অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম রোধে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ 

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

প্রকাশিত: ০৭:৫১ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২১ সোমবার  

বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম বড় দুইটি ঝুঁকি হিসেবে বাংলাদেশে কন্যাশিশুদের জীবনে প্রভাব ফেলছে। দারিদ্রতার কারনে শিশুরা বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমে জড়িত হচ্ছে যাতে করে কন্যা শিশুরা শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝড়ে পড়ছে এবং এর সাথে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে তৈরি অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় এই দুই ধরণের অবিচার বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দুই দশকে কন্যাদের অধিকার এবং ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্য থাকলেও সামাজিক অবিচার যেমন বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম রোধে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার বাংলাদেশে হয়না বললেই চলে। 

আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালনের অংশ হিসেবে সোমবার (অক্টোবর ১১) ব্র্যাকের জেন্ডার, জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচির আয়োজনে “বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম রোধে প্রযুক্তির ভূমিকা” শীর্ষক এক সংলাপের আয়োজন করা হয় ব্র্যাক সেন্টারে যেখানে আলোচকেরা বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম রোধে কার্যকর তবে অব্যবহৃত প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়ে দাবি জানান। 

আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। 

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বলেন, বাল্যবিবাহ বা শিশুশ্রম প্রতিরোধে সর্বপ্রথম কন্যা শিশু এবং ছেলে সন্তানের মধ্যে সমাজের তৈরি করা যে পার্থক্য তা দূর করতে হবে। মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন না হলে প্রযুক্তি, প্রকল্প বা পরিকল্পনা এই সমস্যা দূরীকরণে কোন কাজে লাগবেনা। বাল্যবিবাহ রোধে আমরা বন্ধন (bondhon.gov.bd) নামে একটি পোর্টাল তৈরি করেছি যেখানে ভেরিফাই করা যায় এমন ডকুমেন্ট বাদে বিবাহ অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন হবেনা ফলে বাল্যবিবাহের আর সুযোগ থাকবেনা। এই পোর্টালটি খুব শীঘ্রই উন্মুক্ত করা হবে।”

এছাড়া শিশুশ্রম রোধে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি। এসময় প্রযুক্তির মাধ্যমে বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম রোধে আইসিটি ডিভিশন এবং ব্র্যাকের একসাথে কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি। 

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বাল্যবিবাহ এবং শ্রম থেকে মেয়েশিশুদের রক্ষা করতে প্রযুক্তির ব্যবহার আরো জোরালো করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের চিন্তা-ভাবনায় কন্যাশিশু এবং ছেলেশিশুর মধ্যে তফাৎ করার যে মানসিকতা রয়েছে তা দূর করা নিয়ে কাজ করতে হবে। আমাদের আইন আছে, তবে এর যথাযথ প্রয়োগ যারা করবেন তাদের হাতে প্রযুক্তিগত সমাধান তুলে দিতে হবে। বাল্যবিবাহ কেন হয় তা নিয়ে আমাদের আরো ভাবতে হবে। সেই কারণগুলো খুঁজে বের করে অভিভাবকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে ক্রমাগত কাজ করে যেতে হবে। ” 

প্রযুক্তি এবং ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কন্যাশিশুদের সুযোগ ছেলেশিশুদের তুলনায় কম উল্লেখ করে তিনি এই সুযোগ প্রদানে সমতা নিশ্চিত করতে সবার প্রতি আহবান জানান।

ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, 'বাংলাদেশে জন্মনিবন্ধন ডিজিটাল করার কাজ শুরু হলেও, এখনো বিয়ে বা কাজে নিয়োগের জন্যে জন্মনিবন্ধন সনদ ডিজিটালি যাচাই করার কোন বাধ্যবাধকতা নেই বা বিবাহ রেজিস্ট্রশনকে ডিজিটাল করার কোন উদ্যোগ নেই। পুরো প্রক্রিয়াগুলোতে তাই এখনো সনদ জালিয়াতি বা ভুয়া দলিলপত্র দিয়ে কাজ সারার উপায় থেকে যাচ্ছে। এর ফলে, বাল্যবিবাহ বা শিশু শ্রমে নিয়োজিতদের কোন পূর্ণ পরিসংখ্যানও থাকছেনা। ১৩ বছরের মেয়েকে ১৮ লিখে বিয়ে দেওয়া যাচ্ছে, কাজেও নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে। এই পুরো প্রক্রিয়া থেকে আমাদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে জন্মনিবন্ধন সনদকে সম্পূর্ণত ডিজিটালকরণ এবং বিবাহ নিবন্ধন, কাজের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যাচাইকরণকেও ডিজিটাল পদ্ধতির আওতা ভুক্ত করা।'

এই প্রেজেন্টেশনের পরে প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশ মুসলিম নিকাহ (বিবাহ) রেজিস্ট্রার সমিতির সভাপতি (ঢাকা জেলা) মোহাম্মদ আবদুল ওয়াহেদ তার বক্তব্যে বিবাহ রেজিস্ট্রেশনকালে বয়স নির্ধারনী প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন কিভাবে বাল্যবিবাহ রোধে সহায়ক হতে পারে তা নিয়ে আলাপ করেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এর ন্যাশনাল স্পেশালিস্ট এবং প্রোগ্রাম কোওর্ডিনেটর, সৈয়দা মুনিরা সুলতানা বাংলাদেশে শিশুশ্রম রোধে চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলাপ করেন এবং শ্রম শাসন এবং পরিদর্শন ব্যাবস্থা শক্তিশালিকরনে প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগগুলো নিয়ে বক্তব্য রাখেন।
 
প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ পুলিশের জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ তবারক উল্লাহ হেল্পলাইন ৯৯৯-এর মাধ্যমে করোনাকালে কিভাবে বাল্যবিবাহ রোধ করা হয়েছে। 

সামাজিক অবিচার যেমন বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম রোধে কোন প্রুযুক্তিগত সমাধান তৈরির সময় সেখানে দেশের এবং দেশের বাইরের বিভিন্ন উদাহরন নিয়ে সেখানে লিঙ্গ ভিত্তিক বিষয়গুলো যোগ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল এবং কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. নোভা আহমেদ । 

আলোচনার শুরুতেই ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রোগ্রামের অ্যাডভোকেসি লিড তাকবির হুদা তার প্রেজেন্টেশনে বলে “বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনি সুরক্ষাগুলোকে আরও কার্যকরী ভাবে প্রয়োগ করতে হলে অবশ্যই জন্ম নিবন্ধক, বিবাহ নিবন্ধক এবং শ্রম পরিদর্শকদের ডিজিটাল যাচাইকরণ সরঞ্জাম দিয়ে সজ্জিত করার দিকে জোর দিতে হবে। সরকার ইতোমধ্যে বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম মোকাবেলায় প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে, যেমন নানান জাতীয় হেল্পলাইন প্রবর্তন, জন্ম নিবন্ধন ব্যবস্থা ডিজিটালাইজ করা, লিমা নামের শ্রম পরিদর্শন অ্যাপ ডেভেলপ করা এবং কুড়িগ্রামে পাইলট আকারে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ অ্যাপ, তাই আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন এই ইন্টারভেনশনগুলোকে শক্তিশালী করার দিকে।”

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এর মাল্টিপল ক্লাস্টার ইন্ডিকেটর জরিপ ২০১৯ অনুযায়ী অতিমারির পূর্বকালীন সময়ে বাংলাদেশে ৫১% বিয়েতেই কনের বয়স ১৮ বছরের কম। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী করোনাভাইরাস মহামারির ফলে নতুন করে আড়াই কোটি মানুষ গরিব হয়েছে। এই কারণে বেড়েছে বাল্যবিবাহও। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শ্রমজীবী কন্যা শিশুর সংখ্যাও বেড়েছে অনেকাংশে।  চলতি বছরের জুনেই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইউনিসেফ জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রভাবে দক্ষিন এশিয়া সহ সারা বিশ্বে লাখো শিশু এখন শ্রমে জড়িত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।  

সারাবিশ্বে ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস পালনের অংশ হিসেবে কন্যাশিশুদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে এবং তাদের মানবাধিকার রক্ষায় গুরুত্ব আরোপ করে।  এই বছর ‘ডিজিটাল জেনারেশন, আওয়ার জেনারেশন’ শীর্ষক থিমে আন্তর্জাতিকভাবে কন্যাশিশুদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আনন্দ এবং অমিত সম্ভাবনায় তাদের ডিজিটাল সলিউশনের মাধ্যমে প্রস্তুত করার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া হচ্ছে। বিশেষ এই দিনে বিশ্বের শীর্ষ উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকও বাংলাদেশের কন্যাশিশুদের জীবনে গুরুত্তপূর্ন বিষয়- বাল্যবিবাহ এবং শিশুশ্রম- এর দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করছে।