অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে

মাহমুদ মেনন, সম্পাদক

প্রকাশিত: ১১:৪৫ পিএম, ১৪ আগস্ট ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০৯:৪১ এএম, ১৫ আগস্ট ২০২১ রোববার

ছবি: আবইয়ায আইয়ান, ১১

ছবি: আবইয়ায আইয়ান, ১১

এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,
সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে-
বত্রিশ নম্বর থেকে
সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে
অমল রক্তের ধারা ব’য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।

যে সিঁড়ির কাব্য গাঁথা গেঁথেছেন কবি, তার কথা আর কে না জানে। এক পর্বতে সৃষ্ট যে রক্তের ধারা তাতো বাংলার শ্যামলিমা প্রান্তর বেয়ে বঙ্গোপসাগরেই মিশবে। একটি পাহাড়সম মানুষের উচ্চশৃঙ্গ শির বেয়ে যে রক্ত ধারা বয়ে নামবে তা অমলই বটে। বুলেটের আঘাতে বুক চিরে যে শ্রোতধারা বয়ে নেমে এসেছিলো তা আজ সবুজ পতাকার মাঝে সূর্যরাঙা লালে মিশে একাকার হয়ে গেছে। 

‘যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তত, কেউ তাকে মারতে পারে না’, এমনটাই বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুকে ভয় পেতেন না। দেশের জন্য জীবন দিতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। আর সে কারণেই মৃত্যু তাঁকে ছুঁতেও পারেনি। 

বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা অমোঘ কবিতাখানি অমর হয়ে রয়ে গেছে বাঙলা ও বাঙালির প্রাণে- 
‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুমালা রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।’

অন্নদাশঙ্কর রায় কবিতাটি লিখেছিলেন ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে। তখন বিজয়ের আর মোটেই দিন কয়েক বাকি। দিব্য চোখে শেখ মুজিবুর রহমানের জয় দেখতে পেয়েছিলেন এই কবি। আরও দেখতে পেয়েছিলেন তার কীর্তির অনন্য অনন্ত যাত্রা। পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনার বহমানতায় সে নাম আজও রয়ে গেছে। থাকবে। 

জীবন নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবনায় ছিলো না কোনও আকাঙ্খা। বরং মৃত্যুকেই তিনি দেখতেন বড় করে। মৃত্যু কথাটি গৌরবান্বিত হয়েছে তার মুখে বার বার। তার জীবন ভাবনায় ছিলোনা কোনো চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ। তাই তো তিনি বলতে পেরেছিলেন- ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?’

সেতো ছিলো জীবন নিয়ে তার নিজের ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। নিজের এই ভাবনাকেই তিনি চেয়েছিলেন অন্যদের মাঝেও ঢুকিয়ে দিতে। যার মূল লক্ষ্য ছিলো কিছু মানুষের শোষণ-অত্যাচার থেকে শোষিতদের রক্ষা করা। দেশের জন্য মৃত্যু ছিলো তার কাছে মামুলি ব্যাপার মাত্র। তিনি জানতেন, মরতে শেখা জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনা। সে কারণে, দেশের জন্য মৃত্যুতে নিজের প্রস্তুতির পাশাপাশি অন্যকেও উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বলতে পেরেছিলেন, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। আরও বলতে পেরেছিলেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।

কেবল যে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাই নয়, কোন পথে মানুষ দেশের জন্য, আপনার জন্য জীবন দিতে রাজী থাকবে সে কথাও উচ্চারিত হয়েছে তার মুখে। তিনি জানতেন মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আর মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যার সাক্ষর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তার জীবনের গোটা ক্যানভাসে নানা পর্যায়ে রেখে গেছেন। আর তার সেই চেতনাবোধ, মানুষের প্রতি তার আস্থা তাকে এমনই কিছু দিয়েছিলো। তার ডাকে দেশের ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়ে দেশকে এনে দিলো স্বাধীনতা। 

মৃত্যুকে তিনি গৌরবান্বিত করতে পেরেছিলেন চেতনায় ও আত্মনিয়োজনে। সে কারণেই তার মুখে উচ্চারিত হয়েছিলো, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালোবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবন দিতেও পারে।

আর মৃত্যুর শান্তি তিনি খুঁজেছিলেন বাংলার মানুষের মুখে ফোটানো হাসিতে। একটি স্বাধীন দেশ এনে দেওয়ার পর তিনি দেশের মানুষের মুখে সেই হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। দেশের মানুষকে তিনি দুঃখী যেমন দেখতে চাননি। মৃত্যুর সুখ তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তার দেশের প্রতিটি মানুষের পেটপুরে দুবেলা খাবার খাওয়ার মধ্যে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি যদি বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে না পারি, আমি যদি দেখি বাংলার মানুষ দুঃখী, আর যদি দেখি বাংলার মানুষ পেট ভরে খায় নাই, তাহলে আমি শান্তিতে মরতে পারব না।

এত কিছুর পরেও নিজেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভাবতেই পছন্দ করতেন। চোঙ্গা হাতে এক রাজনীতিবিদ হিসেবেই দেখতেন নিজেকে। আর মৃত্যুর পরে তার অনেক কীর্তিগাঁথা রচিত হোক সেটাও তিনি চাননি। সর্বোচ্চ তার কবরে একটি টিনের চোঙ্গাই তিনি চেয়েছিলেন। আর সেই টিনের চোঙ্গায় বাঙালি বাঙালি চিৎকার করতে করতে মারা যেতেও প্রস্তুত ছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি মারা গেলে আমার কবরে একটা টিনের চোঙ্গা রেখে দিস। লোকে জানবে এই একটা লোক একটা টিনের চোঙ্গা হাতে নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিল এবং সারাজীবন সেই টিনের চোঙ্গায় বাঙ্গালি বাঙ্গালি বলে চিৎকার করতে করতেই মারা গেল’। 

নিজেকে তুচ্ছজ্ঞান করা মানুষটি যে কতবড় কত মহীয়ান তা বিশ্ব আজও দেখছে। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে- একজন জীবিত শেখ মুজিবের চেয়েও শক্তিধর হয়ে উঠেছে একজন মৃত শেখ মুজিব। তার চেতনা বহমান বাঙালির হৃদয়ে। থাকবে চিরকাল।  
 
এই যে ১৫ আগস্ট- এদিনে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে ঘটেছিলো কী কোনও হত্যাকাণ্ড? ঘাতকেরা কী পেরেছে জাতির জনককে হত্যা করতে? না পারেনি। বরং তারা কয়েকটি গুলি ফুটিয়েছে মাত্র। তাতে রক্তের বন্যা বয়েছে মাত্র। সরদার ফজলুল করিম তার এই সেই ১৫ আগস্ট ’৭৫ নিবন্ধে লিখেছেন- শেখ মুজিবকে যখন সে রাতে ঘেরাও করে অস্ত্রধারীরা হত্যা করলো তখন সাহসী শেখ মুজিব ভীত হলেন না। যারা তাকে গুলি করলো তাদের তিনি চেনেন। তার মুখেও উচ্চারিত হয়েছিলো বিস্ময়ের ধ্বনি। তোরা কি করছিস! এই কথা বলেই নিজের ঘরের সিঁড়ির ওপর তিনি গড়িয়ে পড়েছিলেন।

সেই সিঁড়ি আজও রক্তধারায় জীবন্ত। তাই কবি লিখেছেন- এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে...। সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে--বত্রিশ নম্বর থেকে সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে অমল রক্তের ধারা ব'য়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে...। সত্যিই তাকে কেউ মারতে পারেনি। তার মৃত্যুহীন মৃত্যুর জীবনধারা আজো বহমান বাংলার সবুজ প্রান্তরে...।

মাহমুদ মেনন: সম্পাদক, অপরাজেয় বাংলা।