অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বহুরূপী মাছ

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১১:১৪ এএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ০১:০৫ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ শুক্রবার

সাগরতলের বিচিত্র প্রাণী কাটল্ ফিশ। দেখলে প্রথমে অক্টোপাস বলে ভুল হয়। তবে  এদের গতি অক্টোপাসের চেছের বেশি দ্রুত। চোখের পলকে গায়ের রঙ পাল্টাতে ওস্তাদ বলেই হয়তো বহুরূপী বলা হয়। 

দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার উপক‚লে দিনরাত চষে বেড়ায় দানবাকৃতির এই কাটল ফিশরা। লম্বায় চার ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। কাটল ফিশ স্বভাবে লাজুক, প্রকৃতিতে নি:সঙ্গচারী। এদের বৈজ্ঞানিক নাম ‘সেপিয়া আপামা।’ কাটল ফিশ উজ্জল রঙের প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। কাটল্ ফিশদের শরীরের রঙ বদলে যায় তাদের মুডের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। রেগে গেলে, ভয় পেলে নিয়ন বাতির মত ঘন ঘন তাদের রঙ বদলে যেতে থাকে। 

কাটল্ ফিশদের প্রজাতি রয়েছে শতাধিক। তবে সবচেয়ে বড় প্রজাতিটি চারফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের বিচরণ শুধু দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার সাগর উপকূলে। আর সবক’টা প্রজাতির চেহারাই এক রকম। শক্ত, খড়খড়ে খোল রয়েছে সবার। বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন কাটল বোন। এরা আসলে শামুকের বংশধর। অক্টোপাসের মত এদের মাথা ফুঁড়ে শুঁড়ের মত উপাঙ্গ বেরিয়েছে মাত্র। শুঁড়ের সংখ্যা দশটি। আরও দুটো শুঁড় রয়েছে তবে তা লুকিয়ে রাখে ওরা শরীরের ভেতরে। দ্রæত সাঁতার কাটার প্রয়োজন হলে আটটা শুঁড় ব্যবহার করে ওরা। আর পানিতে যখন ঝুলে বা ভেসে থাকে, স্কার্টের মত ফিন ব্যবহার করে নিজেকে স্থির রাখে। শুঁড় বা বাহুগুলো তখন শরীরের পাশে চুপসানো পাতার মত থাকে। 

কাটল ফিশ তার লম্বা বাহুগুলো শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলার কাজেও লাগায়। যদিও তাদের মারামারির ক্ষমতা বড় জোর চার মিনিট। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী প্রতিদ্বন্ধিই সাধারণত লড়াইয়ে জিতে যায়। অবশ্য ছোট কাটল্ ফিশ কখনো কখনো বড়টাকেও ভয় দেখায়। শুধু মারামারি নয়, শিকার ধরার কাজেও লম্বা শুঁড় ব্যবহার করে ওরা। কাকড়া, চিংড়িসহ নানান সামুদ্রিক মাছ এদের প্রিয় খাবার। সুযোগ পেলেই আক্রমণ করে বসে। তবে অনেক সময় ওরা হাঙর এবং ডলফিনের শিকার হয়ে যায়। 

কাটল্ ফিশদের আস্তানা হলো সবুজ এবং বাদামী শ্যাওলা পড়া পাথরের গুহা বা খাঁজ। এরা রঙ বদলায় এক ধরনের ইলাস্টিক পিগমেন্ট থলির কারণে। ওদের শরীরের ভেতরে ঘন আস্তরণ রয়েছে এই রঞ্জক পদার্থের। বেশির ভাগ সময় তারা হলুদ, লাল, কালো এবং বাদামী রঙে নিজেদেরকে সাজায়। মস্তিস্ক থেকে সংকেত আসা মাত্র শরীরের কোষগুলো ফুলে ওঠে। চামড়ায় ছড়িয়ে পরে রঙ। কোষগুলো সংকুচিত করে বা বাড়িয়ে ওরা চামড়ায় জেব্রার মত স্ট্রাইপও তৈরি করতে সক্ষম। কোন কোন বিজ্ঞানীর মতে, কাটল্ ফিশ আসলে কালার বøাইন্ড। রঙ ভাল করে চিনুক বা না চিনুক, কাটল ফিশদের শিকারী দৃষ্টি কিন্তু সাংঘাতিক তীক্ষ্ণ। মানুষের মতই তাদের চোখের লেন্সের কার্যকারিতা। ফোকাস করার সময় এরা গোটা মণির আকার বদলে ফেলে। রেটিনা থেকে লেন্সটাকে দূরে বা কাছে নড়াতে পারে সহজেই। চোখের বর্ণালী পাপড়ি প্রয়োজন অনুসারে আলো সয়ে নেয়। মেয়ে কাটল ফিশরা তাদের বাচ্চাদের পাহারার দায় দায়িত্ব নিতে চায় না। গুহার যতটা ভেতরে সম্ভব তারা ডিম পাড়ে। তাদের ভয় লেদার জ্যাকেট নামের এক ধরনের মাছকে। এরা যাতে গুহার গভীরে ঢুকতে উৎসাহবোধ না করে সেজন্যে কাটল্ ফিশ এ কাজটা করে। 

কাটল ফিশের ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুবার পর নিজেদের রক্ষার ব্যবস্থা নিজেরাই করে নেয়। তখন ওরা লুকিয়ে পড়ে পাথরের আড়ালে। তারপরও শিকারীর হাত থেকে নবজাতকরা কমই রক্ষা পায়। সৌভাগ্যক্রমে যারা বেঁচে যায়, বেড়ে উঠতে থাকে সাগরের পানিতে; সবচেয়ে অদ্ভূত প্রাণীদের একজন হিসেবে।  

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।