মিল্কভিটার জায়গায় খামারিদের কারখানা, দুধ পায়না মিল্কভিটা
রিজভী জয়, পাবনা
প্রকাশিত: ০২:১৭ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার আপডেট: ০২:২৫ পিএম, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার
দেশে দুগ্ধ শিল্পের প্রসারে ১৯৭৩ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে তৎকালীন পাবনা জেলার বড়াল নদের তীরে বাঘাবাড়ীতে গড়ে তোলা হয় সমবায়ভিত্তিক দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা। মিল্কভিটাকে কেন্দ্র করে পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় দুগ্ধ শিল্পে নবযাত্রার সূচনা হয়।
দাম বেশী পাওয়ায় মিল্কভিটার পরিবর্তে অবৈধ কারখানায় দুধ সরবরাহ করছে চুক্তিভুক্ত খামারিরা
মিল্কভিটার জায়গায় অবৈধ দুগ্ধ শীতলীকরণ কারখানা খামারিদের, সেই দুধ পাচ্ছে অন্য কারখানা
কাংখিত সরবরাহ না পেয়ে অর্ধেকে নেমেছে মিল্কভিটার দুধের উৎপাদন
সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় ব্যবস্থা নিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ
অস্বাস্থ্যকর কারখানায় বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় মিল্কভিটাকে কেন্দ্র করে ২৫ হাজার দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিদিন গড় গরুর দুধের উৎপাদন ১০ থেকে ১২ লাখ লিটার। মিল্কভিটা ছাড়াও অন্তত ১৫টি অনুমোদিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ অঞ্চলের খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে।
মিল্কভিটার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৩,৪৭৪ টি প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতি মিল্ক ভিটার সাথে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। এসব সমিতির সদস্য প্রায় দেড় লাখ দুগ্ধ খামারি। সেসব খামার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৭.৫ লাখ লিটার উৎপাদিত হয়। তবে সম্প্রতি তালিকাভুক্ত খামারিরা লোকসানের অজুহাতে মিল্ক ভিটায় দুধের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এতে মিল্ক ভিটার উৎপাদন আশংকাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুধ শীতলীকরণ করে, স্বাস্থবিধি না মেনে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে দুধ সরবরাহ বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
মিল্কভিটা জোনের আওতাভুক্ত পাবনার ফরিদপুর উপজেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম আরকান্দি। গত কয়েক দশকে এ গ্রামে দুধের উৎপাদন বেড়েছে ব্যপকভাবে। মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামটিতে দুগ্ধশিল্প গড়ে উঠলেও এখন মিল্কভিটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এখানকার খামারিরা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া এবং কাংখিত মুল্য না পাওয়া এবং সময়মত বোনাসের টাকা না পাওয়ার অভিযোগে মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহে আগ্রহ নেই তাদের। এই সুযোগে মিল্কভিটায় চুক্তিবদ্ধ সমিতিগুলোও বেছে নিয়েছে অসাধু পন্থা। মিল্কভিটা জোনে অনুমতি ছাড়া দুগ্ধ শীতলীকরন কেন্দ্র গড়ে তোলা নিষিদ্ধ হলেও, তার তোয়াক্কা না করে অবৈধ দুগ্ধ শীতলীকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা। খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে তা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের দুগ্ধ কারখানা ও মিষ্টির কারখানাগুলোর কাছে বিক্রি করছেন। বাজারজাত করণের নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে ও স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই নিজেদের ইচ্ছামত দুধ বাজারজাত করছে খামারি ও দুগ্ধ সমবায় সমিতি। এতে, রাষ্ট্রয়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার দুধের উৎপাদন আশংকাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে।
সরেজমিনে আরকান্দি বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ব্যক্তি উদ্যোগে এ গ্রামে মিল্কভিটায় চুক্তিবদ্ধ সমিতির সহায়তায় গড়ে উঠেছে ৫ টি অবৈধ দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র। গ্রামের একটি প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতির সভাপতি আব্দুল মমিন জানান, তাদের সমিতিতে প্রায় ৬৭ টি গরু রয়েছে। প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৩০ লিটার দুধ হয়। কয়েক মাস আগেও পুরো দুধটাই মিল্ক ভিটায় সরবরাহ করা হত। কিন্তু উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও কাংখিত দাম না পাওয়ায় তারা এখন নিয়মিত ভাবে মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করছেন না।
আব্দুল মোমিন আরও বলেন, মিল্ক ভিটায় দুধের ফ্যাট দেখে দাম নির্ধারণ করা হয়। ফলে লিটারে ৩৫ থেকে ৪০ টাকার বেশি দাম তারা পান না। ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় ব্যক্তিগত শীতলীকরণ কেন্দ্রে দুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে লিটার প্রতি কমপক্ষে ৪৫-৫০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
আরকান্দি পরামানিকপারা প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতির সভাপতি মোঃ মোহর আলী নিজেই গড়ে তুলেছেন একটি দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র। মিল্কভিটার সমিতির সদস্যদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে তার কারখানায় শীতলীকরণ করে রাজধানীর বিভিন্ন প্রাইভেট কোম্পানির কাছে বেশি মুল্যে বিক্রি করছেন তিনি ।
মোহর আলী বলেন, প্রতিদিন ৫০০ থেকে ১০০০ লিটার দুধ খামারিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে শীতলীকরণ করে পানির ট্যাঙ্কে ভরে ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন তিনি।
প্রায় দুই মাস ধরে তিনি মিল্কভিটা জোনে অনুমোদনহীন শীতলীকরণ কেন্দ্র থেকে হাজার হাজার লিটার দুধ মান নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বাজারজাত করলেও কেউ তাকে বাধা দেয়নি।
মোহর আলী আরও জানান, তাদের পাঠানো দুধ ঢাকার বিভিন্ন মিষ্টির কারখানা, ছানার কারখানা, আইসক্রিমের কারখানা এবং তরল দুধ হিসেবেও বিক্রি হচ্ছে।
এসব প্রতিষ্ঠানে দুধ বাজারজাতকরণ করতে ফ্যাটের ঝামেলা না থাকায় কৃষকরা কাংখিত দাম পাচ্ছেন। বাঘাবাড়ি জোনে এ ধরণের প্রায় ১০ থেকে ১২ টি ব্যাক্তি মালিকানার শীতলীকরণ কেন্দ্র আছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে চুক্তিবদ্ধ খামারিরা চাহিদামত দুধ সরবরাহ না করায় মিল্কভিটায় দুধের সরবরাহ কমে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। মিল্কভিটার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (উৎপাদন) ড. খোন্দকার মোঃ আমিনুল ইসলাম বলেন, কয়েকমাস আগেও মিল্ক ভিটা প্রতিদিন ১ লাখ ৮০ হাজার লিটার থেকে দুই লাখ লিটার দুধ প্রক্রিয়াজাত করলেও বর্তমানে মাত্র ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ লিটারের বেশি দুধ উৎপাদন করতে পারছে না।
মিল্কভিটার ব্যাবস্থাপক (সমিতি) মোঃ রেজাউল করিম বলেন, বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা জোনের (পাবনা ও সিরাজগঞ্জ) আওতায় রয়েছে সর্বাধিক ৭ শতাধিক প্রাথমিক দুগ্ধ সমিতি। যার মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৩০০ থেকে ৩৫০ টি সমিতি মিল্ক ভিটায় দুধ সরবরাহ করছে। গত জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ লিটার করে দুধের সরবরাহ পাওয়া গেলেও এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার লিটারে।
বাঘাবাড়ী জোনের ব্যবস্থাপক বাবুল আক্তার জানান, চুক্তিবদ্ধ সমিতির সদস্যরা মিল্কভিটা থেকে গো-খাদ্যের জন্য ঘাসের জমির সুবিধা, গবাদি পশুর চিকিৎসা সুবিধা, সহজ শর্তে ঋণের সকল সুবিধা নিয়েও চাহিদামত দুধ সরবরাহ না করে বাইরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে, বাঘাবাড়ি মিল্ক ভিটার উৎপাদন কমে গেছে।
এ বিষয়ে কথা হয় মিল্কভিটার চেয়ারম্যান নাদির হোসেন লিপুর সঙ্গে। তিনি বলেন, দুধের গুনগত মান ভাল না হলে মিল্কভিটা সে দুধ গ্রহণ করে না। মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ করতে হলে কমপক্ষে ৩.৫ শতাংশ ফ্যাট থাকতে হবে। ল্যাকটোমিটারে পরীক্ষার পর দুধের গুনগত মান যাচাই করে তা সংগ্রহ করা হয়। অনুমোদনহীন কারখানায় দুধ সরবরাহ করতে গুণগত মান যাচাই করতে হয়না বলেই, খামারিরা বেশি লাভের আশায় মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহ না করে ব্যক্তি উদ্যোগে বাজারজাত করছেন।
তিনি আরও বলেন, মিল্কভিটা গত প্রায় এক বছরে দুই দফায় প্রায় ৪ টাকা লিটারপ্রতি দুধের দাম বৃদ্ধি করেছে খামারিদের স্বার্থে। তবে বাজারে এখন দুধের আরও চড়া দাম থাকায় অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে দুধ বাজারজাত করছে। অবৈধ দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দুধ বাজারজাত করা হলেও সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায় এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে তিনি স্থানীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
পাবনা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ আল মামুন হোসেন বলেন, অনুমোদন ছাড়া যত্রতত্র দুগ্ধ শীতলীকরণ কেন্দ্র বা কারখানা করা যায়না। দুধ সংগ্রহ ও বাজারজাতে অনেক সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগের কাছে অবৈধ কারখানার বিষয় কোন তথ্য জানা নেই। খোঁজ নিয়ে এ ব্যাপারে নজরদারী বাড়ানো হবে। পাশাপাশি মিল্ক ভিটাকেও এগিয়ে আসতে হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।