অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১৫]

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৭:৩০ এএম, ৫ নভেম্বর ২০২১ শুক্রবার

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১৫]

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১৫]


[পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার] [পর্ব- পাঁচ] [পর্ব-ছয়] [পর্ব- সাত] [পর্ব-আট] [পর্ব-নয়] [পর্ব-দশ] [পর্ব-এগারো] [পর্ব-বারো] [পর্ব-তেরো] [পর্ব- চৌদ্দ]


পর্ব- পনেরো

একটা অসহায়ত্বের বোধ যেনো গেড়ে বসলো উইনস্টনের মধ্যে। এই বুড়োর স্মৃতিতেতো ফালতু কিছু নোংরামি দুষ্টুমির ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নেই! গোটাদিন প্রশ্ন করলেও তার পেট থেকে প্রকৃতচিত্র কিছু কেউ বের করে আনা সম্ভব নয়। তাহলে কি পার্টির ইতিহাসবেত্তারাই সত্যি লিখেছেন। হতে পারে তারাই পুরোপুরি সত্য। এসব ভাবতে ভাবতে একটা শেষ চেষ্টা চালালো সে।

‘আমি বোধ হয় তোমাকে ঠিক বুঝাতে পারিনি,’ বললো সে। আমি বলতে চাইছি – বয়সতো তোমার ম্যালাই হলো; জীবনের অর্ধেকটা তোমার কেটেছে বিপ্লবের আগে। ১৯২৫ সালের কথাই ধরো, ততদিনে তুমিতো বেশ বড়ই হয়ে উঠেছিলে। তো যতটা স্মরণ করতে পারো তার ওপর ভর করেই বলো- ১৯২৫ সালের সেই জীবন কি এখনকার জীবনের চেয়ে ভালো কিছু ছিলো? তোমাকে যদি পছন্দ করতে বলা হয়, তুমি কোন জীবনটি বেছে নেবে, তখনের নাকি এখনের?’

বাণখেলার বোর্ডের দিকে একটা ধ্যানগ্রস্ত চাহুনি ফেলে রেখেছে বুড়োটি। এবার বিয়ারের গ্লাস তুলে এক চুমুকে পুরোটা খালি করে দিলো। তবে আগের চেয়ে একটু ধীর ধীরে। বলতে শুরু করলো। বিয়ারে নেশা তাকে ধরেছে ঠিকই, তবে কথাবলার ভঙ্গিতে দার্শনিকতার ছাপটা তখনও রয়ে গেছে।

‘আমি জানি তুমি ঠিক কি শুনতে চাইছো,’ বললো সে। ‘তুমি চাইছো আমি বলি, আমি যৌবনে ফিরে যেতে চাই। অনেক মানুষই বলে, তারা যৌবনে ফিরতে চায়। যৌবনে তোমার স্বাস্থ্য ভালো থাকে, শক্তি-সামর্থ থাকে। আমার মতো বয়স যখন হবে তখন তুমিও সুস্থ থাকবে না। আমার কথাই ধরো, এখন পায়ের ব্যথায় ভুগছি, মুত্রথলির দশা যাচ্ছেতাই। রাতে গড়ে ছয়-সাতবার বিছানা থেকে উঠতে হয়। তবে বুড়ো হওয়ার কিছু সুবিধাজনক দিকও আছে বলে রাখি। উদ্বেগের কারণগুলিই হবে ভিন্ন কিছু। নারীর সান্নিধ্য নেই, সেটাও একটা ভালো দিক। আমি তো গত প্রায় ত্রিশ বছর কোনও নারীর সঙ্গে শুইনি। আশা করি বিষয়টা তোমার ভালো লাগছে। আর এসবই তো শুনতে চাও, না- কি?’

জানালার শার্সিতে ঠেস দিয়ে বসলো উইনস্টন। আর কথা চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। তবে বিয়ারতো খাওয়াই যায়। এই ভাবনা থেকে ঠিক যখন ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে তখনই দ্রুত গতিতে বুড়ো ছুটলো কামরার পাশের প্রশ্রাবখানার দিকে। অতিরিক্ত আধা লিটার এরই মধ্যে তার ওপর ক্রিয়া করতে শুরু করেছে। নিজের খালি গ্লাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে এক কিংবা দুই মিনিট তাকিয়ে থাকলো উইনস্টন, এরপর সম্বিত যখন ফিরলো তখন নিজেকে সে আবিস্কার করলো সড়কে। উইনস্টনের মনে হলো, বড়জোর বিশ বছর, এই সময়ের মধ্যে এই যে ‘এখনকার জীবন অতীতের চেয়ে ভালো কি মন্দ ছিলো?’ এমন প্রশ্নটিও উবে যাবে। এর আর উত্তরও যেমন থাকবে না, প্রশ্নটিও অস্তিত্ব হারাবে। আর এখনই কি এর উত্তর মিলছে? যেখানে অতীতের টিকে থাকা গুটিকয় মানুষ বুঝতেই পারছে না তাদের নিজেদেরই অতীত ভালো ছিলো, নাকি বর্তমানটি ভালো। তারা লাখো অপ্রয়োজনীয় ফালতু বিষয় মনে রাখে, সহকর্মীর সঙ্গে একবার যে বচসা বেঁধেছিলো সে কথা, একবার বাইসাইকেলের হাওয়া চলে গেলে কি কষ্টই না হয়েছিলো, বহু আগে মরে যাওয়া বোনটির চেহারার অভিব্যক্তি, সত্তুর বছর আগে কোনও এক সকালে ঘূর্ণিবাতাসে ধুলোদের উড়োউড়ি পর্যন্ত তাদের মনে ধরে আছে- কিন্তু প্রয়োজনীয় সব সত্যই তাদের দৃষ্টির বাইরে। এরা স্রেফ পিঁপড়ার মতো, কেবল ছোট ছোট বস্তুই দেখতে পায়, বড় বস্তু এদের চোখে পড়ে না। স্মৃতি যখন ব্যর্থ, আর নথিগুলো মিথ্যায়নে সিদ্ধ- তখন পার্টির তরফ থেকে জীবনমান উন্নয়নের সকল দাবিই ধোপে টিকে যায়, কারণ অতীতের জীবনমানের কোনো তথ্য বা মাপকাঠী কারো জানা নেই যার সঙ্গে বর্তমানের তুলনা চলে।

ঠিক এটা ভাবতে ভাবতেই উইনস্টনের ভাবনার ট্রেন হঠাৎ থামলো। সে থমকালো, আর চোখ তুলে তাকালো। তখন একটা সরু সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলো। অন্ধকারে গোটা কয় দোকান-পাট বাসাবাড়ি গুলোর মাঝেই স্থান করে নিয়েছে। ঠিক তার মাথার উপর ঝুলছিলো তিনটে রংচটা ধাতব বল। দেখে মনে হচ্ছিলো, একসময় এগুলো চকচকেই ছিলো। স্থানটি তার চেনার কথা। অবশ্যই চেনে! সে এখন ঠিক সেই ভাঙারির দোকানের সামনেই দাঁড়িয়ে যেখান থেকে একদা ডায়রিটি কিনেছিলো।

একটি ভয়ার্ত বেদনা তার শরীরের ভেতর দিয়ে শিরশির করে বয়ে গেলো। নোটবুকটি কেনাই ছিলো এক মস্ত অপরাধ। তখনই শপথ করেছিলো এই পথ আর মাড়াবে না। তবে ভাবনাটাকে স্বাধীন করে দিয়ে সে বুঝতে পারলো, বস্তুত সে নয়, তার পদযুগলই তাকে টেনে এনে দাঁড় করিয়েছে এই দোকানের সামনে। ডায়রি লেখা শুরু করেও নিজেকে রক্ষা করা যাবে বলে যে আশাটুকু ছিলো, এইখানে ফের চলে আসা সেই আশাটুকু বাঁচিয়ে রাখার জন্যও যে সর্বনেশে তা তার বুঝতে বাকি নেই। সে দেখলো রাত তখন নয়টা বাজে কিন্তু এই রাতেও দোকানটি খোলা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়াই হবে কম সন্দেহের হবে এমন একটা ভাবনা থেকে দরজাপথে ভেতরে পা বাড়ালো। কেউ যদি জেরা করে, বলতে পারবে রেজর ব্লেড কেনার জন্যই আসা।

দোকান মালিক একটি ঝুলন্ত তেলের কুপি জ্বালিয়েছে মাত্র। কুপি থেকে অল্প আলো আর মোহময় একটা ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছে। ষাটের কোটায় বয়স, দুর্বল, ঝুঁকে পড়া শরীর, লম্বা টিকালো নাক, মৃদু চাহুনি যা চশমার মোটা কাচে বিঘ্নিত। মাথার চুল অনেকটাই পেকে সাদা, তবে ঘন ভ্রু-যুগল এখনো কালো। চশমায়, ভদ্র-শ্লথ নড়াচড়ায়, আর পরনের কালো ভেলভেটের জ্যাকেটে এক ধরনের বুদ্ধিদীপ্তের ছাপ। মনে হবে লোকটি শিক্ষিত, অথবা শিল্পীও ভেবে বসতে পারেন। কণ্ঠ অনুচ্চ গম্ভীর, আর উচ্চারণ অধিকাংশ প্রোলদের চেয়ে আলাদা।

ফুটপাতে তোমাকে দেখেই চিনে ফেলেছি, বললো দোকানি। ‘তুমি তো সেই, সেবার শ্যুভেনির অ্যালবামটি কিনলে। কাগজগুলো খুবই সুন্দর। জানো, বলা হতো ক্রিম-লেপা কাগজ! অমন কাগজ এখন আর তৈরিই হয় না- আমিতো বলবো গত পঞ্চাশ বছরে দেখিনি।’ চশমার কাচের উপর দিয়ে চোখ তুলে উইনস্টনের দিকে তাকালো সে। ‘তোমার বিশেষ কিছু চাই? নাকি স্রেফ দেখার জন্য এলে?’

‘এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম, অনিশ্চিতের স্বর উইনস্টনের কণ্ঠে। ‘মনে হলো একটু ভেতরে ঢুকি। বিশেষ কিছু চাই না।’

‘সে ভালো বটে’ বললো দোকানি। ‘আমারও মনে হয় না, তোমার ভালো লাগবে এমন কিছু আছে,’ নরম দুটি করতল ঘষে ঘষে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি তার। ‘দেখতে পাচ্ছো দোকানটার দশা। একেবারে খালি বলতে পারো। তোমাকে একটা কথা বলি, আমার মনে হয় প্রাচীন পণ্যের বাজার শেষ হতে বসেছে। ওগুলোর আর কোনও কদর নেই, চাহিদা নেই আর মজুদও নেই। আসবাব, চিনামাটির তৈজষ এসব ভাঙতে ভাঙতে শেষ, ধাতব পাত্র-পদার্থতো দিনে দিনে উবে গেছে। পিতল-দস্তা আর তামার মিশেলে যে মোমদানি হতো তা কত বছর দেখি না!’

ছোট্ট দোকানের ভেতরটা মালপত্রে ঠাসা। কোনোটিই কমদামি না। মেঝেও ফাঁকা পড়ে নেই, দেয়ালে গাদা গাদা ছবির ফ্রেম ধুলো জমিয়ে ঝুলে আছে। জানালায় পাতা ট্রেতে ছোট ছোট নাট-বোল্টু, ভাঙা বাটালি, হাচড়া-খাচড়া ধাঁরহীন কলম-ছুরি, দমহীন ঘড়ি, যা আর কখনোই সময় দেবে না; এমন আরও নানা ধরনের ভাঙাচোড়া বস্তু-সামগ্রী। এক কোনায় একটি ছোট টেবিলও ভরে আছে নানা সামগ্রীতে- কারুকাজ করা নস্যির কৌটা, আকিক পাথরখচিত কাপড়ের পিনসহ এমন সব জিনিষ যা দেখলেই পছন্দ হবে, মনে হবে দারুণ কিছু।

টেবিলের ওপর গোলাকার একটি বস্তুতে চোখ আটকে গেলো উইনস্টনের। গোল, মসৃণ, বাতির আলোয় হালকা দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আলগোছে বস্তুটি হাতে তুলে নিলো সে। কাঁচের তৈরি স্বচ্ছ ভারি একটি বস্তু। এক পীঠ বাঁকানো অন্যদিক সমান, ফলে অনেকটা গোলার্ধের রূপ নিয়েছে। রঙ ও স্বচ্ছতায় মনে হবে বৃষ্টির বড় এক ফোঁটা স্ফটিক জল। ঠিক মাঝখানে অদ্ভুত গোলাপী একটা কিছু কুণ্ডলী পাকিয়ে বসানো। দেখলে গোলাপ কিংবা সামুদ্রিক তারাফুল মনে হবে। বাঁকানো অংশের কারণে উপর থেকে চোখে সেটি বড় হয়ে ধরা দেয়।

‘কি এটা?’ আগ্রহ ভরে জানতে চাইলো উইনস্টন।

‘ওটা কোরাল,’ বললো বুড়ো দোকানি। অবশ্যই ভারত মহাসাগর থেকে এসেছে। কাঁচের ভেতর বসানো হয়েছে সামুদ্রিক কোরাল। আমার মনে হয় না, এটির বয়স শত বছরের কম হবে, দেখে মনে হচ্ছে তারও বেশি হবে।

‘ভীষণ সুন্দর,’ বললো উইনস্টন।

‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর,’ প্রশংসাসূচক উচ্চারণ দোকানির। ‘তবে আজকাল আর এগুলো বেশি পাওয়া যায় না।’ খানিকটা কেশে নিয়ে বুড়ো ফের বললো, ‘এখন তুমি যদি এটা কিনতে চাও, পুরো চার ডলার দাম পড়বে। আমার দিব্যি মনে আছে পুরো আট পাউন্ড দিয়ে কিনেছি। আর আট পাউন্ড মানে হচ্ছে- না ঠিক হিসাব কষতে পারবো না, কিন্তু এটা বুঝি অনেক টাকা। সত্যিকারের প্রাচীন বস্তুতে কারই বা আগ্রহ বলো? হোক না এখন এগুলো খুব কমই মেলে?’

উইনস্টনের মন ধরে গেলো বস্তুটিতে, তাই দ্রুত দোকানির হাতে চার ডলার তুলে দিয়ে বস্তুটি পকেটে পুরে নিলো। এর সৌন্দর্য তার কাছে বড় বিষয় নয় বরং আজকালের বস্তুগুলোর চেয়ে এটি ভিন্ন কিছু, যার মালিকানা পাবার তীব্র বাসনাই বড় আবেদন হয়ে ধরা দিয়েছিলো তার মনে। বৃষ্টির পানির মতো স্বচ্ছ এমন কাঁচের গোলক আর কখনোই সে দেখেনি। আপাত এই প্রয়োজনহীনতাই বস্তুটিকে তার কাছে দ্বিগুণ আকর্ষণের করে তুললো, যদিও সে জানে একদিন হয়তো সে এটি পেপারওয়েট হিসেবেই ব্যবহার করতে শুরু করবে। পকেটে খুব ওজন লাগছিলো, তবে পকেটে বস্তুটি খুব একটা ফুলে উঁচু হয়ে নেই সেটাই বাঁচোয়া। এটি অদ্ভুত একটা বস্তু, একজন পার্টি সদস্যের মালিকানায় থাকাটাও অস্বাভাবিক বলে জ্ঞান করা হয়। ফলে যা কিছু পুরোনো, আর যা কিছু সুন্দর তা-ই সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। পুরো চার ডলার হাতে পেয়ে বুড়োর খুশি মুখটা দেখার মতো হয়ে উঠেছিলো। উইনস্টনের মনে হলো বুড়ো আসলে তিন ডলারে এমনকি দুই ডলারেই বেচতে রাজি হয়ে যেতো।

‘উপরের তলায় আরেকটি কামরা আছে, তুমি চাইলে একবার ঘুরে দেখতে পারো,’ বললো দোকানি। ‘খুব বেশি কিছু নেই, মাত্র কয়েকটা জিনিষ। তুমি যেতে চাইলে বাতি হাতে করে যেতে হবে।’

‘আরেকটা বাতি জ্বালালো বুড়ো, আর ধনুক-বাঁকা পীঠে খাড়া, নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ধীরে ধীরে উপরে উঠলো। পরে সরু একটি পথ গলে তারা যে কামরায় ঢুকলো সেখান থেকে রাস্তা দেখা যায় না, তবে বাইরেটা চোখে পড়ে। পাথর বিছানো আঙিনা আর চোঙা-আকৃতির বড়বড় পাত্র রয়েছে ওদিকটায়। উইনস্টন দেখলো ঘরের ভেতরেও কিছু আসবাবপত্র সাজানো, তাতে মনে কেউ এখানে বসবাস করে। মেঝেতে এক ফালি কার্পেট, দেয়ালে ঝোলানো এক-দুটি ছবি। একটি নিচু নোংরা হাতলওয়ালা চেয়ার ফায়ার প্লেসের সামনে পাতা। পুরোনো ফ্যাশনের বারো ঘণ্টা ডায়ালের একটি কাঁচের ঘড়ি চুল্লির উপরের দেওয়াল থেকে বেরিয়ে আসা তাকের ওপর বসে টিক টিক করে সময়ের বহমানতা জানান দিচ্ছে। জানালার পাশে কামরার সিকিভাগটা জুড়ে প্রমাণ সাইজের একটা বিছানা পাতা।

‘আমার স্ত্রী যতদিন বেঁচে ছিলো ততদিন আমরা এখানেই থাকতাম,’ আবার ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিমা বুড়োর কথায়। ধীরে ধীরে আসবাবপত্রগুলো বেচে দিচ্ছি। ওই যে বড় মেহগনি কাঠের বিছানাটি দেখছো ওটাই বাকি আছে, ছারপোকা ছাড়াতে পারলে ওটাও বেচবো। তবে বলতে পারি কাজটা ঝামেলারই হবে।’

বাতিটি সামান্য উঁচু করে ধরলো বুড়ো, এতে গোটা কামরা নজরে এলো আর ঠিক তখনই উষ্ণ আলো লুটিয়ে পড়া কামরাটি যেনো তাকে আহ্বান করে বসলো। উইনস্টনের মনে হলো, সপ্তায় গোটা কয় ডলার খরচ করলে এটি ভাড়া নেওয়া যায়। এজন্য কেবল তাকে ঝুঁকি নেওয়ার সাহসটুকুই সঞ্চার করতে হবে। ভয়াবহ এক জংলি ভাবনা, যা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাতিল করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এই কামরা যে তার ভেতরে এক ধরনের নস্টালজিয়া তৈরি করেছে, পিতৃপুরুষের কোনও এক অজানা স্মৃতি তার মধ্যে জাগ্রত করেছে। তার মনে হলো ঠিক এমনই একটি কক্ষে ফায়ারপ্লেসের পাশে হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আছে, চুল্লির ঘেরের ওপর দুটি পা তুলে রাখা, আর কেতলিতে ফুটছে গরম পানি, এমন একটি দৃশ্যকল্প তার অনুভবে ছিলো। যেখানে সে সত্যিকার অর্থেই একা, সত্যিকারেই নিরাপদ, কেউ তার ওপর নজর রাখছে না, কোনো কণ্ঠ নির্দেশ দিয়ে চলছে না, কেবল কেতলির মৃদু ফট ফট আর ঘড়ির প্রিয় টিক টিক ধ্বনি ছাড়া আর কোনও শব্দই কোথাও নেই।

‘কোনো টেলিস্ক্রিন নেই!’ বিস্ময়ের বিড়বিড় উচ্চারণে কথাটি না বলে পারলো না সে।

‘নাহ!,’ বললো বুড়ো, ‘কোন কালেই বস্তুটি আমার ছিলো না। ম্যালা দামি। আর আমার মনেও হয় না এর কোনো প্রয়োজন আছে। কোনায় ওই পা-ভাঁজ করা টেবিলটি দেখেছো। তুমি চাইলে পা ছড়িয়ে বসাতে পারো, ভাঁজ করেও রাখতে পারো।’

অন্য কোনায় একটি ছোট বইয়ের বাক্স, আর উইনস্টনও ততক্ষণে ওটি দেখে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেতরে ময়লার দলা ছাড়া কিছুই নেই। বই খুঁজে খুঁজে তা ধ্বংস করার কাজটি অন্যত্রের মতো একইভাবে প্রোলদের কোয়ার্টারগুলোতেও হয়েছে। ১৯৬০ সালে আগে রচিত কোনও একটি বই ওশেনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। তখনও বাতিটি উঁচু করে ধরে, বুড়ো দাঁড়ালো একটি গোলাপকাঠের ফ্রেমে বাঁধা ছবির সামনে। এটি বিছানার ঠিক উল্টোদিকে, ফায়ার প্লেসের অপর পাশে ঝোলানো।

‘এই পুরোনো ছাপায় যদি আদৌ তোমার কোনো আগ্রহ থাকে-’ হেয়ালিপনার উচ্চারণ বুড়োর।  

উইনস্টন উল্টোদিকে এগিয়ে গেলো ছবিটি পরীক্ষা করতে। স্টিলে খোদাই করা আয়াতকার জানালা বিশিষ্ট ডিম্বাকৃতির একটি ভবন, সামনে একটি ছোট টাওয়ার। ভবনের চারিদিক রেলিং ঘেরা, আর পেছনের শেষভাগে একটি মূর্তি বসানো। কিছুক্ষণ ধরে ছবিটি দেখলো উইনস্টন। অস্পষ্টভাবে মনে হলো, এমন দৃশ্য সে আগে দেখেছে, তবে ঠিক কবে কোথায় মনে করতে পারছে না।

‘ফ্রেমটি দেয়ালে সেঁটে দেওয়া,’ বললো বুড়ো, ‘তবে বলছি, স্ক্রু খুলে ওটা আমি তোমায় দিতে পারবো না।’

‘ছবির এই ভবনটি আমার চেনা,’ অবশেষে বললো উইনস্টন। ‘এটা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এটি বিচারলয় প্রাসাদের বাইরে সড়কের ঠিক মাঝখানে ছিলো।’

‘ঠিক বলেছো। আদালত ভবনের বাইরে ছিলো। এতে বোমা মারা হয়েছিলো- কত সালে মনে পড়ছে না, তবে অনেক বছর আগে। একসময় এটি ছিলো গির্জা, নাম ছিলো সেইন্ট ক্লেমেন্ট ডেইনস। আবারও ক্ষমাপ্রার্থণার ভঙ্গি তার হাসিতে, যেনো, এমন কিছু বলার সচেতনতাই অপরাধ। তবে যোগ করলো, ‘অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স!’

‘মানে কি?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।

‘আরে! “অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স” এটা ছিলো আমাদের ছেলেবেলার একটি ছড়া। কিভাবে এই ছড়া এলো বলতে পারবো না, কিন্তু আমি জানি এখন আর এই ছড়া নেই। “হিয়ার কামস অ্যা ক্যান্ডল টু লাইট ইউ টু বেড, হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড।” এটা ছিলো নাচের গান। দুজন হাত বেঁধে উপরে তুলে রাখতো, আর অন্যজন নিচে দিয়ে যেতো। আর যখন তারা “হিয়ার কামস অ্যা চপার টু চপ অফ ইওর হেড” বলতো তখন দ্রুত হাত নামিয়ে আটকে ফেলতো।’

একটা তালিকা দেখিয়ে বললো, ‘এগুলো বিভিন্ন গির্জার নাম। লন্ডনের সব প্রধান প্রধান গির্জার নাম পাবে।’

উইনস্টন দেখছিলো গির্জাটি কোন শতাব্দীর। লন্ডনের ভবনগুলোর বয়স মাপা বরাবরই কঠিন একটা কাজ। কোনটি বড় বা সুন্দর হলে, আর তা দেখতে যদি অপেক্ষাকৃত নতুন মনে হয়, সেটা খুব সহজেই বিপ্লবের সময় নির্মিত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর যেগুলো সন্দেহাতীত ভাবেই পুরোনো, সেগুলোকে বলে দেওয়া হবে মধ্য যুগের। কেউ স্থাপত্য থেকে ঠিক ইতিহাসটি আর জানতে পারবে না, বই থেকেই তা জানতে হবে। মূর্তি, ভাস্কর্য, স্মৃতি ফলক, সড়কের নাম- এমন যা কিছু অতীতকে নির্দেশ করতে পারে তা অতি সতর্কতায় প্রক্রিয়াকরণ হয়ে গেছে।

‘এটি যে গির্জা ছিলো তা আমার জানা ছিলো না,’ বললো উইনস্টন।

‘এর অনেকগুলো এখনও আছে, সত্যিই আছে,’ বললো বুড়ো, ‘তবে সেগুলো এখন ভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাহলেই বোঝো, ছড়া কি আর টিকে থাকবে?

“অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স,
“ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স-”

যদ্দুর মনে করতে পারছি, আমার মনে হয় এমনটাই ছিলো। ফার্দিং হচ্ছে ছোট দস্তার মুদ্রা, এখন যে সেন্ট দেখছো এমনই।’

‘সেইন্ট মার্টিন’স কোথায় ছিলো?’ প্রশ্ন উইনস্টনের।     
                  
‘সেইন্ট মার্টিন’স? সেতো এখনো আছে। এটিতো ভিক্টরি স্কয়ারে, পিকচার গ্যালারির পাশে। ওই যে সামনে পিলারগুলো ত্রিকোণাকৃতির, আর অনেক উঁচু একটা সিঁড়ি।’

উইনস্টন জায়গাটি ভালো করেই চেনে। বিভিন্ন ধরণের প্রচারণামূলক বিষয়ের প্রদর্শনী চলে এখানে- রকেট বোমা, ভাসমান দূর্গের মডেল, শত্রুপক্ষের নিষ্ঠুরতা তুলে ধরে তৈরি মোমের মূর্তি ইত্যাদি।

‘বলা হতো- সেইন্ট মার্টিন’স-ইন-দ্য-ফিল্ড,’ বললো বুড়ো, ‘তবে আমি ওই অংশে একটি মাঠের কথাও স্মরণ করতে পারছি না।’

ছবিটি কিনলো না উইনস্টন। কাঁচের পেপারওয়েটের চেয়ে অনেক বেশি অসংগতির বস্তু হবে এটি, আর ফ্রেম থেকে ছাড়িযে না নিলে এটি বাড়িতে বয়ে নিয়ে যাওয়াও হবে অসম্ভব। তবে সে বুড়োর সঙ্গে আরো কিছুটা সময় কাটালো। দোকানের সামনের নাম ফলক থেকে যে কেউ ধরে নেবে বুড়োর নামটি হবে উইকস- কিন্তু তার নাম মূলত চ্যারিংটন। মি. চ্যারিংটনের বয়স তেষট্টি আর এই দোকানের মধ্যেই তার গত ত্রিশ বছরের জীবন। তখন থেকেই জানালার পাশে নাম ফলকে নামটি পাল্টে নেওয়ার কথা তার মনে রয়েছে কিন্তু এপর্যন্ত আর তা করা হয়ে ওঠেনি। যতক্ষণ তাদের কথা চললো ততক্ষণই উইনস্টনের মস্তিষ্ক জুড়ে থাকলো বুড়োর সেই আধাআধি স্মরণ করতে পারা ছড়া। “অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স”, “ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট মার্টিন’স”। ব্যাপারটি কৌতুহলের, কিন্তু আপনি যা মনে মনে বলবেন বেলের শব্দে তো অবচেতন মনে সেটাই শুনবেন। হারিয়ে যাওয়া লন্ডনের সেই সব বেল হয়তো কোনখানে টিকে আছে, লুকিয়ে আর বিস্মৃত হয়ে। কোনও এক ভৌতিক চুড়া থেকে সে যেনো শুনতে পাচ্ছে একের পর এক বেল বেজে চলার শব্দ। তবে যতটা মনে করতে পারে, বাস্তব জীবনে সে কখনোই গির্জার বেল বাজার শব্দ শোনে নি।

চ্যারিংটনের কাছ থেকে এগিয়ে একাই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলো সে, রাস্তায় পা ফেলার আগে বুড়োটি কাছে থাকুক তা চাইছিলো না। এরই মধ্যে সে অবশ্য মনোস্থির করে ফেলেছে, সুবিধাজনক বিরতি দিয়ে, হতে পারে মাস খানেক পরে, আরও একবার এই দোকানে আসার ঝুঁকি সে নেবে। সেন্টারে এক সন্ধ্যার অনুপস্থিতির চেয়ে মনে হয় বিষয়টি বেশি বিপদের হবে না। সবচেয়ে বড় বোকামি কিন্তু ডায়রিটা কেনার পর একই স্থানে আরেকবার যাওয়া, বিশেষ করে দোকানের মালিককে বিশ্বাস করা যায় কিনা তা নিশ্চিত না হয়েই। যাইহোক-!

হ্যাঁ, তার মনে হলে ওখানে সে আবারও যাবে। আবারও সে এখানকার সুন্দর সুন্দর অপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনবে। সেইন্ট ক্লেমেন্ট ডেন্স’র ওই খোদাইকরা ছবিটি কিনে ওটি ফ্রেম থেকে ছাড়িয়ে, আলখেল্লার জ্যাকেটের নিচে ঢুকিয়ে তবেই বাসায় নিয়ে যাবে। মি. চ্যারিংটনের স্মৃতি ঘেঁটে বের করে আনবে কবিতার বাকি অংশটুকু। এমনকি উপরের তলার কামরাটি ভাড়া করার যে ক্ষণিকের ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছিলো সে ইচ্ছাটিও তার মনে আবার চাড়া দিয়ে উঠলো। এসবের উত্তেজনা প্রায় পাঁচ সেকেন্ড ধরে তাকে বেপরোয়া করে রাখে, অতঃপর সে উদভ্রান্তের মতোই পা ফেলে ফুটপাতে। আর একটি সুর গুনগুন করতে থাকে-
অরেঞ্জেস অ্যান্ড লেমন্স, সে দ্য বেলস অব সেইন্ট ক্লেমেন্ট’স,
ইউ ও মি থ্রি ফার্দিংস, সে দ্য....

ঠিক তখনই তার হৃদয়খানি বরফহিম হয়ে যায়, আর প্রসাবের প্রচণ্ড বেগ চাপে। নীল ওভারঅল পরা কেউ একজন ফুটপাতে নেমে এসেছে, দশ মিটারও ব্যবধান হবে না দুজনের মাঝখানে। এবারও সেই ফিকশন ডিপার্টমেন্টের মেয়েটি। সেই কালোকেশী। আলো অস্পষ্ট কিন্তু চিনে ফেলতে কষ্ট হয়নি। মেয়েটি সরাসরি একবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো আর ত্রস্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করলো, যেনো সে তাকে দেখতেই পায়নি।

ক্ষণকয়েক চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো উইনস্টন। এবার ডানে ঘুরলো আর দ্রুত পায়ে এগুতো থাকলো, একবারও মনে এলো না ভুল দিকে যাচ্ছে সে। ব্যাপারটা একেবারে পাক্কা। মেয়েটি যে তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে, তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকলো না। সে অবশ্যই তাকে অনুসরণ করে এখানে এসেছে। পার্টির সদস্যরা যেখানে থাকে সেখানে থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, এই অন্ধকার সড়কে একই সন্ধ্যায় দু'জনেরই এসে পড়ার আর কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণ থাকতে পারে না। এটাও একটা বড় বিষয়, মেয়েটি কি আসলে থট পুলিশের চর, নাকি নিতান্তই শখের গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত। তবে সে যাইহোক, এতে কদাচই কিছু যায় আসে। সে তাকে নজরে রাখছে, এটাই যথেষ্ট। হতে পারে মেয়েটি তাকে সুঁড়িখানায়ও দেখে ফেলেছে।

একেই বলে কষ্ট করে হেঁটে চলা। কাঁচের পিণ্ডটি প্রতি পদক্ষেপে তার রানের ওপর আঘাত করছে, এতে সে প্রায় মনোস্থির করেই ফেলেছিলো ওটি ছুঁড়ে ফেলে দেবে। সবচেয়ে অসহনীয় হয়ে দেখা দিলো পেটের ব্যাথা। কয়েক মিনিট তার এও মনে হচ্ছিলো, দ্রুত একবার টয়লেটে ঢুকতে না পারলে সে মরেই যাবে।  কিন্তু এই এলাকায় কোনো গণশৌচাগার নেই। পরে অবশ্য পায়খানার বেগ চলে গেছে, তবে রেখে গেছে একটা পেট কচলানো ব্যথা।

ওটি ছিলো একটা চোরা গলি। শেষ মাথায় গিয়ে উইনস্টন থামলো। কয়েক সেকেন্ড ভেবেই পাচ্ছিলো না, কি করবে। এবার উল্টো ঘুরলো আর আবারও হাঁটতে শুরু করলো। ঠিক যখন ঘুরছিলো তখনই তার মনে হলো, মোটে তিন মিনিট আগে মেয়েটি তাকে অতিক্রম করে গেছে, সে যদি একটু দৌড় লাগায় তো ওকে ধরে ফেলতে পারবে। এতে সুবিধা হবে, এই নিরব এলাকায় যতক্ষণ থাকবে সে তার গতিবিধি অনুসরণ করতে পারবে, এরপর একটা পাথর দিয়ে সে তার খুলিটি চুরমার করেও দিতে পারবে। তার পকেটে যে কাঁচের পিণ্ডটি রয়েছে ওটিও এমন একটি কাজের জন্য যথেষ্টই ভারি হবে। তবে পুরো ভাবনাটি দ্রুতই বাতিল করলো সে, কারণ এই মূহূর্তে শারিরিক পরিশ্রমের কোনো কাজ করার চিন্তা করাও তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সে দৌড়াতেও পারবে না, আর একটি ঘুষিও ছুঁড়তে পারবে না। উপরন্তু মেয়েটি যুবতী আর গাট্টাগোট্টা, সেই বরং উল্টো তাকে ঘায়েল করে ফেলবে। তার মাথায় এই চিন্তাও এলো দ্রুত কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে যাবে, আর বন্ধ হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই কাটাবে। তাতে ওই সন্ধ্যার কার্যক্রমের একটা আংশিক ব্যাখা সে দেখাতে পারবে। কিন্তু সেও ছিলো অসম্ভব। ভীষণ এক অবষন্নতা তাকে পেয়ে বসেছে। এখন তার একটাই ইচ্ছা, দ্রুত ঘরে ফিরে যাওয়া আর শান্ত হয়ে আরাম করে বসা।

ফ্ল্যাটে যখন ফিরলো ততক্ষণে রাত দশটা পার হয়ে গেছে। মূল ফটকে অবশ্য আলো বন্ধ করা হয় রাত সাড়ে এগারোটায়। ঘরে ঢুকেই দ্রুত রান্নাঘরে ছুটলো আর দেরি না করে এককাপ পরিমান ভিক্টরি জিন গলায় ঢাললো। ধকল সামলাতে সামলাতে চোরকুঠুরির টেবিলে ফিরলো, ড্রয়ার থেকে ডায়রিটা তুলে নিলো কিন্তু তখনই পাতা খুললো না। টেলিস্ক্রিন থেকে একটা কর্কশ নারী কণ্ঠ তারস্বরে গাইছে দেশপ্রেমের গান। ডায়রির মার্বেল মলাটের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলো সে, আর নারী কণ্ঠটিকে সজ্ঞানতার বাইরে ঠেলে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।

ওরা আপনার খোঁজে রাতেই আসে। সঠিক কাজটি হচ্ছে, ওরা ধরে ফেলার আগেই আত্মহত্যা করে ফেলা। নিঃসন্দেহে কিছু মানুষ সেটাই করে। এ কারণেই বলা যায়, অনেক গুমের ঘটনা মূলতঃ আত্মহত্যা। তবে নিজেকে হত্যা করার জন্য প্রয়োজন চরম সাহস, বিশেষ করে আপনি যখন এমন বিশ্বে বাস করছেন যেখানে আগ্নেয়াস্ত্র কিংবা দ্রুত কাজ করে এমন বিষ কেনার সুযোগটিও রাখা হয়নি। ভয় ও বেদনার জৈবিক অকার্যকারিতা নিয়ে বিস্ময়চিত্তে সে ভাবলো, মানবদেহের শাসনটাই এমন যে, ঠিক অতি প্রয়োজনে শরীরটা বেঁকে বসে। একটু দ্রুত উদ্যোগী হলে সে হয়তো কালোকেশী মেয়েটিকে ধরতে পারতো: কিন্তু স্রেফ বিপদের আশঙ্কা তার শরীরকে অবশ করে দেয়। তার মনে হলো, সঙ্কটাপন্ন অবস্থায়ও মানুষকে বাইরের শত্রুর মোকাবেলা করা না লাগতে পারে, কিন্তু শরীরের ভেতরের শত্রুটির বিরুদ্ধে লড়াই চলে নিরন্তর। ঠিক এখন, জিন পেটে যাওয়ার পরেও পেটের ব্যাথাটি তার ধারাবাহিক চিন্তায় বিঘ্ন ঘটিয়ে চলেছে। বিষয়টি সবসময়ই একরকম, হোক সে বীরত্বের কিংবা বিয়োগান্তের। যুদ্ধের মাঠ, নিপীড়ণ কক্ষ, ডুবন্ত জাহাজে আপনার অব্যাহত লড়াইয়ের বিষয়গুলো মনে আসবে না কারণ তখন শরীর আপনার দখলেই থাকে না। যতক্ষণে ভয়ে অচেতন হয়ে যান নি, অথবা ব্যথায় চিৎকার জুড়ে দেননি ততক্ষণ পর্যন্ত জীবনটা প্রতি মূহূর্তের এক সংগ্রাম। সে সংগ্রাম ক্ষুধার, ঠাণ্ডার অথবা নিদ্রাহীনতার বিরুদ্ধে। অথবা পাকস্থলীর অম্বল কিংবা দাঁতের ব্যথার বিরুদ্ধে।

ডায়রি খুললো উইনস্টন। কিছু বিষয় লিখে ফেলা জরুরি। টেলিস্ক্রিনের নারী নতুন গান ধরেছে। সে গান তার মস্তিষ্কে কাচের ধারালো স্প্লিন্টারের মতো বিঁধছে।  ও’ব্রায়েনকে নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করলো সে, যার জন্য, কিংবা যাকে উদ্দেশ্য করেই এই ডায়রি লেখা। কিন্তু ও’ব্রায়েন নয়, তার ভাবনা জুড়ে স্থান করে নিলো, থটপুলিশ। ওরা তাকে ধরে ফেললে কি হবে সেসব বিষয়। ওরা যদি সাথে সাথে মেরে ফেলে তো কোনও কথাই নেই। সে হত্যা হবে আপনার প্রত্যাশার পূরণের মতো কিছু। কিন্তু মৃত্যুর আগে (প্রত্যেকেই জানে কিন্তু কেউ কথা বলে না) দোষ স্বীকার সম্পর্কিত কিছু রুটিন কাজের মধ্য দিয়ে আপনাকে যেতেই হবে- মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে চিৎকার করতে করতে ক্ষমাভিক্ষা, প্রহারে প্রহারে হাড়গুলো ভাঙার কড়কড় শব্দ, দাঁত গুঁড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণা আর মাথায় জমাট বেঁধে থাকা রক্তের উপলব্দি।

শেষ যখন ওই একই প্রাণহানিতে, তাহলে তার আগে কেনো এত কিছু? ওই কটি দিন বা সপ্তাহ জীবন থেকে কেনো বাদ দেওয়া যায় না? সন্দেহে পড়ে কেউ ধরা পড়েনি এমন হয়নি, আর কেউ অপরাধ স্বীকার করে নেয়নি এমনটাও হয়নি। একবার যদি আপনি চিন্তাঅপরাধের জালে পড়ে যান, কোনও এক দিনে সেকারণেই আপনার মৃত্যু অবধারিত। তাহলে যে ভয় কোনও কিছু পাল্টে দেয় না সে ভয় করাই কেনো, কেনই বা ভবিতব্যের কাছে মাথা ঠোকা?

চিন্তা জগতে ও’ব্রায়েনের ছবি টেনে আনতে এবার কিছুটা সফল সে। ‘এমন কোথাও আমাদের দেখা হবে যেখানে কোনও আঁধার থাকবে না,’ ও’ব্রায়েন বলেছিলো তাকে। সে জানে এর মানে কি, অথবা অন্তত তার মনে বলে, সে জানে। যেখানে কোন আঁধার নেই সে স্থানটি এক কাল্পনিক ভবিষ্যত, যা কেউ কখনোই দেখবে না, তবে দূরদৃষ্টি দিয়ে কেউ কেউ তার রহস্যময়তা উপলব্দি করতে পারবে। টেলিস্ক্রিনের কর্কশ শব্দে ভাবনার ধারাবাহিকতা বার বার কেটে যাচ্ছে। চিন্তার ট্রেন গতি হারাচ্ছে। মুখে একটি সিগারেট চেপে ধরলো সে। অর্ধেক পরিমান তামাক পড়লো জিভের ওপর। ভীষণ তেতো কিন্তু তখনই থুুতু ফেলে ওগুলো ফেলে দেওয়াও কঠিন। এমনই মূহূর্তে তার চিন্তার সমুদ্র থেকে ও’ব্রায়েনকে সরিয়ে দিয়ে সাঁতরে ঢুকে পড়লো বিগ ব্রাদার। দিন কয়েক আগে যা করেছিলো ঠিক তেমনিভাবে পকেট থেকে একটি মুদ্রা বের আনলো সে, আর তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো। মুদ্রার পীঠের মানুষটি যেনো তাকেই দেখছে, গভীর, শান্ত ও সুরক্ষার দৃষ্টিতে: কিন্তু কালো ঘন গোঁফের নিচে কিসের এক চাপা হাসি লুকিয়ে আছে? স্তিমিত হয়ে আসা ঘণ্টাধ্বনির মতো তার কানে বার বার বাজতে থাকলো:

যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অবজ্ঞাই শক্তি। ............ চলবে

দ্রষ্টব্য: উপন্যাসটির প্রথম খণ্ড এখানেই শেষ। পরের খণ্ডে উইনস্টনের দুঃসাহসিক প্রেমকাহিনী। প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে।