অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

মুদি দোকানী থেকে মানবপাচার করে তিন ওভারসিজের মালিক টুটুল

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০২:৪৫ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০২:৪৬ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২১ বুধবার

মুদি দোকানদার থেকে ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা টুটুল ও তার সহযোগীসহ আটজনকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুলের (৩৮) বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী থানাধীন কামন্দী গ্রামে। এইচএসসি পাস টুটুল প্রথমে ছিলেন মুদি দোকানদার। ঢাকায় নিয়মিত আসা যাওয়া করতেন তিনি। এক পর্যায়ে অধিক লাভের আশায় জড়িয়ে পড়েন মানবপাচার চক্রে। 

শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানোর কাজ করতেন টুটুল। পরে নিজেই খোলেন তিনটি ওভারসিজ প্রতিষ্ঠান। তবে ওই তিন প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় অন্য বৈধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বেকার ও শিক্ষিত অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে বিদেশে পাচার করেন তিনি। হাতিয়ে নেন কোটি টাকা।

টুটুলের এ প্রতারণার কাজে অন্যতম সহযোগী মো. তৈয়ব আলী (৪৫)। চায়ের দোকানদার হলেও পরিচয় দেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। এর আড়ালে টুটুলের মানবপাচার চক্রের সহায়তায় অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে প্রেরণ এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

টুটুল ও সহযোগী তৈয়বসহ ৮ জনকে গ্রেফতারের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব-৪। গ্রেফতার বাকিরা হলেন: গোপালগঞ্জের শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), মেহেরপুরের মো. মারুফ হাসান (৩৭), জাহাঙ্গীর আলম (৩৮) ও লালটু ইসলাম (২৮), শরীয়তপুরের আলামিন হোসাইন (৩০), কুষ্টিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন (৫৪)। 

বুধবার (১৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক এসব তথ্য জানান। 

তিনি বলেন, সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভিকটিমের অভিভাবকের মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচার সংক্রান্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব-৪ ছায়া তদন্ত শুরু করে ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (১২ অক্টোবর) রাত থেকে আজ বুধবার সকাল পর্যন্ত বাড্ডা থানাধীন লিংক রোডে টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজে অভিযান চালিয়ে দুই নারীসহ চারজন ভিকটিম উদ্ধার, ১০টি পাসপোর্ট, ৭টি ফাইল, ৪টি সিল, ১৭টি মোবাইল, ৫টি রেজিস্টার, ব্যাংকের চেক বই, ২টি কম্পিউটার, ৩টি লিফলেট এবং নগদ ১০ হাজার টাকা জব্দ করা হয়। এ সময় মানবপাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

মানবপাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পন্ন করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করে আসছিলেন।


র‌্যাব কর্মকর্তা জানান, প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে চক্রের সদস্যরা টার্গেট সংগ্রহে দেশের বেকার ও অসচ্ছল যুবক-তরুণীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নামে প্রলুব্ধ করত। এরপর বিদেশ যেতে আগ্রহীদের ঢাকায় মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে পাঠাত।


মোজাম্মেল হক বলেন, টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে এনে ভিকটিমদের বিদেশে বাসাবাড়িতে কাজের নামে পাঠানোর ভুয়া মানি রিসিট প্রদান করে। এ বাবদ প্রতিজনের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নিত তারা। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতেন চক্রের সদস্যরা।

তিনি বলেন, চক্রের কয়েকজন সদস্য অফিস স্টাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভিকটিমকে বিদেশে পাঠানোর জন্য পাসপোর্ট করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করত। এতে ভিকটিমদের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকত না। পাসপোর্ট অফিসের দালালের সঙ্গেও সখ্য ছিল চক্রের সদস্যদের। কথিত মেডিকেল টেস্ট শেষে নারী ভিকটিমদের বাসাবাড়িতে বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ, জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত তারা। ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারত না। যাদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হতো না তারা টাকা ফেরতে যোগাযোগ করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো।

মোজাম্মেল হক বলেন, চক্রের অন্যতম মূলহোতা গ্রেফতার তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে যোগাযোগ করে। এরপর নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসত। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চাকরির যোগদানপত্র প্রদান করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে। বিষয়টি এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তিনি।

বৈধতা না থাকার পরও কীভাবে মানবপাচার করেছিল টুটুল-তৈয়ব চক্র? জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, তাদের তিন ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। এছাড়া শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠানো কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ২৫ জনের মতো ভুক্তভোগী র‌্যাবে যোগাযোগ করেছেন। প্রতারিত ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।