অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

কৃষকের স্বজন কাকতাড়ুয়া

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট

প্রকাশিত: ০৫:১৫ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০২০ রোববার   আপডেট: ০৫:৩৪ পিএম, ২৫ অক্টোবর ২০২০ রোববার

ফসলি জমি যারই হোক, একজন কিন্তু রাত-দিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, দু’পাশে দুহাত উঁচু করে পশু-পাখির হাত থেকে ফসল রক্ষা করে চলে। আবার বিশ্বস্ত এই প্রহরীকে, তার এই সতর্ক নিরবিচ্ছিন্ন পাহারার জন্য কোন পারিশ্রমিকও দিতে হয়না। আর এ নিয়ে প্রহরীর কোনো অভিমানও নেই। প্রহরী শুধু দাঁড়িয়েই থাকে, আর মাসের পর মাস পশু-পাখির হাত থেকে ফসল রক্ষা করে চলে। বলছি, গ্রাম বাংলার কৃষকের বিশ্বস্ত বন্ধু , কাকতাড়ুয়ার কথা।
  
কাকতাড়ুয়া হচ্ছে কাক কিংবা অন্যান্য পশু-পাখিকে ভয় দেখানোর জন্য জমিতে রাখা মানুষের প্রতিকৃতি বিশেষ। এর মাধ্যমে পশু-পাখিকে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। সহজ কথায়, পশু-পাখি ভাবে জমিতে মানুষের উপস্থিতি আছে, তাই তারা ফসলের কাছে আসেনা। তারা মনে করে, একজন মানুষ জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গেলেই ধরা। চোর-পুলিশ খেলার মতো অনেকটা।
 
আবহমান কাল থেকেই গ্রাম বাংলার কৃষকরা তাদের ক্ষেতের ফসলকে পশু-পাখি ও ইঁদুরের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য অভিনব পদ্ধতির এই প্রহরীর চরিত্রকে রূপদান করেছেন। কে কবে করেছেন, তার কোন ইতিহাস না থাকলেও, কৃষকরাই যে এর স্রষ্টা তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সুদূর অতীত থেকে,  কাকতাড়ুয়াকে ফসলের ক্ষেতে কখনো বড় বড় চোখে, কখনো একই রকম হাসিতে, মাথা বাঁকা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সতর্ক চাহনি তার, চোখের পলক পর্যন্ত ফেলেনা!

কাকতাড়ুয়া বাঙালি হৃদয়ে এতটাই জায়গা করে নিয়েছে যে, কৃষকের ফসলের ক্ষেত থেকে উঠে এসেছে লেখকের গল্প, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সিনেমায়। কখনো কখনো শিল্পীর ক্যানভাসে, রঙতুলির আঁচড়ে রঙিন হাসিও হাসে সে। কাকতাড়ুয়া কিন্তু একদিনে কিংবা অযথা আসেনি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কৃষকের আত্মিক যোগাযোগ, আত্মবিশ্বাস, ভালবাসা, প্রেম। কৃষকরা বিশ্বাস করেন, কাকতাড়ুয়া স্থাপন করলে ক্ষেতের ফসল দেখে কেউ ঈর্ষা করবে না বা ফসলে কারো নজর লাগবে না, পশু-পাখি-ইঁদুর ফসল নষ্ট করতে পারবে না। ক্ষেতের ফসল অনেক ভাল হবে।

বিভিন্ন চরিত্রের কাকতাড়ুয়ার দেখা মেলে গ্রামাঞ্চলের ফসলী ক্ষেতে। খড় দিয়ে কিংবা বাঁশ দিয়ে তৈরি করা মানুষের শরীরের মতো শরীরে কেউ কেউ বাড়ির পরিত্যক্ত ছেঁড়া জামা বা পাঞ্জাবি পরিয়ে দেয়। খুঁটিতে ছন বা খড় পেচিয়ে পেট ফুলিয়ে মোটাসোটা করা হয় কোন কোন কাকতাড়ুয়াকে। মাথায় বসানো হয় মাটির হাঁড়ি। হাঁড়িতে চুন দিয়ে রঙ দিয়ে বিশাল বিশাল চোখ আঁকা হয়। যেন চোখ বড় বড় করে দেখছে। অভিব্যাক্তিটা এমন, ফসল নষ্ট করলেই খবর আছে! কারো মুখে থাকে রাগ, কারো বা টেনশন!   

ডিজিটাল এ সময়েও গ্রামাঞ্চলে কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার এখনো চোখে পড়ে। ফসল রক্ষায় কৃষকরা সনাতন পদ্ধতির কাকতাড়ুয়ার ব্যবহার এখনো করেন বেশ আয়োজন করে। ফসলের কোনো ক্ষতি হবে না এমন আত্মবিশ্বাস থেকেই কৃষকরা ক্ষেতে কাকতাড়ুয়া স্থাপন করেন। তাছাড়া একজন কৃষকের একার পক্ষে সবসময় জমি দেখাশোনা করা সম্ভব হয়না। সেজন্য কাকতাড়ুয়া বানান তারা। 

সুপ্রাচীনকাল থেকে কৃষকের বন্ধু কাকতাড়ুয়া। জমি আর ফসলের সঙ্গেই বসবাস কৃষকের। সারাদিন জমিতে থাকতে থাকতে, একরকমভাবে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা জড় এই বস্তুটির (কাকতাড়ুয়ার) সঙ্গে কৃষকেরও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অলস দুপুরে, একাকী সময় কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে সময়ও কাটানো যায়। অনেক না বলা কথাও বলা যায়, বোবা-বিশ্বস্ত এই বন্ধুকে। একাকিত্ব কাটিয়ে কাকতাড়ুয়াও হয়ে যায় কৃষকের কাছের বন্ধু। কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে কাটানো সময়গুলো তাই কৃষকরা ভুলতে পারেননা ফসল ঘরে উঠে গেলে, জমি ফসল শূন্য হলেও। আপনজনকে কি ভোলা যায়? কাকতাড়ুয়া যে কৃষকের ঘরেরই স্বজন!