অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

টিপবিদ্বেষী নিপাত যাক

জান্নাতুল যূথী

প্রকাশিত: ০১:৪৫ পিএম, ৩ এপ্রিল ২০২২ রোববার  

ব্যক্তি তার রুচি-অভিরুচি অনুযায়ীই তার পোশাক-পরিচ্ছদ নির্বাচন করে। কেউ শাড়ি পরে, কেউ থ্রি পিস। কেউ পাজামা-পাঞ্জাবি, কেউ শার্টপ্যান্ট। কেউ কপালে টিপ পরে, কেউ পরে না। এসবই ঘটে ব্যক্তির ভালো লাগা-মন্দ লাগার কারণে। এই ভালো-মন্দের ধারণা, আচরণের বৈচিত্র্য মানুষ থেকে মানুষকে স্বতন্ত্র করে তোলে।

একজন পুরুষ বা একজন নারী কী পরবেন, সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। অথচ আমাদের দেশে প্রায় পোশাক-আশাকের উছিলায় নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে কতিপয় বখাটে থেকে শুরু করে সমাজের দায়িত্বশীল শ্রেণিও। ইভটিজিং, যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনাগুলোর জন্যও নারীর পোশাক-চলাফেরাকে দোষারোপ করে পুরুষতন্ত্র।

কপালে টিপ পরলে নারীর সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যায়। তার সৌম্যকান্তিময় দ্যুতি সৌন্দর্যপিপাসুকে মুগ্ধ করে। কিন্তু সেই সৌন্দর্য সহ্য হয় না একশ্রেণির উগ্রপন্থীর। তাই তারা সুযোগ পেলেই নারীর সাজসজ্জা নিয়েও কটাক্ষ করে।

দেশের সংবিধান যেখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে যোগ্যতা অনুসারে পেশা নির্বাচনের সুবিধা দিয়েছে, বাক-স্বাধীনতা ও চলাফেরার স্বাধীনতা দিয়েছে, পোশাক নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছে, সেখানে কিছু ‘উগ্রপন্থী’ এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়ত নারীকে উত্ত্যক্ত করে চলেছে। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে গত শনিবার (২ এপ্রিল, ২০২২)। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে প্রকাশ—এই দিন সকালে রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার ফার্মগেট মোড় পার হয়ে তেজগাঁও কলেজের দিকে যাচ্ছিলেন। এইসময় সেজান পয়েন্টের সামনে মোটরবাইকের ওপর বসে ছিলেন একজন পুলিশ সদস্য।  লতা সমাদ্দারকে দেখে ওই পুলিশ সদস্য তার উদ্দেশে বললেন, ‘টিপ পরছোস কেন’। এই কথা বলেই থেমে থাকেননি। এরপরই গালি দিলেন। এ ঘটনায়  শেরেবাংলা নগর থানায় দায়ের করা অভিযোগে লতা সমাদ্দার উল্লেখ করেছে, ‘প্রথম থেকে শুরু করে তিনি যে গালি দিয়েছেন, তা মুখে আনা এমনকি স্বামীর সঙ্গে বলতে গেলেও লজ্জা লাগবে। ঘুরে ওই ব্যক্তির মোটরবাইকের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। তখনো তিনি গালি দিচ্ছেন। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। একসময় আমার পায়ের পাতার ওপর দিয়েই বাইক চালিয়ে চলে যান।’

এখন প্রশ্ন হচ্ছে—একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে একজন নারী কেন এমন সংহিসতার শিকার হবেন! রাস্তায় বের হয়ে তাকে কেন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে!

রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যে পুলিশ বাহিনীর ওপর, সেই বাহিনীর সদস্যরা যদি এভাবে পথে-ঘাটে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে, তাহলে মানুষ সংকটে, বিপদে কার সাহায্য চাইবে? যারা নাগরিকের চলাফেরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তারাই যদি উল্টো নারীর প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে তাহলে মানুষের আশ্রয় কোথায় মিলবে। তবে কি নারীকে হাত-পা গুটিয়ে ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে?

এই নারীর টিপ পরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি বেদনাদায়ক ঘটনা মনে পড়ে গেলো! কিছুদিন আগে প্রিন্টের কাজে একটি কম্পিউটার দোকানে গিয়েছিলাম। সময়টা সন্ধ্যার ঠিক পূর্বমুহূর্ত। ওই দোকান থেকে বের হতে হতেই সন্ধ্যা। হাঁটছিলাম রাস্তার একপাশ ধরে। হঠাৎ অন্যপাশ থেকে আমার উদ্দেশে এক নারীর কণ্ঠ ভেসে এলো,‘এই মেয়ে মাথায় কাপড় দাও।’ ওই নারীর কর্কশ নির্দেশ শুনে আমি বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। কেবল মাথার ভেতর ঘুরতে লাগলো একটি প্রশ্ন, একজন নারী মাথায় কাপড় দেবেন কি না, সেই বিষয়ে আরেকজন নারী কিভাবে তাকে নির্দেশ দিতে পারেন?

লতা সমাদ্দারের টিপের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গেলে, একটি ভিন্নভাবে ভাবতে হয়। শুধু যে ‘নারীবিদ্বেষী’ পুরুষরাই নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে, তা নয়। পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হিসেবে উগ্রপন্থী নারীরাও একই রকম ব্যবহার করে।

লতা সমাদ্দার টিপ পরবেন, না হাতে শাঁখা পরে চলাচল করবেন, সে বিষয়ে পুলিশ সদস্য কেন, কেউ তাকে নির্দেশ দিতে পারে না। এই লতা সমাদ্দারের ঘটনার ভেতর দিয়ে একটি কথা পরিষ্কার হলো, দেশ স্বাধীন হলো, নারীর চলাফেরার স্বাধীনতাকে পুরুষরা স্বীকার করে না। তাই পথ চলতে কটাক্ষ করে, সুযোগ পেলে রূঢ়আচরণ করে, যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত করে। কেবল এমন অপরাধ করেই তারা থেমে থাকে না, এসব ঘটনার জন্য তারা আবার নারীর পোশাক-আশাক ও চলাফেরাকেই দায়ী করে। এই ধরনের মানসিকতা রোধে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ এখনো চোখে পড়েনি।

আমাদের মনে রাখতে হবে—কারও রুচিবোধ, আচরণ, পোশাক-আশাক, অলঙ্কার অন্যের ক্ষতির কারণ হয়ে না দাঁড়ালে, সে অভ্যাসকে বিদ্রূপ করা যায় না। নারীর সাজসজ্জাকে তিরস্কার করা আইন, সামাজিকতা ও ব্যক্তিগত অধিকারকে কটাক্ষের সামিল। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন নীতি মেনে চলে না অনেকেই। তারা  নারীকে পদে পদে আক্রমণ করে, তার স্বাধীন চেতনায় আঘাত করে!

সারা বিশ্ব যখন শিক্ষাদীক্ষা-দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গেছে, তখনো আমাদের দেশে কতিপয় উগ্রপন্থী নারীর পোশাক-সাজসজ্জা নিয়ে ব্যস্ত। এই উগ্রপন্থী ও পশ্চাৎপদদের নিয়ে বহু আগে কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে’। নজরুল চলে গেছেন, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। কিন্তু তার কবিতায় বলে যাওয়া সেই সমাজে একবিন্দু পরিবর্তনও আসেনি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? এভাবে চলতে থাকলে নারীর চলাফেরা বিপন্ন হবে। নারী বিপন্ন হলে পুরো জাতির ওপর দিয়েও সেই ঝড় বয়ে যাবে। ভারতচন্দ্রের সেই অমর উক্তি যেন আমরা ভুলে না যায়,  ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’ নগর অর্থাৎ নারীকে সম্মান করে, তার প্রতি সহিংস আচরণ করে জাতি কোনোদিন সম্মানের আসনে বসতে পারে না। তাই নারীর সম্মান-তার চলাফেরার পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। যে পুলিশ সদস্য শিক্ষক লতা সমাদ্দারকে টিপ পরার জন্য গালি দিয়েছেন, তার পায়ের পাতার ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে গেছেন, অবিলম্বে তাকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। দিতে হবে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যতদিন না এই শাস্তি কার্যকর হচ্ছে, প্রতিটি সচেতন মানবতাবাদী মানুষকে সোচ্চার হতে হবে। এই হেন অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করতে জোর দাবি জানাতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে একদিন এই বাংলা থেকে পাকিস্তানি হানাদাররা বিদায় হয়েছে। তাদের দোসর আলবদর, রাজকাররাও রেহাই পায়নি। আজ যারা নারীর প্রতি এই মৌলবাদী আচরণ করছে, তাদের সেই আলবদর-রাজাকারের দোসর বলেও অত্যুক্তি হবে না। সময় এসেছে এখনই প্রতিবাদ জানানোর। আমাদের সম্মিলিত প্রতিবাদই পারে আর এই উগ্রপন্থী-মৌলবাদীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে।

আমাদের নিশ্চয় মনে আছে, ১৯৮৭ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের এক অকুতোভয় কর্মী ছিলেন শহীদ নূর হোসেন। তিনি পেশায় ছিলেন একজন অটোরিকশাচালক। তিনি নিজের বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, এবং পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ স্লোগান লিখে মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। ১০ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে তিনি শহীদ হন। তার স্মরণে ‘১০ নভেম্বর’কে ‘নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে পালন করে জাতি। এখন সেই রাজনৈতিক স্বৈরাচার নেই। কিন্তু চেতনার স্বৈরাচার ঘরে ঘরে, পথে পথে। এই চেতনার স্বৈরাচাররা হলো নারীবিদ্বেষী, সৌন্দর্যবিদ্বেষী, টিপবিদ্বেষী। তাই আমাদের আজকের স্লোগান হোক,  ‘নারীস্বাধীনতা মুক্তি পাক, টিপবিদ্বেষী নিপাত যাক’।

লেখক: গবেষক ও শিক্ষক, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়।