অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

হঠাৎ ডিজেল ফার্নেস অয়েলের দাম কেনো বাড়লো? 

ওমর তাসিক, সাংবাদিক ও লেখক

প্রকাশিত: ১২:৩৯ এএম, ৫ নভেম্বর ২০২১ শুক্রবার  

বিগত কয়েকবছর ধরেই প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। কখনো পেঁয়াজ কখনো আদা, কখনো চিনি, কখনো চাল আবার কখনো ভোজ্যতেলের দাম লাগামহীন ভাবে বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছুচ্ছে যে তা সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।

মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রতিদিন তাদের নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের তালিকা থেকে ক্রয়ের পরিমাণ কমাতে কমাতে এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে পরিবারগুলো জীবনের অনেক কিছু ছাড়াই দিন পার করার অভ্যস্ততা অর্জন করছে।

এই দেড় বছরের করোনা পরিস্থিতিতে দেশের কোটি কোটি মানুষ চাকরি, ব্যবসা ও দৈনন্দিন কাজ হারিয়েছে। জরিপ বলছে, করোনার ফলে দেশে অতিদারিদ্র্যের সংখ্যা বেড়ে ৪২ ভাগে দাঁড়িয়েছে। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী ঠিক মতো দুবেলা খাবার যোগাড় করতে পারে না, তার উপর ঘন ঘন এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় সাধারণ মানুষের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠছে। আসলে এদেশে হাতেগোনা একশ্রেণির মানুষ ছাড়া কেউই সেই অর্থে ভালো নেই। 

গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে বর্তমান দিনগুলোতে প্রতিটি মানুষ করোনা কালীন ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার প্রাণান্তকর সংগ্রাম করে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো করোনার সময় বাংলাদেশের প্রায় সব পরিবারই তাদের সমস্ত সঞ্চয় ভাঙিয়ে দিনাতিপাত করেছে। একথা অনস্বীকার্য যে দেশে আবার আরেকটি করোনা আসলে তার অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলানো এদেশের কারো পক্ষেই আর সম্ভব হবে না। 

আবার বিচিত্র এইদেশে এর উল্টো চিত্রও রয়েছে তা হলো দেশে হঠাৎ করেই কোটিপতির সংখ্যা অস্বাভাবিকহারে বাড়তে শুরু করেছে। একদিকে যেমন  দরিদ্রের সংখ্যা বেড়ে ৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে আবার অন্যদিকে রাতারাতি কোটিপতির সংখ্যাও বেড়ে ১ লাখে দাড়িয়েছে। এছাড়া শত আর হাজার কোটিপতির সংখ্যার কম নয়। এসব গড় করেই দেশের মাথাপিছু আয়ের হিসাব হু হু করে বাড়ছে। যদিও বলা হচ্ছে মাথা পিছু আয় বেড়ে ২৫০০ ডলারে পৌঁছেছে তবে বাস্তবতা হলো দেশের ৫ ভাগ লোকও বছরে এই পরিমাণ অর্থ আয় করে না। দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলো আজব এক শুভংকরের ফাঁকি যার সঙ্গে বাস্তবের ন্যুনতম মিল নেই। 

দেশের এই কঠিন পরিস্থিতিতে হঠাৎ ডিজেলের দাম বাড়ানোটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাত। হঠাৎ ডিজেলের এই মুল্যবৃদ্ধি ফলে মুহুর্তেই সকল পন্যের মুল্য আকাশ ছুঁবে আর তা দেশের মানুষের সহনীয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। জনগণের সুবিধা অসুবিধার বিবেচনা ছাড়া এধরণের পরিস্থিতি অতিতেও অনেকবার ঘটেছে যে কারণে ঘনঘন গ্যাসের দাম বাড়া, বিদ্যুতের দাম বাড়া, ভ্যাট বাড়া, ট্যাক্স বাড়া দেখে দেখে মানুষ  প্রতিবাদ করতেও ভুলে গিয়েছে। 

ডিজেল ও ফার্নেস তেল দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন,কৃষি উৎপাদন, শিল্প উৎপাদন ও পরিবহনের মূল চালিকা শক্তি,তাই এই খাতকে সহনশীল পর্যায়ে টিকিয়ে রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অত্যন্ত দক্ষ ও কৌশলী হতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৫৪ লক্ষ টন জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় এবং বিগত ১০ বছর জ্বালানি তেলের দাম কম থাকায় সরকার প্রতিবছর প্রায় ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। কিন্তু এর কোনো সুফল জনগণ পায়নি। জ্বালানি খাতের নীতিনির্ধারক ও কর্মকর্তারা জনগণের কল্যাণে কখনোই জ্বালানি খাতের সাশ্রয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেনি। এতো বছরে বিপিসি প্রচুর লাভ করা সত্বেও জ্বালানি সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত ট্যাংকার তৈরির কোনোরকম  উদ্যোগই নেয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে বেসরকারি খাতের ট্যাংকার এবং দেশের জ্বালানি চালিত পাওয়ার প্লান্টগুলোর অব্যবহৃত ট্যংকারের ক্যাপাসিটি ব্যবহার করলে প্রায় এক বছরের পুরো জ্বালানি সংরক্ষণ করা সম্ভব এবং তাতে যা মুনাফা হওয়ার কথা তা দিয়ে প্রায় তিন বছরের জ্বালানি খাতের মূল্যবৃদ্ধির ভর্তুকি দেয়া সম্ভব কিন্তু সে চিন্তা কেউ কখনো করেনি। 

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো বা কমানো হবে এটি স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া কিন্তু প্রশ্ন হলো জ্বালানি তেলের ক্রয় মুল্য ও এর উপর ধার্য্যকৃত কর ও এর সার্বিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি স্বচ্ছভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরাটাও যে জরুরি সেকথা কেউ আমলে নেয়নি। এছাড়া জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টাও স্বচ্ছ না। 

এবার হঠাৎ করে যে ডিজেল ও ফার্নেস তেলের মুল্য ২০ ভাগের বেশি বাড়ানো হলো তার কোনো সুস্পষ্ট হিসাব কোনো মাধ্যমেই প্রকাশ করা হয়নি। এমন কি জ্বালানি কেনার উৎস ও এর ক্রয়পদ্ধতির স্বচ্ছতা প্রকাশ নিয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। বহুকাল ধরে বাংলাদেশে তেল পরিশোধন ও পরিবহন খাতে অপরিসীম দুর্নীতি চলে আসছে এবং এ নিয়ে বহু রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু বিপিসি বা জ্বালানী মন্ত্রণালয় কখনোই এসবের তোয়াক্কা করেনি। 

দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা না করে কথায় কথায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির মতো দায়িত্বহীনতা এখন নিয়মে পরিনত হয়েছে। বি ই আর সি নামক সংস্থাটি শুধু এসব অনিয়মের বৈধতা দেয়ার প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কাজ করছে। এবার হঠাৎ করে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির এক অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছে বিপিসি তা হলো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে ভারতে তা পাচার বন্ধ হবে। এই হাস্যকর যুক্তি শুনলে মনে হয় যে জনগণের করের পয়সায় নিয়োজিত সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিষ্ক্রিয় তাই সে দায়িত্ব বিপিসি নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করছে যে, হঠাৎ করে ডিজেল ও ফার্নেস তেলের দাম বাড়ানোটা আরেকদফা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ভিত তৈরিরই প্রাথমিক পদক্ষেপ। সরাসরি জনসেবায় সম্পৃক্ত কিছু মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনা ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে তাদের সেবার ব্যয় এতোটাই অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যে তা জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এর ফলে এতো উন্নয়ন করা সত্বেও সরকার সাধারণ জনগনের অন্তরে ঠাঁই পাচ্ছে না। এর খেসারত দিন শেষে সরকারকেই দিতে হবে।