কপালের বাঁ দিক দিয়ে ঢুকে চামড়ার তলা দিয়ে তার মুখমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে কাঁধে প্রবেশ করে। পরবর্তী বেশ কয়েকদিন অচৈতন্য ছিলো মালালা। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হলে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য বার্মিংহ্যাম শহরের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। এর পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকার আন্দোলনকর্মী ডেসমন্ড টুটু তাকে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন। আর মালালা ইউসুফ জাই পুরস্কারটি জিতে নেয়।

** ধারাবাহিক উপন্যাস: বলতে এলাম ভালোবাসি: পর্ব-৩
 
২০১৪ নেহা গুপ্ত (৭)
এবছর যুক্তরাষ্ট্রের নেহা গুপ্ত পায় আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার। ৭ বছর বয়সে নেহা তার দাদার বাড়ি ভারতে তার জন্মদিন পালন করতে একটি অনাথ আশ্রমে যায়। সেখানে শিশুদের জীবন-যাপনের মান, শিক্ষার অভাব, পুষ্টিহীনতা দেখে ব্যাথিত হয় তার শিশু মন। 
পরবর্তীতে ফিলাডেলফিয়ায় ফিরে গিয়ে অনাথদের সহায়তায় ‘এমপাওয়ার অরফানস’ নামের একটি দাতব্য সংস্থার সঙ্গে কাজ শুরু করে। প্রথম দফায় ৫ হাজার ডলার নিয়ে ভারতে এসে অনাথদের জন্য গড়ে লাইব্রেরি। কিনে দেয় খাবার, পোশাক ও কম্বল। ধীরে ধীরে বড় হয় তার সংস্থা। তার সংস্থা থেকে বিশ্বব্যাপী প্রায় ২৫ হাজার অনাথকে সহায়তা করা হয়। 

২০১৫ আব্রাহাম কেইটা (৯)

লাইবেরিয়ার আব্রাহাম কেইটা এবছর পুরস্কারটি পায়। লাইবেরিয়ান যুদ্ধে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারায় কেইটা। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবেশে এক বস্তিতে বেড়ে ওঠে সে। ৯ বছর বয়সে এক শিশুর ধর্ষণের বিরুদ্ধে শাস্তি চেয়ে মিছিলে যোগ দেয় কেইটা। এই দৃশ্য দেখে তাকে নেয়া হয় চিলড্রেন পার্লামেন্টে। পরবর্তীতে শিশুদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। চালু করে একটি রেডিও স্টেশন।

২০১৬ কেহকাশন বসু (১৬)

এবছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের কেহকাশন বসুর হাতে। ২০০০ সালে আন্তর্জাতিক পরিবেশ দিবস অর্থাৎ ৫ জুনে জন্ম নেয়া কেহকাশনের বয়স তখন ১৬। জন্মের তারিখের কারণেই হয়তো পরিবেশ নিয়ে ছোটবেলা থেকেই খুব সচেতন ছিলো সে। মাত্র আট বছর বয়সে শুরু করে গাছ লাগানো। এবং তার বন্ধুদের নিয়ে শুরু করে আবর্জনা পরিস্কারের কাজ। ছোটবেলা থেকেই বসু চাইতো শিশুদের জন্য এক স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। 
মাত্র ১১ বছর বয়সে ইন্দোনেশিয়ার চিলড্রেন এন্ড ইয়ুথ কনফারেন্সে বক্তব্য দেয় কেহকাশন। সেবছরই জাতিসংঘের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে বক্তব্য দেয় প্রেস কনফারেন্সে। পরবর্তীতে তার ‘গ্রিন হোপ’ আর ‘ট্রি ফর হোপ’ নামের কর্মসূচির জন্য পায় শিশু শান্তি পুরস্কার।

২০১৭ মোহামাদ আল জাউন্ডে (১৬)
সিরিয়ার মোহামাদ আল জাউন্ডে ২০১৭ সালে পুরস্কারটি পায়। সিরিয়ায় যুদ্ধের কারণে পালিয়ে লেবানন যায় আল জাউন্ডে। সেখানে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে দেখে ৫ লাখ শরণার্থী শিশুর মাঝে আড়াই লাখই শিক্ষার সুযোগ পায় না। এ অবস্থা দেখে শিবিরে একটি স্কুলে গড়ে তোলে জাউন্ডে। এছাড়া ব্যবস্থা করে বাকিদের শিক্ষার। ১৬ বছর বয়সে তাকে দেয়া হয় কিডস রাইট চেইঞ্জমেকারের পুরষ্কার। 

২০১৮ মার্চ ফর আওয়ার লাইভস
কোন শিশু এবছর পুরস্কার পায়নি, পেয়েছে একটি আন্দোলন। যার নাম ‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভস’ (এমএফএল)। ২০১৮ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে এক হামলাকারী স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে হামলা করে ফ্লোরিডার স্টোনম্যান ডগলাস হাইস্কুলে। যেখানে মারা যায় ১৭ শিশু। সে ভয়াবহ হামলার প্রতিবাদে ২৪ মার্চ ওয়াশিংটন ডিসিতে হয় ‘মার্চ ফর আওয়ার লাইভস’। বিশ্বের ৮৮০ টি জায়গায় পরবর্তীতে এই ইভেন্ট আয়োজিত হয়। 

২০১৯ গ্রেটা থানবার্গ (১৫)  ডিভিনা মালুম (১৫)

এ বছরটিতে পুরস্কারটি পায় দুইজন । জলবায়ু পরিবর্তনে কাজ করা সুইডেনের গ্রেটা থানবার্গ ও শিশু অধিকারে কাজ করা ক্যামেরুনের ডিভিনা মালুম। থানবার্গ ১৫ বছর বয়সে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অবিলম্বে কার্যকর প্রদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সুইডেন সংসদের বাইরে প্রতিবাদ শুরু করে। তখন থেকেই সে জলবায়ু কর্মী হিসেবে পরিচিতি পায়।
২০১৮ সালের নভেম্বরে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্কুলে অবরোধের ডাক দেয় এবং একই বছর ডিসেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের পর এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ২০১৯ সালের ১৫ মার্চ ১১২টি দেশের আনুমানিক ১.৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী তার ডাকে সাড়া দিয়ে জলবায়ু প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নেয়।
আর ডিভিনা মালুম ক্যামেরুনের ১০ টি অঞ্চলে প্রায় ১০০ জন স্থায়ী সদস্য নিয়ে একটি আন্দোলন শুরু করে। যার নাম ছিল ‘চিলড্রেন ফর পিস’। এর মাধ্যমে তারা প্রায় ৫ হাজার শিশুকে শেখায় যে তাদের পছন্দ আছে, সহিংসতা থেকে বাঁচার অধিকার আছে, আছে স্থায়ী শান্তি বজায় রাখার ক্ষমতা।
 
২০২০ সাদাত রহমান (১৭)
আর ২০২০ সালে সে পুরস্কার এলো বাংলাদেশে। নড়াইলের সন্তান সাদাত রহমান জিতে নেয় এই পুরস্কার। বিশ্বের খ্যাতনামা আত্মসচেতনতায় বলীয়ান শিশুদের সারিতে জায়গা করে নেয় ১৭ বছরের সাদাত। 

সামনের দিনে তার হাত ধরেই বিশ্বের প্রতিটি শিশু সাইবার বুলিং থেকে বাঁচবে এমনটাই প্রত্যাশা সবার।