অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পাবনায় অর্ধলাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত

রিজভী জয়, পাবনা

প্রকাশিত: ০১:৫৯ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০২:০১ পিএম, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ শনিবার

করোনায় বাল্য বিয়ে ও আর্থিক কাজে জড়িয়ে ঝরে পড়েছে শিক্ষার্থীরা

করোনায় বাল্য বিয়ে ও আর্থিক কাজে জড়িয়ে ঝরে পড়েছে শিক্ষার্থীরা

#    করোনায় বাল্য বিয়ে ও আর্থিক কাজে জড়িয়ে ঝরে পড়েছে শিক্ষার্থীরা
#    আর্থিক সংকটে বন্ধ দুইশতাধিক কিন্ডারগার্টেন ও ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
#    বেকার হয়েছেন চার হাজার শিক্ষক-কর্মচারী।

পাবনা সদর উপজেলার সাদিপুর গ্রামের দুই শিশু রাহাদ। গত শিক্ষাবর্ষেও রাহাদ গোপাল চন্দ্র ইনস্টিটিউশনে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়তো। তবে, তারা এখন পুরোদস্তুর হোসিয়ারী শ্রমিক। করোনাকালে স্কুল বন্ধ থাকায়, পশ্চিম সাধুপাড়া এলাকার একটি গেঞ্জির কারখানায় কাজ শিখতে দেয় তাদের পরিবার। স্কুল খোলার ঘোষণা এলেও, থমকে যাওয়া শিক্ষা জীবন নতুন করে শুরু করতে আগ্রহী নয় তারা। পরিবারেরও খুব একটা ইচ্ছা নেই। 

শনিবার (১১ সেপ্টেম্বর) কারখানায় কাজ করার সময় কথা হয় শিশু শ্রমিক রাহাদের সাথে। সে জানায় প্রতি সপ্তাহে তার বেতন ১৫০০ টাকা। মাসে আয় ৬০০০। ওভারটাইম করলে আরো বেশী হয়। নিজের হাত খরচের পাশাপাশি তার আয়ের উপর নির্ভরশীলতা এসেছে পরিবারেও। এখন স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই। 

রাহাদের মতো অর্থ উপার্জনে জড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রম ছিটকে পড়ার এ চিত্র জেলার সর্বত্রই। করোনার বিরতিতে বখে যাওয়া ঠেকানোর অজুহাতে ছেলে শিক্ষার্থীদের শিশু হাতকে শ্রমিকের হাতে পরিণত করেছে। আর মেয়েদের গোপনে বিয়ে দিয়েছেন অভিভাবকরা। প্রত্যন্ত গ্রামে তো বটেই শহরের নামকরা মেয়েদের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরাও শিকার হয়েছেন বাল্যবিবাহের। 

পশ্চিম সাধুপাড়া এলাকার হোসিয়ারী মালিক রফিকুল ইসলাম বলেন, করোনায় স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় গ্রাম এলাকার অধিকাংশ বাচ্চারাই মোবাইল ফোনের গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছিল, উঠতি বয়সীরা আরো বিপথগামী হওয়ায় অনেক বাচ্চাদের বাবা মা এসে আমাদের অনুরোধ করে অনেকটা জোর করেই কাজে দিয়ে গেছে। তখন অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় মানবিক বিবেচনায় আমরা তাদের কাজ শিখতে নিয়েছিলাম। এখন স্কুল খোলার পড়েও তারা কাজ ছাড়তে চাইছে না। নিষেধ করার পরেও প্রতিদিন কারখানায় চলে আসছে।

কুঠিপাড়া গ্রামের মইনুদ্দিন শেখ জানান, করোনার বিরতিতে আমাদের এলাকার মাধ্যমিক পর্যায়ের অনেক মেয়েকে গোপনে তাদের বাবা মা বিয়ে দিয়েছে। এমনকি পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীদেরও বিয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখন স্কুল খুললে দেখা যাবে আসলে তারা পড়াশোনায় ফিরবে কিনা।
এদিকে, করোনাকালের দীর্ঘ বিরতি শেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে ১২ সেপ্টেম্বর । তবে, অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও বাল্যবিবাহে জড়িয়ে শিক্ষা কার্যক্রম থেকে প্রায় ঝরে পড়া এসব শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে আনাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে স্বীকার করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরাও। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে দূরে সরে যাওয়া ভাবনায় ফেলেছে শিক্ষক, কর্মকর্তাদের। 

এদিকে,করোনাকালের মন্দায় পাবনায় বন্ধ হয়ে গেছে দুই শতাধিক কিন্ডারগার্টেন ও নন এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আর্থিক সংকটে নতুন করে কার্যক্রম শুরুর সামর্থ্য হারিয়ে, অনিশ্চয়তায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। 

শহরের দক্ষিণ রাঘবপুরের যিহোবা যিরি কিন্ডারগার্টেনের পরিচালক অ্যালবার্ট প্রদীব হাজরা জানান, করোনাকালে তাদের প্রতিষ্ঠানে পাঠদান ছিলনা। অন-লাইন ক্লাসে সাড়া মেলেনি শিক্ষার্থীদের। পাওয়া যায়নি বেতন ভাতাও। আসবাবপত্র বিক্রি করে বাড়িভাড়া পরিশোধ করেছেন তিনি। এখন ভাড়া দোকানে এলপি গ্যাস বিক্রি করে কোন রকমে জীবন কাটছে তার।

জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন ও নন এমপিও শিক্ষক সমতি সূত্রে জানা যায়, করোনার টানা বন্ধে পাবনায় কমপক্ষে ১৫০ টি নন এমপিও স্কুল ও ৫৫টি কিন্ডারগার্টেন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল খোলার প্রস্তুতিতে নষ্ট  আসবাবপত্র মেরামতের সামর্থ্যও নেই এসব প্রতিষ্ঠানের। ফলে নতুন করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। বেকার হয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানের প্রায় চার হাজার শিক্ষক কর্মচারী। অনিশ্চয়তায় পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন। পেশা পরিবর্তন করেছেন কেউ কেউ, মানবেতর জীবন যাপন করছেন এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মকর্তা। নতুন করে স্কুল চালু করতে সরকারী প্রণোদনা ও ঋণ সহায়তা চান তারা।

জেলা কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশনের সভাপতি ফজলে মজিদ মুরাদ বলেন, আমাদের অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে অনেক শিক্ষক এখন সবকিছু হারিয়ে, সবজি বিক্রি করছেন, অটোরিক্সা চালাচ্ছেন। সে পরিস্থিতিতে সরকারী সহায়তা ছাড়া কোন ভাবেই আর স্কুল চালু করা সম্ভব নয়। শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে এলাকাভিত্তিক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রণয়ণ করা প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।

জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম মোসলেম উদ্দিন বলেন, করোনায় বাল্যবিবাহ ও শিক্ষার্থীদের আর্থিক কাজে জড়ানোর খবর পেলেও সঠিক পরিসংখ্যান জানা নেই। স্কুল খোলার পর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের তালিকা করে, অভিভাবকদের বুঝিয়ে তাদের শ্রেণী কক্ষে ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষকদের সহায়তার জন্য তালিকা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রণোদনা দেয়ার কাজও শুরু হয়েছে।