অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ব্লাড প্রেসার কেন সমস্যা?

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১১:৪৭ এএম, ২৯ জুলাই ২০২২ শুক্রবার   আপডেট: ১১:৫০ এএম, ২৯ জুলাই ২০২২ শুক্রবার

সভ্যতার এইদিন পর্যন্ত আসতে মানব জাতিকে অন্য আরো বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মতো, অনেকগুলো মহামারীও পার করতে হয়েছে। করোনা, ডেঙ্গু, কলেরা, বসন্ত বা প্লে¬গে হাজার হাজার মানুষ মারা যাবার কথা আমরা সবাই জানি। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতির আশীর্বাদে আজ হয়তো এসব রোগে অত ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা নেই। কিন্তু মানুষকে তার উন্নত আরামদায়ক ও অগ্রগতিশীল জীবনের সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপের মতো দৈহিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। উন্নত দেশসমূহে এ সমস্যা প্রকট। উন্নয়নশীল দেশসমূহেরও স্বচ্ছল জনগণ এ সমস্যার প্রধান শিকার। তাদের যান্ত্রিকতা নির্ভর, অতিরিক্ত আরামদায়ক চলাচল ও প্রতিযোগিতামূলক বেশি চাপযুক্ত জীবন যাপন করতে গিয়ে দেহের ভিতরে ক্রমশঃ বাড়ছে রক্তচাপ । 

বিজ্ঞানের ভাষায়, উচ্চ রক্তচাপ আসলে কোন রোগ নয়- এটি একটি উপসর্গ। বয়স বাড়ার সাথে সাথেই রক্তচাপ বাড়তে থাকে। রক্তচাপ কত হলে উচ্চ রক্তচাপ বলা হবে তা নিয়ে অনেকদিনের বিতর্ক রয়েছে। তবে যাদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ স্বাভাবিক বলা হয়েছে তাদেরও কেউ কেউ উচ্চ রক্তচাপজনিত কিছু কিছু জটিলতায় ভুগছেন (যেমন- স্ট্রোক ও হৃদপিন্ডের রক্তনালীর অসুখ)। সব বয়সী লোকের ক্ষেত্রেই উপরের অসুখ দুটি উচ্চ রক্তচাপের সাথে সম্পৃক্ত। গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ রক্তচাপ আছে এমন মানুষ যদি নিয়মিত রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার ওষুধ খেয়ে যান তবে স্ট্রোক ও হৃৎপিন্ডের রক্তনালীর অসুখ হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

তবে একজন লোকের একটি নির্দিষ্ট রক্তচাপে ঝুঁকির হিসেব করতে গেলে আরো কিছু ব্যাপার ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে প্রতীয়মান হবে। এগুলো হলো উক্ত ব্যক্তির বয়স, লিঙ্গ, দৈহিক ওজন, প্রাত্যহিক শারীরিক শ্রম বা ব্যায়াম, প্রতিদিনের লবণ খাওয়ার পরিমাণ, ইনসুলিনের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিক্রিয়া, রক্তনালীর এন্ডোথেলিয়াসের সমস্যা, ধূমপান, পারিবারিক ইতিহাস, রক্তের কোলেষ্টেরলের পরিমাণ, ডায়াবেটিস ও পূর্বের রক্তনালীর অসুখ। তবে গবেষকরা বলেন, সবক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ সঠিকভাবে এখনও জানা সম্ভব হয়নি। পঁচানব্বই শতাংশ কিংবা তারচেয়েও বেশি রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কারণ বের করা সম্ভব হয় না। এদের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপকে এসেন্সিয়াল উচ্চ রক্তচাপ বলে। দু’শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে কিডনী ও এড্রেনাল গ্রন্থির রোগ থাকতে দেখা যায়। 

অন্যদের ক্ষেত্রে দেহের স্বাভাবিক রক্তচাপ বজায় রাখার প্রক্রিয়াসমূহে কোনরকম গড়মিলের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। কিন্তু গবেষণায় পাওয়া গেছে কিডনী, হৃদপিন্ডের রক্ত পাম্প করার ক্ষমতাও দেহের বিভিন্ন অংশের রক্ত পরিসঞ্চালন প্রতিরোধী রক্তনালী ও সিমন্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রের অস্বাভাবিকতা এ ধরনের উচ্চ রক্তচাপের কারণ। রক্তচাপ বাড়ার প্রথমদিকে সাধারণতঃ হৃদপিন্ডের রক্ত পাম্প করার পরিমাণ বেড়ে যায়। পরের দিকের দেহের বিভিন্ন অংশের রক্ত পরিসঞ্চালন প্রতিরোধী রক্তনালীর প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

শরীর বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীর সব দেশের মানুষের রক্তচাপের সমস্যায় পড়ার প্রবণতা এক রকম নয়।  কোন কোন জাতির মানুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপে ভোগার হার বেশি। যেমন- যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণ অধিবাসীরা এবং জাপানীরা। আফ্রিকার শহরাঞ্চলের মানুষের মধ্যে রক্তচাপ বেশি দেখা গেলেও গ্রামের দিকের মানুষের মাঝে রক্তচাপ সাধারণত স্বাভাবিকই দেখা যায়। এদের ক্ষেত্রে বংশগত রোগ হিসেবে এটি দেখা যায়। তাছাড়া অতিরিক্তি লবণ খাওয়া, মদ্যপান, অতিরিক্ত দৈহিক ওজন, শারীরিক পরিশ্রম না করা এবং মাতৃগর্ভকালীন কোন সমস্যা ইত্যাদির কারণেও রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কম দৈহিক ওজন নিয়ে যে সমস্ত শিশু জন্মায় তারা বেশি বয়সে তো বটেই কৈশোরেও উচ্চ রক্তচাপে ভোগে। আর যারা জন্মের সময় আনুপাতিক হারের চেয়ে ছোট আকারের হয়ে জন্মায় তাদের মাঝে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত কোলেষ্টেরল ও মেদ-ভুঁড়িতে আক্রান্ত হবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তবে অন্য কোন অঙ্গের অস্বাভাবিক কর্মকান্ড বা অসুখের কারণেও রক্তচাপ বাড়তে পারে। যেমন- সন্তান ধারণ (প্রি-একলাম্পশিয়া), কিডনী রোগ মহাধমনীর কোন অংশের সংকোচন, হরমোন নিঃসরণকারী গ্রন্থির রোগ এবং কিছু কিছু ওষুধও রক্তচাপ বাড়াতে পারে। যেমন- জন্ম বিরতিকরণ খাবার বড়ি (যাতে ইস্ট্রোজেন রয়েছে), স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, ব্যথানাশক ওষুধসমূহ প্রধান। রক্তচাপ বাড়ার জন্য যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই দায়ী হোক না কেন মূল ঘটনাটি ঘটে রক্তে সোডিয়াম বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে বা দেহের বিভিন্ন অংশের রক্ত সার সঞ্চালন প্রতিরোধী রক্তনালীসমূহের সংকোচনের মাধ্যমে। রক্তচাপ বেড়ে যাবার কারণে বহুবিধ শারীরিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।  

মনে রাখতে হবে, কোন মানুষের উচ্চ রক্তচাপ আছে বলে ঘোষণা করার আগে কমপক্ষে সাতদিন বিশ্রামরত অবস্থায় রক্তচাপ মাপতে হবে। শুয়ে থেকে এবং বেশি বয়সী লোকের জন্য দাঁড়িয়েও রক্তচাপ মাপতে হবে। সাত দিনের দু’টি নির্দিষ্ট সময়ে রক্তচাপ মাপের ফলাফল দেখে অভিজ্ঞ চিকিৎসক উক্ত ব্যক্তির রক্তচাপ বেশি বলে নিশ্চিত হবেন। হঠাৎ একবার রক্তচাপ মেপে বেশি পাওয়া গেলেই তাকে উচ্চ রক্তচাপের রোগী বলা অনুচিত। কেননা প্রায় প্রতি মিনিটেই রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়। কারো কারো রক্তচাপ মাপা হবে এ কারণেও রক্তচাপ বেড়ে যেতে দেখা যায়। পরিশ্রম করলে রক্তচাপ তাৎক্ষণিকভাবে বাড়ে। উত্তেজনা, টেনশন, অস্থিরতা ইত্যাদিও রক্তচাপ বাড়ায়। চমকে যাওয়া এবং বড় ধরনের কোন মানসিক আঘাতে সাময়িকভাবে রক্তচাপ বাড়ে। তাই রক্তচাপ মাপার আগে তাকে কমপক্ষে আধাঘণ্টা বিশ্রাম করতে বলে থাকেন চিকিৎসকরা। আরামদায়ক ও সুবিধাজনক অবস্থায় উষ্ণ ঘরে প্রথমে শায়িত ও পরে দন্ডায়মান অবস্থায় রক্তচাপ মাপতে হবে। প্রয়োজনে দুই বাহুতেই মাপতে হবে। 

যেহেতু বয়স বাড়ার সাথে রক্তচাপও বাড়তে থাকে, তাই বয়সী লোকদের রক্তচাপ সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত। চল্লিশ বছর পার হবার পর থেকে অবশ্যই নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করে দেখতে হবে। যাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনের মাঝে উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা আছে তাদের আরো বেশি করে সতর্ক থাকতে হবে। রক্তচাপ খাওয়া-দাওয়া ও জীবন-যাপনের পদ্ধতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। তাই পরিণত বয়সে সুশৃঙখল জীবন-যাপন করতে হবে। পশুর মাংস বিশেষ করে মাংসের চর্বি খাওয়া বর্জন করতে হবে। প্রচুর মাছ, শাক-সব্জি ও ফলমূল খাওয়া যেতে পারে। আর যতটা সম্ভব মানসিক চাপমুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিদিন যদি নাও সম্ভব হয় তবে সপ্তাহে নিদেন পক্ষে তিনদিন ব্যায়াম করা দরকার। আর হ্যাঁ, কে না জানে, দেহের ওজন সব সময়ই আদর্শ সীমার মধ্যে রাখা সবক্ষেত্রেই ভাল। 

শেখ আনোয়ার: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।