অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

পাহাড়ি জঙ্গলে এলাচের বন, সবুজ গুটিতে স্বপ্ন ভাসে ওমর শরীফের

কমল দাশ, চট্টগ্রাম থেকে

প্রকাশিত: ০৮:৪১ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২১ বৃহস্পতিবার   আপডেট: ১০:২১ এএম, ২৬ আগস্ট ২০২১ বৃহস্পতিবার

পাহাড়ে ধরেছে গুচ্ছ গুচ্ছ সুগন্ধী এলাচ। ফুলের গোড়ায় ধরে ফল। ছবি: কমল দাশ

পাহাড়ে ধরেছে গুচ্ছ গুচ্ছ সুগন্ধী এলাচ। ফুলের গোড়ায় ধরে ফল। ছবি: কমল দাশ

ফুল মাত্রই সুন্দর। তাই কাব্য-কবিতায় আমরা ফুলের উপমা পাই। এত যে সুস্বাদু আম- তাও আমের মুকুলেই কবির মুগ্ধতা। তেমনি চট্টগ্রামে মিরাশ্বরাইয়ের কয়লাবাজার পাহাড় এলাকার গভীর জঙ্গলে এলাচ গাছে ফুলগুলোই প্রথম আকর্ষণ করলো। গোলাপী ধাচের একটা রঙ। কিন্তু চোখে পড়লো প্রতিটি ফুলের গোড়াতেই সবুজ রঙা একটা করে গুটি। এই গুটিগুলোই একেকটা এলাচদানা। আদা-হলুদ-সটি গাছের সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে- এই এলাচের গাছের সঙ্গে তারা সাযুজ্য খুঁজে পাবেন। একই গোত্রের গাছ হয়তো। কিন্তু আদা কিংবা হলুদ যেমন গাছের নিচে শিকরে ধরে এই গাছে এলাচ ধরে গাছের গোড়ার ভাগটায়। গোড়ার দিক থেকে লম্বাটে ধরনের একটি ফুল বের হয়। আর ফুলের গোড়ার দিকটাতেই বেড়ে ওঠে ফল। এই ফলই হচ্ছে আমাদের পরিচিত এলাচ। এমন একটি দুটি নয় গাছের গোড়ায় মাটি সংলগ্ন হয়ে লতিয়ে ওঠা ডগাগুলোতে গুচ্ছ গুচ্ছ এলাচ ধরে। এখন গাঢ় সবুজ রঙ সেই এলাচের। 

পাঁচ বছর আগে জোহরা এগ্রো ফার্মসের উদ্যেক্তা ওমর শরীফ শখের বসে এলাচ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে আগ্রহী হলেই তো হবে না। উদ্যোগীও হতে হবে, যার কমতি নেই ওমর শরীফের। গুয়েতমোলা , শ্রীলংকা , থাইল্যান্ড, ভারত, ইরান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০টি চারা সংগ্রহ করে আনেন। এরপর সেই চারা দিয়ে এলাচের এক মিশ্র বাগান করেন এই পাহাড়ি অঞ্চলে। 

তবে পথটা মসৃন ছিলো না। চারা এনে লাগিয়ে দিলেই হয়ে যায় না, এর চাষের রীতিপদ্ধতিও রয়েছে। তা বুঝতে সময় লেগে যায়। এর বাইরে আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু হাল ছাড়েননি ওমর শরীফ। মূল শিক্ষক ছিলো ইন্টারনেট। ব্রাউজ করে করে বিভিন্ন দেশের এলাচ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে পড়াশুনা করে তার প্রয়োগ ঘটিয়ে তবেই এলাচ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন তিনি। 

কৃষি বিভাগ ও মসলা ইনস্টিটিউশনের কর্মকর্তারা একাধিকবার ওমর শরীফের বাগান পরিদর্শন করেছেন বলে জানান তিনি। 

এলাচ নিয়ে এখন ব্যাপক জ্ঞান রাখেন ওমর শরীফ। জানালেন, দু’রকমের এলাচ ফলে- বড় ও  ছোট। বড় এলাচ এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশাান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের শীত প্রধান অঞ্চলে প্রচুর জন্মায়। বড় এলাচের ৫০ প্রজাতির মধ্যে এ উপমহাদেশে বহু আগে থেকে বেশ কয়েকটির ফলন হয়। 

তবে চট্টগ্রামে এই সবুজ রঙের ছোট এলাচের চাষ ওমর শরীফই প্রথম শুরু করেছেন। এবং সাফল্য পেয়েছেন। 

জানালেন, আষাঢ় মাসে ফুল আসে এলাচ গাছে। আর ভাদ্র ও আশ্বিন মাসের শেষদিকে এলাচ পরিপক্ক হয়। তখন বাগান থেকে কাঁচা এলাচ সংগ্রহ করে  রোদে শুকাতে হয়। বেশি উৎপাদন হলে ড্রায়ার মেশিনে শুকাতে হয়। না শুকিয়ে ঘরে রাখলে পচন ধরবে। ফল পরিপক্ক হলে দেখতে কিছুটা সবুজের উপর লালচে হবে। চারা লাগানো থেকে ফল পেতে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়।

বিভিন্ন জাতের এলাচের মধ্যে সবুজ-কালো, নিল-সাদা ও বেগুনীসহ ১৩ জাতের এলাচ আমদানি করা হয় বাংলাদেশে। 

দেশে এলাচ চাষ নতুন নয়। সিলেট, বগুড়া ,সাতক্ষীরা, তিন পার্বত্য জেলাসহ বেশ কয়েক অঞ্চলে যে এলাচ জন্মে। তবে সেগুলো তার নাম  মোরঙ্গ এলাচ। 

কিন্তু সবুজ দানার এলাচ চাষ এটাই প্রথম। নিজের সাফল্যের পর কৃষকদের মাঝে এলাচের চাষ ছড়িয়ে দিতে জোহরা এগ্রো ফার্মস বাগানে এখন চারা উৎপাদনেও মন দিয়েছেন ওমর শরীফ। যেখানে এবার প্রায় ১০ হাজার এলাচ চারা গজানো হবে। 

"বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষে আগ্রহীরা এই বছর আমার কাছ থেকে চারা কিনতে পারবেন। চারা বড় হলে আগ্রহী চাষিদের কাছে বিক্রি করতে পারবো। তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশ  থেকে আর এলাচ আমদানি করতে হবে না," বলছিলেন এই কৃষি উদ্যোক্তা। 

তার স্বপ্ন সেখানেই থেমে নেই। বলছিলেন, "দেশের মাটিতে উৎপাদিত এলাচ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা হবে বিদেশেও। এতে সরকার পাবে বৈদেশিক মুদ্রা। আর সরকার যদি বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষে আগ্রহীদের আর্থিক সহযোগিতা করে তাহলে খুব অল্প সময়েই এ স্বপ্নপূরণ সম্ভব।"

ভারত, চীন ও মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের উর্বর জমি এলাচ চাষের উপযোগী। এলাচ চাষে আলাদা কোনো জমি প্রয়োজন হয় না। 

ওমর বলেন, "পাঁচ বছরের পরিশ্রমে আমি দেখেছি, অন্য গাছের ছায়া তলে এলাচের ভালো ফলন হয়। তাই আমি মিশ্রফলের বাগানে এলাচ চাষ শুরু করেছি। যে কেউ বাড়ির আঙ্গিনা অথবা ফলদ বৃক্ষের বাগানে এ জাতের সবুজ সুঘ্রানি মসলা এলাচের চাষ করতে পারবে। 

পোলাও, মাংস, মিষ্টান্ন বাঙালির রান্নায় সুগন্ধ ছড়াতে এলাচ অন্যতম প্রধান মসলা। যার রয়েছে অসংখ্য ঔষধী গুণ। দেশের খুচরা বাজারে প্রতি  কেজি বড় দানা এলাচের দাম ৪০০০ টাকা, মাঝারি দানা এলাচ ৩০০০ টাকা ও  ছোট দানার এলাচ ২০০০ টাকার মতো।