অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কৃষক, শ্রমিক, প্রবাসীদের কঠোর পরিশ্রম দেশের উন্নয়নকে বেগবান করেছে

হীরেন পণ্ডিত

প্রকাশিত: ০৪:১৪ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২২ বুধবার   আপডেট: ০৪:২০ পিএম, ৫ জানুয়ারি ২০২২ বুধবার

বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা ২০২১ সালে স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শে গড়ে উঠুক অসাম্প্রদায়িক, আত্মনির্ভরশীল ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ এই কামনা সবার। ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন  হয়েছে তা প্রশংসার যোগ্য এতে সব শ্রেণী পেশার মানুষের অবদান রয়েছে। 

স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ। তখন আমাদের তেমন কিছুই ছিল না। মাথাপিছু আয়, রপ্তানি, প্রবাসী আয় সবকিছুই ছিল নাম মাত্র। সেখান থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এসেছে দেশটি। গত ১২ বছরে দুর্দান্ত অগ্রগতি হয়েছে। যদিও ধারাটি শুরু হয়েছিলো নব্বইয়ের দশকে। এশিয়ার ১১-১২টি দেশের অর্থনৈতিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বাংলাদেশ সম্প্রতি প্রতি পাঁচ বছরে ১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি যোগ করেছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দুই-তিন বছর ধরে সর্বোচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে। অবশ্যই, সবচেয়ে বড় অবদান রপ্তানি, রেমিটেন্স এবং কৃষি। কৃষি খাতে বৈচিত্র্য এসেছে। ফলে আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। কিন্তু কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক বেশি। পণ্য বৈচিত্র্য এবং নতুন বাজার প্রসারিত করা প্রয়োজন রেমিট্যান্স বেশি হলেও প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় তা কম। এটা বাড়াতে হবে।

কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী কঠিন পরিশ্রমী বীরদের ঘাম ও শ্রমে সৃষ্ট বাংলাদেশ উন্নয়নের কিংবদন্তি হয়ে বিশ্বের কাছে হয়ে উঠছে উন্নয়নের দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতার পর মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ৭৬৮ গুণ বেড়ে এখন ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। তথ্য অনুযায়ী, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের 'তলাবিহীন ঝুড়ি' এখন সাফল্যের গল্পে উপচে পড়ছে।

মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ওয়েলথ-এক্সের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটা শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নয়; অত্যন্ত সমৃদ্ধ প্রবৃদ্ধির দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, জাপান, হংকং, চীন ও ভারতসহ ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। গত এক দশকে বাংলাদেশে ধনীদের সংখ্যা গড়ে ১৪.৩% হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার মোট সম্পদের পরিমাণ ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় খাদ্য সংকট সাড়ে ৭ কোটি মানুষের হলেও মোট ফসল উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি টন। ৫০ বছর পর বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ। ফসল উৎপাদন চার কোটি টনে পৌঁছেছে। ঘাটতির বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সকল বাধা অতিক্রম করে, কঠোর পরিশ্রম ও ঘামের মাধ্যমে কৃষির প্রায় সকল উপখাতে কৃষকের মন ও আত্মার জয়জয়কার। ৫০ বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষ সমৃদ্ধির চাকাকে পেছন থেকে ঠেলে দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করেছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি করেছে অপ্রতিরোধ্য। লাল-সবুজের পতাকা বিশ্বের শীর্ষে উত্তোলন করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক কোটি প্রবাসী তাঁদের অমানবিক শ্রমের প্রায় পুরো আয় দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে উনয়নের পথে।

সরকারি পরিকল্পনা কমিশন, দেশি-বিদেশি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ১৯৭১ সালে ধ্বংসস্ত‚পে যে দেশটির জন্ম হয়েছিলো, ৫০ বছর পরে, সেই দেশটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি। মাত্র কয়েক মাস আগে, হেনরি কিসিঞ্জার নিজেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের মডেল অনুসরণ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। জাতিসংঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) আটটি লক্ষ্যের প্রায় সবগুলোতেই ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এখন টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এসডিজি বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রায় এক দশক ধরে বিশ্বের শীর্ষ সংস্থা এবং বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, জাইকা, গোল্ডম্যান শ্যাক্স, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, এইচএসবিসি, সিটি ব্যাংক এনএ, পিডব্লিউসির পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে ডায়মন্ড, ইমার্জিং টাইগারসহ বিভিন্ন নামে ডাকা হচ্ছে। এর কারণেই ধারাবাহিকভাবে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রিজার্ভ, রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয়, রপ্তানি, মাথাপিছু আয়, আয়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং অর্থনীতির অন্যান্য প্রধান সূচকে প্রতিবেশী দেশসহ বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে চমক।

তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতা-উত্তর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা মাত্র ৫০১ কোটি টাকার এডিপির আকার চলতি অর্থবছরে ২ দশমিক ২৫ ট্রিলিয়ন টাকায় পৌঁছেছে। তখন মাথাপিছু আয় ১২৯ টাকা এখন ২৫৫৪ ডলার ছাড়িয়েছে। যে সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের নিচে ছিল, এখন তা ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। স্বাধীনতার পর বছরে, মাত্র ৩৪৮.৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি পাঁচ দশকের মধ্যে ১১১ গুণ বেড়েছে ৩.৮৫ বিলিয়ন হয়েছে। প্রবাসী আয়, যা ৫০ বছর আগে নামমাত্র ছিল, তা বছরে ২৫ বিলিয়নে পৌঁছেছে। রপ্তানি ও প্রবাসী রাজস্ব ৪৮ বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অতিক্রম করেছে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। নারী শিক্ষা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, আয়, বাণিজ্য ঘাটতি, দারিদ্র্য ও চরম দারিদ্র্য হ্রাস, নিরাপদ সুপেয় পানি, আবাসন, স্কুলে ভর্তি, মাতৃমৃত্যুর হার, শিশুমৃত্যুর হারের মতো সমস্ত সূচকে বাংলাদেশের অর্জন সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। সেই সাফল্যের জন্য এত কিছু; অগ্রগতি, বলা যায় অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাত, কৃষি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করা হচ্ছে অন্য সব দিকে সক্ষমতা তৈরিতে।

বাংলাদেশের কৃষকরা ঝড় জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরাসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেও দ্বিগুণ দৃঢ়তা ও শক্তি দিয়ে কৃষির অগ্রগতি বজায় রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৭ শতাংশের বেশি কৃষিকাজে নিয়োজিত। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ ব্যবহার করে তারা জমি ক্ষয়ের পরও কয়েকগুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের ১০ শতাংশ জমি উচ্চ ফলনশীল ফসলের আওতাধীন ছিল। এখন তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ১০ শতাংশ জমি সেচের আওতায় ছিল, এখন তা ৮০ শতাংশ। ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ ও ভুট্টা দশ গুণ। বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, খোলা পানিতে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। হাঁস-মুরগি এবং দুগ্ধ খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমে।
রপ্তানি ও পোশাক খাত কৃষির মতো অবদান রাখছে কারণ এটি দেশকে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এই সেক্টরে প্রায় ৬ মিলিয়ন কর্মী তুলনামূলকভাবে কম মজুরিতে কাজ করছে, যা প্রতিযোগিতায় বিশ্বকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ফলে চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যে খাত ৫০ বছর আগে রপ্তানি আয়ের তালিকায় ছিলোনা, কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে দেশে এসেছে ৩ হাজার ৪১৩ কোটি ডলার, যার পরিমাণ ২০১৩ সালে ২ লাখ ৯০ হাজার ১০৫ কোটি টাকা। দেশীয় মুদ্রা। করোনার কারণে গত অর্থবছরে রপ্তানি কিছুটা কমলেও মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশই হয়েছে তৈরি পোশাকে।

গত ৫০ বছরে দেশের রপ্তানি আয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছে পোশাক খাত। পাঁচ দশকে রপ্তানি আয় বেড়েছে ৯৬ গুণ। গ্রামীণ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান, নারীর আর্থ-সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং অসংখ্য সহযোগী শিল্পের সম্প্রসারণের মাধ্যমে খাতটি বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এক সময় যেটি ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ছিল তা এখন পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায়ও বাংলাদেশ শীর্ষে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের চেয়ে বড় চমক আর কী হতে পারে! মূল্য, গুণমান এবং লিড টাইমকে দক্ষতার সাথে একত্রিত করে খাতটি বিশ্ববাজারকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ খাতে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে।

এ ছাড়া বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ ও উন্নত করতে যে খাতটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তা হলো প্রবাসী আয়। প্রবাসীরা তাঁদের পরিবার ও প্রিয়জনদের ছেড়ে দিনরাত পরিশ্রম করে প্রবাসী হয়ে তাদের উপার্জনের সিংহভাগ দেশে পাঠান। এর ওপর ভিত্তি করেই আজ দেশের সমৃদ্ধি এসেছে। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৪ হাজার এখন তা প্রায় ১ কোটি। ১৯৮৬-৮৮ সালে প্রবাসী আয় ছিল মাত্র ৪৯ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু ২০২০ সালে বাংলাদেশে এসে দাঁড়ায় ২২ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা।

দেশে খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে, অন্যদিকে স্থল রপ্তানি ও রেমিটেন্স আকারে শক্তিশালী বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে। এসবের সম্মিলিত ফল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শক্তি। সারাদেশে সড়ক, মহাসড়ক ও মেগা প্রকল্প। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করছে।

তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এনবিআরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী বছরে দেশের ডিজিটাল প্ল্যটফর্মের ব্যবসা দাঁড়াবে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রায় আয় করছে আমাদের তরুণরা। এ খাতের রপ্তানি আয়ও ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দেশে প্রায় শতভাগ আমদানি-নির্ভর মোবাইল ফোন সেট তৈরি হচ্ছে। সামনে রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিশাল দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বাংলাদেশ হাব হয়ে উঠবে।

হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো, বিএনএনআরসি।