অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ভারতীয় ব্রেইন ড্রেইন ও মার্কিন প্রযুক্তি খাত 

সাই-টেক ডেস্ক

প্রকাশিত: ০২:০৩ পিএম, ৫ ডিসেম্বর ২০২১ রোববার  

সম্প্রতি টুইটারের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন ভারতীয়-আমেরিকান পরাগ আগরওয়াল। বিশ্বের বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোতে ভারতীয়দের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার তালিকায় সর্বশেষ তার নাম যুক্ত হলো। এর আগে আমরা দেখেছি মাইক্রোসফট বা গুগলের মতো বড় বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদগুলো অলঙ্কৃত করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষেরা।

প্রযুক্তিবিশ্বে ভারতীয় প্রকৌশলীদের এ জয়যাত্রা মোটেও সাম্প্রতিক কিছু নয়। এটির সূচনা ঘটেছিল সেই সত্তর থেকে নব্বইয়ের দশকের মধ্যেই। ইউএসবি স্ট্যান্ডার্ডের জনক হিসেবে পরিচিত অজয় ভাট ১৯৯০ সালে ইন্টেল-এ যোগ দেন। ইন্টেল-এর আরেক প্রথিতযশা ভারতীয় বিজ্ঞানী ছিলেন বিনোদ ধাম। তিনি ইন্টেল-এর পেন্টিয়াম প্রসেসরের জনক। ১৯৯৫ সালে তিনি ইন্টেল ছেড়ে এএমডি-তে যোগ দেন। ভিনোদ খোসলা আরেক বিখ্যাত ভারতীয়-আমেরিকান বিজ্ঞানী। এদের বাইরে আরও কয়েকজন ভারতীয় প্রথম সারির প্রযুক্তিবোদ্ধা হলেন সাবির ভাটিয়া, ভিক গুন্দোত্রা, অমিত সিংহল, রুচি সাংভি, পদ্মশ্রী ওয়ারিয়র, শান্তনু নারায়ণ, ওম মালিক প্রভৃতি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ ভারতীয়। আর সিলিকন ভ্যালির মোট জনবলের ছয় শতাংশ হচ্ছে ভারতীয়। এই ভারতীয়দের বেশিরভাগই শীর্ষস্থানীয় পদগুলো দখল করে আছেন। এর পেছনে কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের দেখতে হবে অনেক পেছনে ফিরে।

টাটা সান্স-এর প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক আর. গোপালকৃষ্ণন এই সাফল্যের পেছনে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার অবদানকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারতের নাগরিকদেরকে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই অনেক কসরত করতে হয়। এ সমস্যাসংকুল নাগরিক জীবন প্রতিটি ভারতীয়কে একজন পোড় খাওয়া মানুষে পরিণত করে। ফলে আমেরিকার মতো উন্নত দেশের যে কোনো সমস্যা তাদের কাছে বেশি মাথাব্যথার কারণ হয় না। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রে একজন ভারতীয় বেশি চাপ সহ্য করতে পারেন। স্বভাবতই সেখানে তিনি অন্য সবার চেয়ে বেশি দক্ষতা প্রদর্শন করেন। আর এতেই তিনি আর সবার চেয়ে এগিয়ে থাকেন।

১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে বড়সড় পরিবর্তন আসে। এ সময় নতুন অভিবাসন আইন করার ফলে শিক্ষিত ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রে সহজ প্রবেশ অধিকার পায়। যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি ভিসা, যেটাতে বিদেশিদের কাজের অধিকার দেওয়া হয়, তার ৭০ শতাংশ নিয়মিত যোগ্যতাবলে দখল করে নেন ভারতীয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারেরা।

১৯৭০-এর দশকের অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তনের পর যেসব ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে আসেন তারা মোটামুটি ভারতীয় সমাজের উচ্চবিত্ত ছিলেন। নিদেনপক্ষে আমেরিকায় এসে তাদের আরেকটা মাস্টার্স করার সামর্থ্য ছিল। ওদিকে ভিসা সিস্টেমের কারণে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গণিত ইত্যাদিতে দক্ষ ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল।

প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা বিবেক ওয়াদহোয়া আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন। সিলিকন ভ্যালিতে যারা প্রথমদিকের ভারতীয় কর্মী ছিলেন তারা পরে অন্য ভারতীয়দের পথ দেখিয়েছেন। এ ভারতীয়দের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল যা বাকিদের জন্য কাজ যথেষ্ট সহজ করে দিয়েছিল।

আবারও ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া যাক। প্রতিটি ভারতীয় শিক্ষার্থীকে মোটামুটি তিনটি ভাষা শিখতে হয়। হিন্দি, ইংরেজি, আর নিজেদের রাজ্যের ভাষা। ইংরেজি শেখাটা মোটামুটি বেশিরভাগ উচ্চশিক্ষিত ভারতীয়ের স্কুলজীবনেই হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক ভাষার এ দখল তার যোগাযোগ দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস অনেকগুণ বাড়িয়ে যায়। ফলে একজন চীনা বা কোরিয়ান প্রকোশলীর চেয়ে একজন ভারতীয় প্রকোশলী বেশি দক্ষভাবে অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। বলা বহুল্য, এটি যুক্তরাষ্ট্রে কাজের ক্ষেত্রে একটি বড় প্লাস পয়েন্ট।

শুধু ইংরেজি নয়, গণিত আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে। ভারতের স্কুলগুলোতে অনেক আগেও থেকেই গণিত ও বিজ্ঞান শেখানো শুরু হয়। যেখানে মার্কিন মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় একজন মার্কিন কিশোর ক্লাস নাইনে উঠে প্রথমবারের মতো বীজগণিত শেখে, সেখানে একজন ভারতীয় শিক্ষার্থী ক্লাস সিক্সে উঠেই বীজগণিতের দেখা পায়। এছাড়া, বাংলাদেশ আর ভারতীয় পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মোটামুটি সমরূপ চিন্তাধারা দেখা যায়। ভারতীয় মা-বাবাও চান তার সন্তানটি বিজ্ঞান নিয়ে পড়ুক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক। সেজন্য এখানে বিজ্ঞানভিত্তিক পড়ালেখার গতি বেশি। যদিও সব বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাই যে সাফল্য অর্জন করে তা অবশ্যই নয়, কিন্তু যারা সফল হন, তাদের বড় একটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

অবশ্য মুদ্রার অন্য পিঠও রয়েছে। অনেক ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের জন্য সিলিকন ভ্যালির অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর ছিল না, আজও নেই। শুধু সিলিকনেই নয়, যেকোনো মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানেই জাতিগত বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন ভারতীয়রা। আবার ভারতীয় পুরুষরা প্রযুক্তির দুনিয়ায় পথ দেখালেও নারীদের ক্ষেত্রে এটি এখনো বলার মতো কিছু নয়। গুটিকয়েক নারী ছাড়া মার্কিন প্রযুক্তি খাতে তেমন কোনো ভারতীয় নারীর সরব উপস্থিতি নেই।

তথ্যসূত্র: বিবিসি ও অন্যান্য