অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সেবার প্রাণপুরুষ

কাজীদার রহস্য ফুরনোর নয়

কাজী সারাহ সাদীয়া নূর

প্রকাশিত: ০৪:৪২ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ০৫:২৮ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২২ বৃহস্পতিবার

বইমেলায় ঘুরেঘুরে বইপত্র নেড়েচেড়ে, গন্ধশুঁকে এবং কিছু বই কিনে চলে আসার আগে একটা স্টলের সামনে যতোবার গেছি, অতীতের কুয়াশা থেকে স্বরূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে উজ্জ্বল মূর্তীমান এক কৈশর তারুণ্য। এখানকার নিউজপ্রিন্টের বইয়ের পাতায় পাতায় লেগে থাকা রহস্য রোমাঞ্চ আর তার চরিত্রগুলো কথা বলতে শুরু করতো। নস্টালজিয়া আপাদস্তক মুড়িয়ে ফেলতো আমাকে। স্টলটি ‘সেবা প্রকাশনী’। টেলিভিশন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ইউটিউব বা গেমস নয়, আমাদের শৈশব জড়িয়ে আছে এই সেবাতে এবং কাজী আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে। 

বছরের পর বছর ধরে পাঠকের সঙ্গে দুই মলাটে কথা বলে গেছেন কথার জাদুকর কাজী আনোয়ার হোসেন। কাজীদা এবং সেবা প্রকাশনী যেন সমার্থক এক নাম। সেই ৬৩ সাল থেকে যুঝেছেন প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে। 

কাজী আনোয়ার হোসেন এমন একজন ক্ষমতাধর লেখক, যিনি গত অর্ধশতাব্দীকাল ধরে দেশের কিশোর থেকে তরুণ- কতো মানুষকে বই পড়া শিখিয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই। এই অঞ্চলের নাবালক রোমাঞ্চ সাহিত্যকে একাই সাবালক করে তুলেছিলেন তিনি। তাঁর উদ্যোগেই বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদি সাহিত্যগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল এ দেশের অগণিত কিশোর ও তরুণ। নবীন পাঠক তৈরিতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনীর জুড়ি কি আদৌ আছে! 

একেকটা নতুন বইয়ের জন্য মাস শেষে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা। সেবার বই মানেই নতুন উত্তেজনার খোঁজে নিরানন্দকে বিদায় জানানো। বই হাতে পাওয়া মাত্র ফ্ল্যাপের সারাংশটুকু এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলা, খুঁটিয়ে প্রচ্ছদ দেখা আবার কখনও বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা আগে পড়ে নেওয়া। 

আমাদের শুরু রহস্য পত্রিকা দিয়ে। আমার ভাই (শোভন আরেফ) ভাত খাওয়ার সময় রহস্য পত্রিকা খুলে না রেখে ভাত খেতে পারতো না। বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে থাকতাম। তার পড়া শেষে তবে সেটি হাতে আসতো আমার। 

আমরা একটু একটু করে বড়ো হই। আর খাবার সময় বা ঘুমাতে যাওয়ার আগে অথবা বাথরুমে পানির বালতি উল্টে তাতে বসে পড়ার সময়ে বদল হতে থাকে শুধু সিরিজের। প্রকাশনী কিন্তু পাল্টায়নি।

কিছুদিন পর পেলাম তিন গোয়েন্দা। বাংলাদেশের বইপড়ুয়াদের একটি বড় অংশের কৈশোরের নিত্যসঙ্গী তিন গোয়েন্দা। কল্পনা জুড়ে কিশোর পাশা, মুসা আমান, রবিন মিলফোর্ড। ভাইয়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা, পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ড নেই, মোবাইল হোম নেই, নেই ক্যারাভেন, তো কি হয়েছে! আমাদের পুরনো গাড়িটাকে কোনোভাবে মাটির নিচে ঢুকিয়ে দিলেই হেডকোয়ার্টার বানানো যায়। সেখানে জলজ্যান্ত ছাপার যন্ত্র থেকে শুরু করে ‘সর্বদর্শন’ নামের এক পেরিস্কোপ আর আস্ত এক ডার্করুমও বানাবো আমরা। আমাদের হেড কোয়ার্টারেও ঢোকার জন্য থাকবে ‘সবুজ ফটক এক’, ‘দুই সুড়ঙ্গ’, ‘সহজ তিন’ কিংবা ‘লাল কুকুর চার’ নামের গোপন পথ। 

কুয়াশা আমার তেমন একটা পড়া হয়নি। এরপরের ধাপ ‘মাসুদ রানা’। সাড়ে পাঁচ দশকজুড়ে পাঠকদের মনোজগতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের এক দুর্দান্ত, দুঃসাহসী স্পাই মাসুদ রানা। গোপন মিশন নিয়ে দেশ-দেশান্তরে ঘুরছে কোমলে কঠোরে মেশানো নিষ্ঠুর সুন্দর মনের এক তরুণ। চির নবীন সাবেক এই মেজর কোথাও অন্যায় অবিচার দেখলে রুখে দাঁড়িয়েছে। আজ তিনি থেমেছেন, আর কোনো অ্যাসাইনমেন্ট সেরে মতিঝিলের হেড অফিসে বুড়ো বস রাহাত খানের সমানে আর দাঁড়াতে হবে না রানাকে। 

ষাটের দশকের শেষে এই ‘মাসুদ রানা’ই বিরাট এক পরিবর্তন নিয়ে আসে পাঠকের জন্য। লুকিয়ে থাকা অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসী মনটা বুঝি লাফ দিয়ে ওঠে। এ দেশে আশি-নব্বই দশক এবং দুহাজার পরবর্তী সময়েও তরুণদের মগ্নতা ছিল 'মাসুদ রানা' থ্রিলারে। রানার মতো রোমাঞ্চকর চরিত্র হতে চেয়েছেন বহুজন। ছাপার অক্ষরের সোহানায় বহু প্রেমিক হৃদয় বুঁদ হয়ে থেকেছে।

বলাই যায় রক্ষণশীল সমাজে ‘মাসুদ রানা’ একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়েছিল। রহস্য-রোমাঞ্চ-অভিযানের সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদের কিছু উপাদানের মিশেল সহ্য করা কঠিনই ছিল কথিত সমাজপতি ও অভিভাবক শ্রেণির জন্য। 

কিন্তু তরুণসমাজ ও প্রগতিমনস্কদের অনেকেই স্বাগত জানালেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কবি আহসান হাবীব। তিনি কাজী আনোয়ারকে বলেছিলেন কারও কথায় কান না দিতে। নিন্দা-সমালোচনা, মামলার পাশাপাশি সাময়িকভাবে বই নিষিদ্ধ হওয়ার মুখেও পড়ে। তবে বিপুল পাঠক সমর্থন ও উৎসাহ আর নিজের তারুণ্যের অনমনীয় জেদ কাজীদাকে উতরে দেয় সেই সময়ের বাধাগুলো থেকে। 

তবে স্পাই থ্রিলারে থেমে থাকেনি না সেবা প্রকাশনী। বিশ্ববিখ্যাত ক্ল্যাসিকগুলো কখনো সংক্ষিপ্ত রূপান্তর, কখনো বা পূর্ণ অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের হাতে তুলে দিতে শুরু করছেন কাজীদা। বিষয়বৈচিত্র্য বাড়াতে এনেছেন বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো ওয়েস্টার্ন।

সেবার আকর্ষণ জোরদার হয়ে উঠেছে কিশোর ক্ল্যাসিক সিরিজের কারণে। এ কারণে বিশেষ কৃতজ্ঞতার দাবীদার লেখক নিয়াজ মোরশেদ।একে একে বেনহার, রবিনসন ক্রশো, কালো তীর, সলোমানের গুপ্তধন, প্রবাল দ্বীপ, সুইস ফ্যামিলি রবিনসন, কপালকুণ্ডলাসহ বিশ্বসাহিত্যে নামীদামি গ্রন্থগুলো বাংলা ভাষাভাষী কিশোর পাঠকদের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে।

ট্রেজার আইল্যান্ড, বাস্কারভিলের হাউন্ড, শি, রিটার্ন অব শি, অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টসহ আরও কিছু অসাধারণ অনুবাদের কথাই বা উল্লেখ না করি কিভাবে!

আরও বলতে হয় জুলভার্নের সায়েন্স ফিকশনগুলোর সাবলীল ও সংক্ষিপ্ত রূপান্তরের কথা। রকিব হাসান, নিয়াজ মোরশেদ ছাড়াও শেখ আবদুল হাকিম, জাহিদ হাসান, আসাদুজ্জামানসহ আরও অনেকের সোনালি কলম থেকে বেরিয়ে এসেছে ঝরঝরে দুর্দান্ত অনুবাদমালা।

শতাধিক বেশি লেখক-অনুবাদক তৈরি হয়েছে সেবা প্রকাশনী থেকে। আজকের বিভিন্ন নামকরা গণমাধ্যমে যারা কৃতিত্বের সঙ্গে কাজ করছেন, তাদের অনেকেই সেবা, রহস্যপত্রিকা বা কিশোরপত্রিকারই প্রত্যক্ষ সৃষ্টি। আর পরোক্ষভাবে যে কতজন আছেন, তার ইয়ত্তা নেই।

কাজী আনোয়ার হোসেন নিয়ে সাহিত্যে এনেছিলেন ‘রিপোর্টাজ’ ভাষা। শুধু আনলেনই না, প্রতিষ্ঠা করলেন। যা সেবা প্রকাশনীর বা সেবার ভাষা। আজকে বাংলাদেশের সংবাদপত্রে সহজ ভাষায় অল্প কথায় সারমর্মটুকু তুলে এনে গুছিয়ে লেখার যে চর্চা তাও তো এসেছে সেবার ভাষারীতি অনুসরণ করেই।

এতো কথা বলেও মন হালকা হলো না আমার। শুধু মনে পড়ছে সেবার বই নিয়ে আমাদের দুই ভাইবোনের কাড়াকড়ির কথা। আমাদের পড়া শেষে যে বই দেখা যেত, আম্মার বালিশের পাশে। মনে পড়ছে বড় ভাই এবং এক সময়ের কলিগ গণি ভাইয়ের ব্যাগ থেকে সবসময় উঁকি দিত সেবার বই। এখনও মাঝেমধ্যে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এটা সেটা দেখে চোখের সামনে ধরি সেবার কোনো অনুবাদ। সহজ কথাশৈলীতে আমার স্ট্রেস কমে, হালকা লাগে অনেকটা।

চোখে ভাসছে আমাদের পাবনার বাড়ির বইয়ের তাক আর আলমারিতে রাখা সেবার বইগুলোর চেহারা। বইগুলোর অধিকাংশ পাতাই ছেড়া, পোকায় খাওয়া এবং সুতো খুলে এসেছে। কিন্তু ওই বইগুলোয় পাতায় পাতায় আমরা বন্ধক দিয়ে এসেছি আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। যে বয়সে জটিলতা দাগ ধরায় না, যে বয়সের মন ও্ মাথার দরজা একটু একটু করে খুলে দিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। আমার বিশ্বাস ঠিকঠাক ব্যবস্থাপনায় চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হলে আরও ৫০ বছরেও সেবার প্রয়োজন ফুরোবে না। অগ্নিপুরষ হয়ে কাজীদা বেঁচে রইবেন রহস্য হয়ে।