অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

স্বাধীনতা এসেছিল, তারা ফিরে আসেননি

ড. নাদির জুনাইদ, শিক্ষক ও কলামিস্ট

প্রকাশিত: ০৩:০৪ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২১ সোমবার   আপডেট: ০৩:৫৭ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২১ সোমবার

জাহানারা ইমাম তাঁর বহুলপঠিত বই “একাত্তরের দিনগুলি”-তে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরদিন ঢাকার অবস্থা বর্ণনা করে লিখেছেন: “সারা ঢাকার লোক একই সঙ্গে হাসছে আর কাঁদছে। স্বাধীনতার জন্য হাসি। কিন্তু হাসিটা ধরে রাখা যাচ্ছে না। এত বেশি রক্তে দাম দিতে হয়েছে যে কান্নার ¯স্রোতে হাসি ডুবে যাচ্ছে। ভেসে যাচ্ছে।” 

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, কিন্তু জাহানারা ইমামের বড় ছেলে রুমি ফিরে আসেনি তার মায়ের কাছে। আজাদের মা আর কোনোদিন দেখতে পাননি তার প্রিয় আজাদকে। নিজের পরিবারের কাছে ফিরে আসেননি প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদ এবং আরও অনেকে। 

১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট এবং ৩০ আগস্ট আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দুটি বেদনাময় দিন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই দুই দিনে ঢাকা শহরে দুঃসাহসী গেরিলা আক্রমণ পরিচালনাকারী কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের সাহায্যকারীদের বিভিন্ন বাড়ি থেকে আটক করেছিল। অকুতোভয় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকজনের খোঁজ আর কখনো পাওয়া যায়নি। 

মুক্তিযুদ্ধে দুই নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় তৎকালীন মেজর খালেদ মোশাররফ বেসামরিক তরুণদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গেরিলারা ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল অবলম্বন করে অকস্মাৎ হামলা চালিয়ে শত্রুকে পর্যুদস্ত এবং মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। 

দুই নম্বর সেক্টরের একজন অফিসার ছিলেন তৎকালীন ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার। তিনি ছিলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এলিট কমান্ডো বাহিনী এসএসজি (স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ)-এর একজন সদস্য। ১৯৭১ সালের মার্চে কুমিল্লা সেনানিবাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর থ্রি কমান্ডো ব্যাটালিয়নে তিনি কর্মরত ছিলেন। একজন কমান্ডো অফিসার হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কারণে বেসামরিক তরুণদের গেরিলা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ক্যাপ্টেন হায়দারকে। 

গভীর মনোযোগ আর যত্নের সাথে তরুণদের একের পর এক দলকে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকেই গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন হায়দার। জাহানারা ইমামের সন্তান শাফী ইমাম রুমি ছিল ক্যাপ্টেন হায়দারের কাছে প্রশিক্ষণ পাওয়া একজন গেরিলা যোদ্ধা। দুই নম্বর সেক্টরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন আরও বিভিন্ন তরুণ যাদের মধ্যে ছিলেন শহীদুল্লাহ খান বাদল যিনি ১৯৬৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন। তিনি ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের ঢাকা অপারেশনের স্টাফ অফিসার। সেক্টর কমান্ডারের এবং ক্যাপ্টেন হায়দারের বিভিন্ন নির্দেশ তিনি বিভিন্ন সময় গেরিলাদের জানাতেন। 

ছিলেন হাবিবুল আলম, একজন রোভার স্কাউট যার নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে পাকিস্তান বয় স্কাউটস দল অস্ট্রেলিয়ায় স্কাউট জাম্বোরীতে অংশগ্রহণ করেছিল; ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় কাজী কামালউদ্দিন আর জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল; ছিলেন নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, গোলাম দস্তগীর গাজী, রাইসুল ইসলাম আসাদ, আলী আহমেদ জিয়াউদ্দিন, আবু সাইদ খান, আনোয়ার রহমান, সাদেক হোসেন খোকা, সংগীতশিল্পী আজম খান, চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন, সাংবাদিক শাহাদাত চৌধুরী, ফতেহ আলী চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে আহমেদ মুনীর ভাষণ, আহরার আহমেদ প্রমুখ। 

কয়েকজন গেরিলা যেমন কামরুল হক স্বপন, বদিউল আলম বদি, এএফএমএ হ্যারিস, মুখতার, মাসুদ সাদিক চুল্লু প্রমুখ দুই নম্বর সেক্টরে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেননি। কিন্তু তারা ঢাকা শহরে পরিচালিত বিভিন্ন দুঃসাহসী গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। 

পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ চালানোর জন্য দুই নম্বর সেক্টর থেকে ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ১৭ জনের প্রথম গেরিলা দলটি হাবিবুল আলমের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রবেশ করে। ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ চালানোর জন্য ঢাকায় মুক্তিবাহিনী চলে এসেছে এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তাদের যুদ্ধ চলছে এই তথ্য ঢাকাবাসী এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানান দেয়া ছিল ঢাকায় গেরিলা আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য। 

বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের একটি সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য লাভের জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিদেশী প্রতিনিধিদের এমন ধারণা দিয়েছিল যে ঢাকাসহ পুরো দেশের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত। দুই নম্বর সেক্টরে তাই পরিকল্পনা করা হয়েছিল বিদেশী অতিথিদের বোঝাতে হবে যে দেশের পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক নয়।

৯ জুন, ১৯৭১ হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে গ্রেনেড নিক্ষেপ ছিল ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটের প্রথম অপারেশন। সেদিন বিদেশী অতিথিদের গাড়ি হোটেলের প্রবেশদ্বারের সামনে এসে থামা মাত্রই আগে থেকে অপেক্ষায় থাকা জিয়া, আলম, আর মায়া প্রবেশদ্বারের সামনে একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণে অতিথিদের শেভ্রোলে গাড়িটি মাটি থেকে কয়েক ফুট শূন্যে উঠে গিয়েছিল।

বাম দিক থেকে: কাশেম, আহরার, জিয়া, ফতেহ, ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং, হাবিবুল আলম, মেজর এটিএম হায়দার, শাহাদাত চৌধুরী, চুল্লু, মাহমুদ। ছবি: হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক-এর সংগ্রহ থেকে। 

সেই স্থানে উপস্থিত মানুষরা গভীর বিস্ময়ে প্রথমবারের মতো দেখেছিলেন ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণ। অপারেশনের পরই আলম, জিয়া, মায়া, আর স্বপন দ্রুত তাদের জন্য রাস্তায় অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে সেই স্থান থেকে চলে যান। সেদিন সেই গাড়িটি ড্রাইভ করছিলেন গেরিলা আহমেদ মুনীর ভাষণের মামা বাদল যিনি ছিলেন এফডিসির একজন ক্যামেরাম্যান এবং গাড়িচালনায়ও যিনি দক্ষ ছিলেন।  

প্রথম অপারেশনের এই সাফল্য গেরিলাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং কিছুদিন পর গেরিলারা দুই নম্বর সেক্টর থেকে আরও অস্ত্র এবং গোলাবারুদ নিয়ে আবার ঢাকায় আসেন। হাবিবুল আলমদের দিলু রোডের বাড়ির রান্নাঘরের মেঝেতে গর্ত করে অস্ত্র-বিস্ফোরক রেখে কংক্রিটের ¯স্ল্যাব দিয়ে তা ঢেকে দেয়া হয়েছিল। 

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি” গানের সুরকার প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী আলতাফ মাহমুদের সাথে গেরিলাদের যোগাযোগ ছিল। এই গুণী শিল্পী বিপদের ভয় না করে নিজে গাড়ি চালিয়ে গেরিলাদের দুই ট্রাঙ্ক ভর্তি অস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে এসে তার রাজারবাগের ৩৭০ নম্বর বাড়ির পেছনে একটি লেবু গাছের নীচে মাটি খুঁড়ে ট্রাঙ্ক দুটি রেখেছিলেন। 

ঢাকায় গেরিলারা আরও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছিলেন। রুমির বাবা প্রকৌশলী শরীফ ইমাম গেরিলাদের মূল্যবান তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। জাহানারা ইমাম একদিন নিজে গাড়ি চালিয়ে গেরিলাদের অস্ত্র নিজেদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। হাবিবুল আলমের বাবা প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাফিজুল আলম একদিন নিজে গাড়ি চালিয়ে তিনজন গেরিলাকে নারায়ণগঞ্জ নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকায় পলি ক্লিনিকের মালিক ডাক্তার আজিজুর রহমান বিভিন্ন সময় আহত গেরিলাদের চিকিৎসা করেছেন। কলেজ শিক্ষক জাকিয়া খাতুন গেরিলাদের টাকা সংগ্রহ করে দেয়া এবং তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য করতেন।   

জুলাই আর আগস্ট মাসে গেরিলারা ঢাকায় পরিচালনা করেছিল দুঃসাহসী কয়েকটি অপারেশন। ১৯ জুলাই, ১৯৭১ ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত করে পাকিস্তানি বাহিনীকে অসুবিধায় ফেলার জন্য এলিফ্যান্ট রোড, মতিঝিল, তেজগাঁও, গুলবাগ আর উলান এই পাঁচ জায়গায় বিদ্যুৎ সাবস্টেশনে গেরিলাদের পাঁচটি ভিন্ন দল আক্রমণ করে। তিন জায়গায় সাবস্টেশনের ক্ষতিসাধন করতে না পারলেও গোলাম দস্তগীর গাজীর নেতৃত্বাধীন দলটি উলান সাবস্টেশনে আর আবু সাইদ খানের নেতৃত্বে আরেকটি দল গুলবাগ সাবস্টেশনে সফলতার সাথে বিস্ফোরণ ঘটায়। 

ফার্মগেটের সড়কদ্বীপে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের একটি চেকপোস্ট ছিল। পাশেই বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈনিক তাঁবু খাটিয়ে থাকতো। কয়েকদিন এই স্থানে সৈনিকদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে ৮ আগস্ট, ১৯৭১ সন্ধ্যায় আলম, বদি, মায়া, স্বপন আর পুলু ― এই পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা একটি চাইনিজ সাবমেশিন গান, তিনটি ভারতীয় স্টেনগান, কয়েকটি গ্রেনেড এবং দুটি ফসফরাস গ্রেনেড নিয়ে ফার্মগেটের চেকপোস্টে আর সৈনিকদের তাঁবুতে ঝটিকা হামলা চালায়। মাত্র দেড় মিনিট স্থায়ী এই হামলায় চেকপোস্ট আর সৈনিকদের তাঁবু তছনছ হয়ে যায়। প্রাণ হারায় বেশ ক’জন পাকিস্তানি সেনা। অপারেশন শেষে গেরিলারা দ্রুত তাদের জন্য অপেক্ষমান গাড়িতে করে সেখান থেকে চলে যায়। সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলেন ঢাকা নিওন সাইনের মালিক সামাদ। 

২৫ আগস্ট ধানমন্ডি ১৮ নম্বর রোডে একটি অপারেশন শেষে মীরপুর রোড দিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে যাওয়ার সময় গেরিলারা দেখতে পান পাকিস্তানি সৈন্যরা রাস্তায় হঠাৎই ব্যারিকেড দিয়ে সব গাড়ি থামাচ্ছে। কয়েকজন সৈন্য লাইট মেশিনগান নিয়ে মাটিতে গুলি ছোঁড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে শুয়ে ছিল। যেহেতু গেরিলাদের গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল না, তাই পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে গেরিলাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ তখন অনিবার্য হয়ে ওঠে। 

বাম দিক থেকে: আহরার আহমেদ ও শাহাদাত চৌধুরী। ছবি: হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক-এর সংগ্রহ থেকে। 

সেদিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন হাবিবুল আলম। যখন শত্রুদের ছোঁড়া গুলি যে কোনো মুহূর্তে শরীরে আঘাত হানতে পারে এমন পরিস্থিতিতে মাথা খুবই ঠান্ডা রেখে আলম গাড়ি ডানে যাবে এমন ভাব করে ডান দিকে যাওয়ার ইন্ডিকেটর দিয়ে দ্রুত গাড়িটি বামে ধানমন্ডি ৫ নম্বর রোডের দিকে ঘুরিয়ে দেন। সেই সাথে গাড়ির তিন জানালা দিয়ে কাজী কামালউদ্দিন, বদি, আর স্বপন হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে একটানা গুলি চালাতে থাকেন। হতবাক পাকিস্তানি সেনাদের দিক থেকে কোনো গুলি আসার আগেই গাড়ি এগিয়ে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি জিপ গেরিলাদের পিছু নেয়। কিন্তু গাড়ির পেছনের সিটের মাঝখানে বসা রুমি স্টেনগানের বাট দিয়ে গাড়ির পেছনের কাঁচ ভেঙ্গে সরাসরি জিপটির দিকে গুলি চালান। রুমির ছোঁড়া গুলি জিপের ড্রাইভারের শরীরে আঘাত করেছিল এবং জিপটি একটি ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। এমন বিপদজনক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পেশাদার সৈনিকদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষের পরও মাত্র কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণ পাওয়া সেই গেরিলারা সবাই ছিলেন অক্ষত। 

১৯ আগস্ট আহত হয়েছিলেন গেরিলা আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল। সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আক্রমণ চালানোর আগে এলাকাটি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় দশ জন গেরিলার একটি দল দুটি নৌকা নিয়ে সেদিকে যাওয়ার সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের স্পিডবোটের মুখোমুখি পড়ে যায়। সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয় জানতে চাওয়ার সাথে সাথেই বদি স্টেনগান দিয়ে একটানা গুলি চালায়। পাকিস্তানিরা পাল্টা গুলি ছুঁড়লেও বদির টানা গুলিবর্ষণে তাদের অনেকেই পানিতে পড়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তানিদের ছোঁড়া গুলিতে নামকরা উইকেটকিপার এবং ব্যাটসম্যান জুয়েলের বাম হাতের তিনটি আঙুল বেশ খারাপভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। ঢাকায় আনার পর ডাক্তার জুয়েলের হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন। এই একটি ঘটনা ছাড়া জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ঢাকা শহরে পরিচালিত বিভিন্ন অপারেশনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা কেউ আহত হননি। 

কিন্তু ২৯ আগস্ট সকালে বদিকে তার এক বন্ধুর বাসা থেকে আটক করে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা। ধারণা করা হয়, বদি সেই বাসায় আছে এই তথ্য কেউ পাকিস্তানিদের তখন জানিয়েছিল। তা না হলে বদি যে একজন গেরিলা এবং তখন সে এই বাড়িতে আছে এই তথ্যগুলি পাকিস্তানিদের জানার কথা নয়। 

বদিকে প্রচন্ড টর্চার করার ফলে সে আরও দুইজন মুক্তিযোদ্ধা সরকারী কর্মকর্তা এএসএইচকে সাদিকের ভাই মাসুদ সাদিক চুল্লু আর নিওন সাইনের মালিক সামাদের নাম প্রকাশ করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্রুত চুল্লু আর সামাদকেও আটক করে। এরপর ২৯ আগস্ট রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গেরিলাদের বাড়ি এবং থাকার জায়গাগুলি পাকিস্তানি সৈন্যরা একে একে ঘিরে ফেলে। 

সেই রাতে আজাদদের মগবাজারের বাড়িতে ছিলেন কাজী কামালউদ্দিন, জুয়েল, আর বাকি। পাকিস্তানি সৈনিকরা বাড়িতে ঢুকে সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করায়। জুয়েলের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের আঘাতপ্রাপ্ত আঙুলগুলো একজন পাকিস্তানি সামরিক অফিসার জোরে মুঁচড়ে দিলে তীব্র ব্যথায় জুয়েল চিৎকার করে উঠেছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তে কাজী সেই অফিসারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় পাকিস্তানি সেনারা কয়েক মুহূর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে যায়। এই সুযোগে কাজী ছুটে বাড়ি থেকে বের হয়ে পালিয়ে যান। কিন্তু পাকিস্তানিরা আজাদ সহ অন্যদের আটক করে। 

স্বপনদের মালিবাগের বাড়িতে যখন সেনাসদস্যরা যায় স্বপন বাড়ির পেছনে গোয়ালঘরের খড়ের গাদায় লুকিয়ে থাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে খুঁজে পায়নি। স্বপনকে ধরতে না পেরে তার বাবাকে আটক করে পাকিস্তানিরা এবং তাকে সেনাক্যাম্পে নিয়ে যেয়ে অত্যাচারও করা হয়েছিল। এলিফ্যান্ট রোডে রুমিদের বাড়ি ঘেরাও করে সেনাসদস্যরা রুমিকে তার বাবা এবং ছোট ভাইসহ তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। 

৩০ আগস্ট ভোরে সৈন্যরা গিয়েছিল আলতাফ মাহমুদের রাজারবাগের বাড়িতে। সৈন্যরা তাঁকে দিয়ে মাটি খুঁড়িয়ে অস্ত্র আর গোলাবারুদভর্তি দুটি ট্রাঙ্কই বের করে নেয় এবং আলতাফ মাহমুদকে আটক করে। সেদিন পাকিস্তানিরা রাইফেল দিয়ে আলতাফ মাহমুদের মুখে প্রচন্ড জোরে আঘাত করায় তাঁর সামনের দাঁত ভেঙ্গে গিয়েছিল। বেয়নেটের খোঁচায় কপালের চামড়া ছিঁড়ে চোখের উপর ঝুলছিল। সেনাক্যাম্পে নেয়ার পরও আলতাফ মাহমুদকে প্রচন্ড অত্যাচার করা হয়েছিল। তা সত্বেও বরেণ্য এই শিল্পী গেরিলাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাকিস্তানি সৈন্যদের জানাননি। হাবিবুল আলমদের দিলু রোডের বাড়িতে যেয়েও রান্নাঘরের মেঝের ¯স্ল্যাব ভেঙ্গে অস্ত্র আর গোলাবারুদ নিয়ে নেয় পাকিস্তানি সৈন্যরা।  

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেল থেকে চুল্লু আর সামাদকে উদ্ধার করা হয়েছিল। কিন্তু আলতাফ মাহমুদ, রুমি, বদি, আজাদ এবং জুয়েল আর কোনোদিন ফিরে আসেননি তাদের প্রিয়জনদের কাছে। কিউবায় ঔপনিবেশিক শাসন-বিরোধী সংগ্রামের প্রধান নেতা হোসে মার্তি বলেছিলেন, “একজন প্রকৃত মানুষ এমন পথের সন্ধান করেন না যেখানে সুযোগ-সুবিধা আছে, বরঞ্চ তিনি খোঁজেন সেই পথ যেখানে কর্তব্য তাকে ডাকে। তিনি জানেন মানুষের ভবিষ্যৎ স্বাচ্ছন্দ্য কোন পথে। কর্তব্যের পথ ধরেই কেবলমাত্র তা সম্ভব।” 

১৯৭১ সালে আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারাও সুযোগ-সুবিধার কথা ভাবেননি। বরং, প্রাণের ঝুঁকি তুচ্ছ করে কষ্টকর জীবনযাপনের মাধ্যমে তারা মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার কর্তব্য পালন করেছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের বহু মানুষ কি মনে রেখেছে সেই অসীমসাহসী মুক্তিযোদ্ধাদের? 

প্রযুক্তির প্রসারে বিনোদনধর্মী উপাদানের অবাধ প্রাচুর্যের এই সময়ে অজস্র মানুষ মেতে আছে বিনোদন উপভোগে। কিন্তু ৫০ বছর আগে আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীন করার জন্য যে মুক্তিযোদ্ধারা অসামান্য অবদান রেখেছিলেন এবং দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ-এর জন্য নিজেদের বর্তমান যারা উৎসর্গ করেছিলেন তাদের সম্পর্কে কতোটা গভীরভাবে জানে বর্তমান প্রজন্মের বহু তরুণ-তরুণী? কেবল বছরের কয়েকটি বিশেষ দিনেই কি তাদের স্মরণ করা যথেষ্ট? 

মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাসকারী আমরা যেন সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম এবং জীবনবিসর্জনের কথা মনে রাখার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ না হই। 

ড. নাদির জুনাইদ: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।