অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বুন্ডেসটাগ নির্বাচন: কি, কেন এবং কিভাবে?

বিপ্লব শাহরিয়ার

প্রকাশিত: ০৬:০৩ পিএম, ২২ আগস্ট ২০২১ রোববার   আপডেট: ০৪:৩৫ পিএম, ২৪ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার

আসছে ২৬ সেপ্টেম্বর জার্মানির ফেডারেল পার্লামেন্ট বুন্ডেসটাগের সাধারণ নির্বাচন। ওইদিন নির্ধারিত হয়ে যাবে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মের্কেলের উত্তরসূরী। অনেকেরই জানার আগ্রহ আছে কিভাবে কাজ করে জার্মানির ফেডারেল নির্বাচন ব্যবস্থা। পাঠকদের জন্য এই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো এখানে।

ভোটার কারা?
জার্মান সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘সার্বজনীন, মুক্ত, সমতাপূর্ণ এবং গোপন নির্বাচনের' মাধ্যমে বুন্ডেসটাগের সদস্যদের নির্বাচন করা হবে৷ অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্করা (যাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর) তাদের সম্পত্তি, শিক্ষার মান অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে ভোট দিতে পারবেন৷ প্রত্যেক ভোটারের দু'টি করে ভোট থাকবে। প্রথমটি কোনো প্রার্থীর জন্য; দ্বিতীয়টি কোনো দলের সমর্থনে৷

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন কিংবা সুইজারল্যান্ডের সাথে জার্মান নির্বাচন পদ্ধতির সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। তা হলো, জার্মানিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ নয় বরং প্রতিনিধিত্বমূলক৷ এক্ষেত্রে পার্লামেন্ট সদস্যদের ভূমিকাটি মূলত কেন্দ্রীয়। তারা জনগণের মনোভাব ও ইচ্ছার প্রতিনিধি৷ প্রত্যক্ষ  গণতন্ত্রের আদর্শ দৃষ্টান্ত যদি ধরা হয়, সেটি সুইজারলান্ড। সুইসরা গণভোটের মাধ্যমে আইন প্রণয়ন করেন। পক্ষান্তরে জার্মানিতে শুধুমাত্র গণপ্রতিনিধি, অর্থাৎ পার্লামেন্ট সদস্যদের মাধ্যমেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর অর্থ – যেকোনো আইন পাস করেন গণপ্রতিনিধিরা।

জার্মান সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্ট সদস্যরা ‘সমগ্র জনগণের প্রতিনিধি এবং কোনো আদেশ বা নির্দেশে আবদ্ধ নন, শুধু নিজেদের বিবেকের কাছে দায়ী৷' সাংবিধানিকভাবেই সাধারণ জার্মান ভোটাররা নির্বাচন পদ্ধতির উপর নজর রাখতে পারেন। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সাধারণ ভোটারের উপর অর্পিত৷ যদি কোনো ভোটারের মনে হয়, ভোটপর্বে কোনোরকম ব্যাঘাত বা ব্যতিক্রম হয়েছে, তাহলে তিনি ভোট বাতিল করার দাবি তুলতে পারেন৷ 

বুন্দেসটাগ
বুন্ডেসটাগ মূলত জার্মান ফেডারেল পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ। যার নির্বাচন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী ওয়েমার প্রজাতন্ত্রকালীন নির্বাচনী ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে জার্মানরা। সে সময়ের ভুল রাজনৈতিক যে বিভাজন তৈরি করেছিলো তা থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই একটা জটিল ব্যবস্থা বেছে নিয়েছেন জার্মানরা। বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ এবং আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বকে সমন্বিত করে তা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করছে।

২০০২ সাল থেকে বুন্ডেসটাগের সদস্যসংখ্যা ৫৯৮৷ এর মধ্যে ২৯৯টি আসন সেই সব প্রার্থীদের, যারা সংশ্লিষ্ট ২৯৯টি নির্বাচনি এলাকায় সর্বাধিক ভোট পেয়েছেন। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অন্য কোনো শর্ত নেই৷ এই প্রার্থীরা সরাসরি নির্বাচিত হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়৷ বুন্ডেসটাগের বাকি ২৯৯টি আসনের দাবিদাররা আসেন ভোটারদের দ্বিতীয় বা দলীয় ভোট থেকে৷ রাজনৈতিক দলগুলোর তথাকথিত ‘প্রাদেশিক প্রার্থী তালিকা' অনুযায়ী, এই সদস্যরা বুন্ডেসটাগে আসন পান। ১৬টি রাজনৈতিক দলের প্রতিটি দল রাজ্য বা প্রদেশ অনুযায়ী তাদের প্রার্থী তালিকা পেশ করে। প্রাদেশিক তালিকাগুলো মিলিয়ে তৈরি হয় প্রত্যেক দলের একটি ‘ফেডারাল প্রার্থী তালিকা'। এই তালিকার শীর্ষে থাকেন দলের শীর্ষ প্রার্থী৷ যেমন এ বছর সিডিইউ/ সিএসইউ দলের শীর্ষ প্রার্থী আরমিন লাশেট। এসপিডি'র তালিকার শীর্ষে আছেন ওলাফ শোলজ। আর গ্রিন পার্টির শীর্ষ প্রার্থী আন্নালেনা বায়েরবক। এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জনগণের সরাসরি ভোটে কিন্তু চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয় না। সেটি নির্বাচন করে থাকেন পার্লামেন্ট সদস্যরা।

এক ভোটার, দুই ভোট
আগেই বলেছি, জার্মানিতে প্রত্যেক ভোটারের দু'টি করে ভোট রয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় ভোটটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দ্বিতীয় ভোটটি দিয়েই নির্ধারিত হয় বুন্ডেসটাগে কোন দলের কতটি আসন থাকবে। উদাহরণস্বরূপ, কোনো দল যদি দ্বিতীয় ভোটের ৩৫ শতাংশ পেয়ে থাকে, তবে বুন্ডেসটাগে সেই দলের ৩৫ শতাংশ আসন থাকবে৷ দ্বিতীয় ভোটের মাধ্যমে ভোটাররা বুন্ডেসটাগের রাজনৈতিক দলগুলোর দলগত শক্তি ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারণ করে থাকেন৷ দ্বিতীয় ভোটের মাধ্যমে একটি দল কতগুলো আসন জয় করেছে, তা নির্দিষ্ট হওয়ার পর সেই বাড়তি আসনগুলি প্রাদেশিক প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী বণ্টন করা হয়৷এখানে উল্লেখ্য, ভোটার চাইলে তাদের প্রথম ভোটে এক দলের প্রার্থীকে এবং দ্বিতীয় ভোটে অন্য দলকে ভোট দিতে পারেন। কেউ চাইলে যেকোনো একটি ভোটও দিতে পারেন। 

সেক্ষেত্রে অবশ্য একটা সমস্যাও দেখা দিতে পারে। যদি কোনো দল দ্বিতীয় ভোট অনুযায়ী তাদের যত আসন পাওয়ার কথা, তার চেয়ে বেশি আসন প্রথম বা সরাসরি ভোটেই পেয়ে যায়। তখন বুন্ডেসটাগে কিন্তু তাদের আসনসংখ্যা বেড়ে যায়। এ ধরণের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। দলটি প্রথম ভোটের মাধ্যমে যেসব আসন জয় করে, সেগুলো থেকে যায়। দ্বিতীয় ভোটের অনুপাত অনুযায়ী আসনসংখ্যা কমে না। বরং বেড়ে যায় মোট সদস্যসংখ্যা। কারণম দ্বিতীয় ভোট অনুযায়ী অন্যান্য দলের প্রাপ্য আসনের অনুপাত বজায় রাখাতে তাদের বাড়তি আসন দিতে হয়। এর অসুবিধা, এর ফলে বুন্দেসতাগের আকার বেড়ে যেতে পারে। যেমনটি হয়েছিলো ২০১৭ সালে। বুন্ডেসটাগের আসনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০৯-এ।

ন্যূনতম পাঁচ শতাংশ ভোটের বেড়াজাল
এটিকে জার্মান নির্বাচন পদ্ধতির বিশেষত্ব বলা হয়ে থাকে। এই ব্যবস্থা অবশ্য অনেক দেশেই দেখা যায়। যেমন, ইসরায়েলে ৩.২৫ শতাংশ, তুরস্কে ১০ শতাংশ। এই বেড়া পার করতে না পারলে একটি রাজনৈতিক দল পার্লামেন্টে আসন পায় না। জার্মানিতে পাঁচ শতাংশ ন্যূনতম ভোটের শর্ত রাখার কারণ হলো, গত শতাব্দীর বিশের দশকে পার্লামেন্টে বহু দলের উপস্থিতির ফলে স্থিতিশীল সরকার গঠনে সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ কিন্তু সমালোচকরা যুক্তি দেখান যে, পাঁচ শতাংশে না পৌঁছানোর কারণে বহু প্রদত্ত ভোটের অপচয় হয়। যেমন ২০১৩ সালের নির্বাচনে এই পন্থায় প্রায় ৭০ লাখ ভোট অপচয় হয়েছিল৷ ন্যূনতম ভোটের বেড়া নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সত্ত্বেও এ বছরের নির্বাচনে পাঁচ শতাংশ ভোটের বেড়া বহালই থাকছে৷

নেই শো-ডাউন, নেই ইভিএম
চারদিকে দলীয় পতাকা, ব্যানার, পোস্টারে সয়লাব। মোড়ে মোড়ে দলীয়কর্মিদের জটলা, রাস্তায় মিছিল। এসবের কিছুই দেখা যায় না জার্মানিতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাওয়ার সংস্কৃতিও নেই এখানে। কেউ যদি ভোটকেন্দ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়, চট করে বুঝতে পারবে না যে এখানেই ভোট হচ্ছে।

তালিকাভুক্ত ভোটারদের লেটারবক্সে ভোটের কয়েক সপ্তাহ আগেই চিঠি পৌঁছে দেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। জাতীয় পরিচয়পত্র আর ওই চিঠি নিয়ে যেতে হয় ভোটকেন্দ্রে। এই দু'টি যাচাইয়ের পর মেলে ব্যালট পেপার। ঘেরাটোপের মধ্যে বসে পছন্দের প্রার্থী ও দলের নামের পাশে কলম দিয়ে ক্রস চিহ্ন দিয়ে সেটি নির্ধারিত বাক্সে ঢুকিয়ে দিতে হয়।

তবে ভোটের দিন যদি কেউ ব্যস্ত থাকেন, তার জন্যও রয়েছে বিকল্প ব্যবস্থা। আগেভাগেই ব্যালট সংগ্রহ করে খামে করে ভোট দিতে পারবেন তিনি। বিদেশে বসবাসরত জার্মান নাগরিকরাও ভোটার তালিকায় নিজেদের নাম অন্তুর্ভূক্তের আবেদন করে এই প্রক্রিয়াতে ভোট দিতে পারেন৷

জার্মানিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের কোনো ব্যবহার নেই৷ ভোট যেমন দিতে হয় কাগজের ব্যালটে, তেমনি ভোট নেয়া শেষ হলে হাতে করেই গোনা হয় ব্যালট। তাই ফলাফল সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাষ পেতে একটু সময় লেগে যায়৷

বিপ্লব শাহরিয়ার: জার্মানপ্রবাসী সাংবাদিক।