অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সাপে কাটিয়ে হত্যা, স্বামী জেলে

সাতরং ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৪৬ এএম, ২১ নভেম্বর ২০২১ রোববার   আপডেট: ১০:১৯ এএম, ২১ নভেম্বর ২০২১ রোববার

ভারতে এক গৃহবধুর সাপের দংশনে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আদালতে গড়ালে, জানা গেলো এই মৃত্যুর জন্য তার স্বামী দায়ী। সাপ দিয়ে দংশন করিয়ে তিনি নিজেই স্ত্রীকে খুন করেছেন। আথরা নামের এই ২৫ বছর বয়সী মেয়েটির মা-ই প্রথম দেখতে পান তার মেয়েটির নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়। তার বাম বাহুতে বিন্দু বিন্দু রক্ত।  পরিবারের সকলে মিলে ্আথরাকে স্থানীয় কোলাম হাসপাতালে নিয়ে গেলো। কিন্তু আথরা ততক্ষণে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পারি জমিয়েছে। ঘটনাটি ভারতের কেরালার।

পোস্ট মর্টেমে জানা গেলো ২০২০ সালের ৭ মে'র ওই দিনটিতে আথরাকে ভারতীয় বিষধর কোবরা দংশন করেছিলো। দেশটিতে সাপের কামড়ে মৃত্যু কিংবা কামড়ানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কেনোই যেনো পরিবারটির সন্দেহ হলো, এবং পুলিশে একটি অভিযোগও রজ্জু করে দিলো।  মামলা আদালতে গড়ালো। আর তাতে ঘটনাটি জাতীয় সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামেও উঠে এলো। বিচারে জানা গেলো আথরার মৃত্যুর জন্য আর কেউ নয়, দায়ী স্বয়ং তার স্বামী। আদালত বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে এরই মধ্যে তাকে আজীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। বিচারক নিশ্চিত হয়েছেন আথরার মৃত্যু কোবরার দংশনেই হয়েছে- তবে তা ঘটিয়েছেন তার স্বামী। আর বিষধর সাপকে অস্ত্র হিসেবে তার ব্যবহার এই প্রথম নয়। 

সুরজ কুমার ও আথরার বিয়ে হয় ২০১৮ সালে। একটি ঘটক সেবার সুবিধা নিয়ে তাদের বিয়ে ঠিক হয়। পরিবারের একটাই চাওয়া ছিলো, আথরার জন্য এমন কেউ একজনকে খুঁজে বের করা, যে তাকে সুখী রাখবে। আথরার ভাই বিশুর মতে, তার বোন ভিন্ন প্রকৃতির একটি মেয়ে ছিলো। তার বুদ্ধি একটু কম কাজ করতো। আর সে কারণেই তারা এমন কাউকে খুঁজছিলেন যিনি তার দেখভাল করতে পারেন। ঘটকালী সেবার মাধ্যমে তারা পান এই সুরজ কুমারের খোঁজ। ২৭ বছরের যুবক। ব্যাংকের কেরানী। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। বাবা অটোরিক্সা চালান, মা গৃহবধু। আদালতের রায়ের কপিতে বলা হয়েছে, সুরজ কুমার আরথাকে বিয়ে করেছিলেন স্রেফ টাকা-পয়সার লোভে। বিয়ের সময় কুমারকে ৭২০ গ্রাম সোনা, সুজুকি সেডান গাড়ি ও নগদ ৫ লাখ রুপি যৌতুক দেয় আরথার পরিবার। 

বিয়ের প্রথম কয়েক মাসে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিলো। আর এক বছরের মাথায় তাদের একটি ছেলে সন্তান জন্ম নিলো। এরপর শুরু হলো আরথার পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টি। কুমারের লোভী বাবা-মা আরথার পরিবারের কাছ থেকে আরও যৌতুক চাইতে শুরু করলো। ঘরের জন্য বিভিন্ন সামগ্রী, গাড়ি, আসবাবপত্র, ঘর ঠিকঠাক করার জন্য টাকা এমনকি কুমারের বোনের এমবিএ-তে ভর্তি হওয়ার জন্য ফি-এর টাকাও তারা চাইলো আরথার পরিবারের কাছে। 

ভাই বিশু বলছিলেন, আরথা ছিলো এমন একটা মেয়ে, যে কারো মধ্যে খারাপ কিছু দেখতে পেতো না। তার নির্বুদ্ধিতা মানে হচ্ছে, তাকে কেউ ব্যবহার করছে এটা সে বুঝতেই পারতো না। আরথার বাবা আদালতকে জানিয়েছেন, মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সকল চাহিদাই তিনি পুরুণ করেছেন। তার নিজের মেয়ের দেখভালের জন্য মাসে ৮ হাজার রুপি করে দিতেন। কিন্তু তাতেও কুমারের মন ভরে নি। এরপর তিনি আরথাকে হত্যা করার পরিকল্পনা সাজাতে শুরু করলেন।  

হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ
২০১৯ সালে কুমার সাপ নিয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইন্টারনেটে কাটাতেন ইউটিউবে সাপের ভিডিও দেখে দেখে। সে বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি সুরজ কুমার ১০ হাজার রুপি দিয়ে একটি বিষধর সাপ কিনলেন। পরের দিন সেই সাপটি ঘরের সিঁড়ির ওপর রেখে আথরাকে বললেন, উপর তলার বেডরুম থেকে তার ফোনটি নিয়ে আসার জন্য। সুরজ কুমারের প্রত্যাশা ছিলো সাপটি আরথাকে দংশন করবে আর তাতে তার মৃত্যু হবে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হলো। আথরা সাপটিকে দেখতে পেলেন ও চিৎকার শুরু করলে। সুরজ কুমার সাপটিকে ধরে একটি প্লাস্টিক ব্যাগের মধ্যে রেখে দিলেন। এরপর ২ মার্চ তিনি আরো একবার চেষ্টা চালালেন আরথাকে সাপটি দিয়ে দংশন করানোর। পায়েশের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ দিয়ে আরথাকে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন। আর সে ঘুমিয়া গেলে সুরজ কুমার সাপটিকে দিয়ে আথরার শরীরে দংশন করালেন। আর সেটিকে ঘরের বাইরে ছুড়ে দিলেন। আথরা ভীষণ ব্যাথায় জেগে উঠলেন আর চিৎকার শুরু করলেন। পরিবারের সদস্যরা দেরী করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে হাসাপাতালে নিয়ে গেলো এবং সেখানে হাসপাতালকে জানালো ঘরের বাইরে কাপড় কাচতে গেলে রাতে তাকে সাপ দংশন করেছে। আথরা অবশ্য তখন চিকিৎসকদের বলেছিলেন, তিনি রাতে কোনো কাপড় কাচতে যান নি। 

স্ত্রী যখন হাসপাতালে ঠিক তখনই পরের দিন, ফোনে ফের সাপের ভিডিও দেখতে শুরু করেন সুরজ কুমার। এবার কোবরা সাপের ভিডিও দেখতে থাকেন। সেবারের ভাইপার সাপের কামড়ে আথরার এমন দশা হয়েছিলো যে তাকে ৫২ দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো। 

২২ এপ্রিল তার বাবা-মা যখন তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যায় তখন মেয়েটি হাঁটতেও পারছিলো না। আথরা হাসপাতাল ছাড়ার ১৫ দিনের মাথায় ৬ মে কুমার আরেকটি সাপ যোগাড় করে ফেলে। আর সেটি নিয়ে আথরার বাবার বাড়িতে যায়। আর এবার সাপটি ছিলো বিষধর কোবরা। 

এবার আথরাকে চেতনা নাশক মিশিয়ে জুস খেতে দেয়। আর সে যখন ঘুমিয়ে পড়ে, বিষধর সাপটিকে আথরার শরীরের উপর ছুঁড়ে দেয় সুরজ কুমার। কিন্তু সাপটি তাকে একটি কামড়ও দেয় না। তখন সাপটির ঘাড়ে ধরে সেটিকে দিয়ে আথরার বাম বাহুতে পর পর দুটি দংশন করায়। 

এবারো সুরজ কুমার চেষ্টা করে বিষয়টিকে দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে। কিন্তু পরিবারের সন্দেহ দানা বাঁধে। বিশেষ করে দংশনের স্থানটি, আর দংশনের গভীরতা থেকে দেখা যায়, কোবরার সাধারণ দংশনে এতটা গভীর ক্ষত হওয়ার কথা নয়, আদালতে বিশেষজ্ঞরা তেমনই মত দেন। আরো একটি কারণে সন্দেহ জাগে, তা হচ্ছে- কোবরা কখনো তাকে আঘাত না করলে দংশন করে না। আর রাত ৮টার পর কোবরা সাধারণত ঘুমিয়ে যায়। 

এছাড়া একটি কোবরা কি করে রাতে আথরার শোবার ঘরে ঢুকে পড়বে সেটা নিয়েও সন্দেহ দেখা দেয়। এছাড়া কোবরা যখন ফনা তোলে তখন ১৫২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে যায়, কিন্তু আথরার যে বাহুতে দংশন হয়েছে সেটি মাত্র ৫০ সেন্টিমিটার উঁচুতে ছিলো। এছাড়ার ঘরের দরজা জানালা বন্ধ ছিলো এমনকি ভেন্টিলেটরও আটকানো ছিলো। এসব থেকে আদালত নিশ্চিত হয়, আথরাকে সাপ নিজে দংশন করেনি, দংশন করানো হয়েছে। আর তা ঘটিয়েছে আথরার স্বামী সুরজ কুমার।