অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বঙ্গবন্ধুর যেসব অনন্য উক্তি জাগিয়ে তোলে প্রাণশক্তি 

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১২:৫৭ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ০২:৩৩ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার

শোকের মাস আগস্ট এলেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে। লাখো কোটি বাঙালির হৃদয়ে ব্যথিত চিত্তে উদিত হয় সেই কালরাতের কথা! জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে বঙ্গবন্ধু রাঙিয়ে গেছেন আমাদের ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাক ডাকা ভোরে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নারকীয় পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়। যিনি স্বাধীনতার স্থপতি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যিনি না হলে এদেশ স্বাধীন হতো না। তাঁকেই স্বাধীন দেশে প্রাণ দিতে হলো! এর চেয়ে মর্মপীড়াদায়ক ও দুঃখজনক ঘটনা বাংলার ইতিহাসে আর কী হতে পারে? বাঙালি জাতির জনক হত্যার এ মাসটি বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে কলঙ্কময়, বেদনার মাস। এই মাসে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধায়, কান্নায় এবং ভালোবাসায়। 

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী, বাংলাদেশ বিরোধী দেশীয় বেঈমান ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বিদের পরাজয়ের সুপরিকল্পিত জঘন্য ও কাপুরুষোচিত নির্মম প্রতিশোধ ছিলো এই রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে বিভীষিকাময় একটি ঘটনা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। হত্যাকারীরা শুধু ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি। বঙ্গবন্ধুর গড়া ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশটাও হত্যার চেষ্টা করে। ষড়যন্ত্রকারীরা বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পুরো বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করার অপপ্রয়াস চালায়। স্বাধীনতা বিরোধীরা ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে নেয়ার অপচেষ্টায় দেশ ও জাতিকে বিপথগামী করে। বাংলাদেশ নিমজ্জিত হয় গভীর অন্ধকার গহ্বরে। মানুষ দীর্ঘদিন নিপীড়িত হয় উর্দিপরা, সাফারি পরা, মুখোশ পরা ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে। যারা মেকি গণতন্ত্রের নামে পকেটে পুরে নেয় পুরো দেশ। চেপে বসে স্বৈরশাসন। জাতির টুঁটি চেপে ধরে সাম্প্রদায়িকতা। দেশের ভেতরে বেড়ে যায় অপশক্তির তৎপরতা। নৈতিকতা-মূল্যবোধ-সততা ও আদর্শহীন কিছু মানুষের ক্ষমতা এবং বিত্তের প্রতি লোভ থমকে দেয় বাঙালির মর্যাদাশীল জাতি হওয়ার স্বপ্ন। জেঁকে বসে পুঁজিবাদের শাসন। বাড়তে থাকে মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা। সমাজে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। 

শুধু কি তাই? বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে নানা পাঁয়তারা করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নেয়া হয় বঙ্গবন্ধু নির্বাসনের পরিকল্পনা। মনোজগত থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরানোর চেষ্টা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণও নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। পাঠ্যপুস্তক, টিভির পর্দা থেকে সরিয়ে দেয়া হয় বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ তা বাজাতে দেয়া হতো না। এমন এক সময় গেছে, যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করাও যেতো না। তাঁর হত্যার বিচার চাওয়ার সুযোগ ছিলো না। খুনিদের বিচার থেকে রেহাই দিতে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সচল হয়। দেরিতে হলেও বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েকজনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হয়েছে। অন্যরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। পলাতক খুনিদের দেশে এনে তাদের শাস্তি কার্যকর করা সরকারের কর্তব্য।

বঙ্গবন্ধু নামের সঙ্গে মিশে রয়েছে বাঙালির ইতিহাস। ইতিহাস থেকে কখনো বঙ্গবন্ধুকে সরানো সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধুর ছবি। যাঁর ছিলো মাত্র ৫৫ বছরের জীবন। জীবনের স্বর্ণযুগ কাটিয়েছেন অগণিত অসহায়-নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকে। এ যেনো এক মহামানবের জীবনের মহাকাব্য। তাই তো, তাঁকে ঘিরে রচিত হয়েছে এতো লেখা, এতো কবিতা, ছড়া, গান, গল্প, নাটক, বই, পুস্তক, ইতিহাস, প্রবন্ধ সাহিত্য ইত্যাদি। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু। তিনি বাঙালি তরুণ প্রজন্মের মাঝে সময়োপযোগী আত্মপোলব্ধির উন্মেষ ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। অসাধারণ ও অতুলনীয় ধৈর্য্য, মনোবল, তিতিক্ষা ও সাহসের অবিস্মরণীয় সম্মিলন ঘটেছিলো বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে। যা শুধু সেকালের ও একালের বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর যেকোনো দেশে, যেকোনো কালের এক বিরল ঘটনা। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট থেকে শুরু করে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে মহান প্রচেষ্টা, আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধ চলেছিলো এবং যার রাজনৈতিক ইতিহাস ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হয়েছিলো, তার প্রান্তিক পরিণতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের স্রষ্টা, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও মহানায়ক হয়ে রয়েছেন প্রজন্মের হৃদয়ে। তরুণ প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধু মহান আদর্শ ব্যক্তিত্ব এবং মহাপুরুষ। 

১৯৭২ সালের প্রথমদিকে লন্ডনে যুক্তরাজ্যের প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনার এতো শক্তির উৎস কোথা থেকে আসে? আপনার দুর্বলতাই বা কি?’ অকপট উত্তরে নিজের মত করে বঙ্গবন্ধু শুধু বলেছিলেন, ‘আমার শক্তির উৎস হচ্ছে, আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, আমি আমার বাংলার মানুষকে একটু বেশিই ভালোবাসি।’ জি হ্যাঁ। এমনই সরল-সহজ, চৌকস বুদ্ধিদীপ্ত, কাব্যময় ভাষায় কথা বলায় দারুণ অভ্যস্ত মানুষ ছিলেন আমাদের বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর পরই বিখ্যাত ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান যে সত্যিই অসাধারণ কাব্য হতে পারে তা আগে কি এমন করে কেউ প্রমাণ করতে পেরেছেন? যেমনটা পেরেছেন ক্যারিশমেটিক নেতা বঙ্গবন্ধু?

ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ মহানায়ক বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নপুরুষ, তারুণ্যশক্তির আদর্শ ও অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধুর জীবনের প্রতিটি ঘটনা এই প্রজন্মের অনুকরণীয়। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য, কথা, অমীয় বাণী বা অনন্য উক্তি’র মধ্যেই বঙ্গবন্ধুকে চেনা যায়, চোখে দেখা যায়, তাঁর কথা শোনা যায়। প্রজন্মের সন্তানরা বঙ্গবন্ধুর কাব্যময় অনন্য উক্তিগুলো বইপত্র খুঁজে আগ্রহ নিয়ে পাঠ করে, বুক মার্কিং করে রাখে ও অনুপ্রাণিত হয়। আগামীর বাঙালি জাতি হিসেবে টিকে থাকতে হলে তরুণ প্রজন্মকে বারবার পাঠ করা দরকার বঙ্গবন্ধু’র অনন্য উক্তি। বঙ্গবন্ধুর অনন্য উক্তি চিরকাল বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে চলায় প্রেরণা জোগাবে ও উদ্দীপিত করবে। আগামীতে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে তরুণ প্রজন্মের পাথেয় হিসেবে কাজে লাগবে বঙ্গবন্ধু’র অনন্য উক্তি।

১। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!
২. ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে।
৩. গরীবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে।
৪. সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।
৫. যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।
৬. সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন।
৭. যখন তুমি কোন ভদ্রলোকের সাথে খেলবে তখন তোমাকে ভদ্রলোক হতে হবে, যখন তুমি কোন বেজন্মার সাথে খেলবে তখন অবশ্যই তোমাকে তার চাইতে বড় বেজন্মা হতে হবে। নচেৎ পরাজয় নিশ্চিত।
৮. আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দূর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালবাসি।
৯. জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?
১০. বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
১১. যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, কেউ তাকে মারতে পারে না।
১২. আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।
১৩. বাংলার উর্বর মাটিতে যেমন সোনা ফলে, ঠিক তেমনি পরগাছাও জন্মায়! একইভাবে, বাংলাদেশে কতকগুলো রাজনৈতিক পরগাছা রয়েছে, যারা বাংলার মানুষের বর্তমান দুঃখ-দূর্দশার জন্য দায়ী।
১৪. পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।
১৫. ভুলে যেয়ো না। স্বাধীনতা পেয়েছো এক রকম শত্রæর সাথে লড়াই করে। তখন আমরা জানতাম আমাদের এক নম্বর শত্রæ পাকিস্থানের সামরিক বাহিনী ও শোষকগোষ্ঠী। কিন্তু, এখন শত্রæকে চেনাই কষ্টকর।
১৬. বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।

বঙ্গবন্ধুর অনন্য উক্তি পড়তে হবে, বুঝতে হবে, জানতে হবে, চিনতে হবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানীদের দোসর, নেপথ্যের খলনায়কদের। তারা এখনও চুপ করে বসে নেই। সক্রিয়। মৃত বঙ্গবন্ধুকে এখনও তারা ভয় পায় ভীষণ। সুযোগ পেলেই অতীতের মতো বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ম্লান করতে, ইতিহাস বিকৃত করতে সদা তৎপর। তাদের হাতে দেশ কখনও নিরাপদ নয়, নিরাপদ থাকতে পারে না। দেশের মানুষকে স্বাধীনতার অপশক্তি থেকে রক্ষা করতে তরুণ প্রজন্মের মনে প্রাণ শক্তি জাগায় বঙ্গবন্ধুর অনন্য উক্তি। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দু’টোতে তরুণ প্রজন্মের ওপর বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস এবং তাঁর নিজের তরুণ জীবনের সংগ্রামের ইতিহাস লিখে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত পড়াশোনা করা যায়, ততই অবাক হতে হয়। তাঁর সংগ্রাম মুখর কর্মময় জীবন ও আদর্শ থেকে শিক্ষা নেয় গবেষক, তরুণ প্রজন্ম। শোকাবহ এই আগস্টে ইতিহাসের উজ্জ্বল মহিমা বঙ্গবন্ধুর জীবনী, অনন্য উক্তিসমূহ নতুন করে চর্চা ও শিক্ষা গ্রহণের সময় এসেছে। 

শেখ আনোয়ার: লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।