অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বিলুপ্তির পথে বণ্যপ্রাণীরা

রাজিব শর্মা

প্রকাশিত: ০২:১১ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২১ বুধবার   আপডেট: ০৩:২১ পিএম, ৪ আগস্ট ২০২১ বুধবার

আমরা জানি, প্রত্যেক বন্যপ্রাণী পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষ ও পরিবেশের উপর বন্যপ্রাণীদের উপকারী ভূমিকার কথা ফলাও করে প্রচার করা হয়। এখানে একটা প্রশ্ন আসে, বন্যপ্রাণীর যদি কোনো রকম পরিবেশগত উপকারী ভূমিকা না থাকত, তবে কি এদের রক্ষার কোনো প্রয়োজনই হতো না? হতো। একটি সুন্দর ফুল গাছ, একটি মনোহর পাখি কিম্বা একটি আদুরে বিড়াল ছানার কোনো উপযোগিতা যদি নাও থাকত, তবুও যেমন মানুষ সৌন্দর্য রক্ষার তাগিদে এদের রক্ষা করত, তেমনি জীবজগতের সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে বন্যপ্রাণীরা সংরক্ষিত হওয়ার দাবি রাখে। নিচে কিছু বন্যপ্রাণীর কথা তুলে ধরা হলো যেগুলো এখন বাংলাদেশে বিলুপ্তের পথে। 

মায়া হরিণঃ

মায়া হরিণ বাংলাদেশের অত্যন্ত বিরল আর বিলুপ্তপ্রায় বন্যপ্রাণী। খর্বকায় প্রাণীটির উচ্চতা দেড়-দুই ফুটের মত হয়, ওজন হয় ১৪-২৮ কেজি। খুব ভীরু স্বভাবের এই হরিণ ভয় পেলে বা আক্রান্ত হলে অনেকটা কুকুরের মত ডাকে বলে একে ইংরেজিতে বার্কিং ডিয়ার (Barking Deer) বলা হয়। মায়া হরিণ নিবিড় ঘন অরণ্যে এবং পাহাড়ি বনাঞ্চলে খুব সতর্কাবস্থায় বিচরণ করে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ঘাস, লতাপাতা, বনজ বৃক্ষের ঝরে পড়া ফল প্রভৃতি। এই প্রজাতির হরিণ একাকী ঘুরে বেড়াতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, তবে ২-৩টি হরিণকে দলবেঁধেও বেড়াতে দেখা যায়। মায়া হরিণের আয়ুষ্কাল ১৫ থেকে ২০ বছর।

গভীর জঙ্গলে সচকিত মায়া হরিণ

মায়া হরিণ পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চল এবং সিলেটের মৌলভীবাজারে বিশেষত লাউয়াছড়া অরণ্যে খুব কম সংখ্যায় রয়েছে। এছাড়া কক্সবাজারের ডুলাহাজারার সাফারি পার্কে কিছু মায়া হরিণ থাকার প্রমাণ মেলে। এক শ্রেণীর অবিবেচক মানুষ মাংস, চামড়া ও শিঙের লোভে ক্রমাগত এদের শিকার করায় সুন্দর প্রাণীটি দিন দিন বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।

বনমোরগ-মুরগি

বনমোরগ-মুরগি বন্যপ্রাণীর অন্তর্ভুক্ত নয়, বন্য পাখি প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। বনমোরগ-মুরগি দেখতে আমাদের গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতই। তবে বনমোরগ-মুরগির স্বভাব ও জীবনাচার পোষা মোরগ-মুরগি থেকে অনেকটা ভিন্ন। এরা এক গাছ থেকে আরেক গাছে, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অনেকটা উড়ে যেতে পারে। আকারে পোষা মোরগ-মুরগি থেকে ছোট বনমোরগ-মুরগি ক্ষিপ্রগতিতে ছুটতেও পটু। এরা সাধারণত ঘন নিবিড় বনভূমি ও তৃণভূমিতে চরে বেড়ায়, খায় বনের ফলমূল, কীটপতঙ্গ, ঘাসপাতা, ছোট সাপ, ব্যাঙ, কাঁকড়া ইত্যাদি। 

বনমুরগি শুকনো লতাপাতা, ডালপালা দিয়ে ঘন ঝোপের আবডালে বাসা বাঁধে। এক সময় বাংলার নিবিড় অরণ্যে তো বটেই গ্রামীণ ঝোপঝাড়, ছোটখাটো জঙ্গলেও দেখা যেত এদের। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়, বন উজাড় তো আছেই, সেইসাথে আদিবাসী ও বনসংলগ্ন মানুষের নির্বিচার শিকার বনমোরগ-মুরগিদের বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

খাবারের সন্ধানে বনমুরগি

বিশেষ করে চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলে অতিথি আপ্যায়ন, উপঢৌকন প্রদান, শখ করে মাংস চেখে দেখা প্রভৃতি উদ্দেশ্যে এক শ্রেণীর মানুষ শিকারিদের বড় অংকের টাকা অগ্রিম দিয়ে রাখে। 
বর্তমানে বন্যপ্রাণী রক্ষা আইনে সবরকম বন্য পশুপাখি ধরা, হত্যা, পালন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও বিশেষ করে আদিবাসীরা বনমোরগ-মুরগি ধরা অব্যাহত রেখেছে। তারা ফাঁদ পেতে এদের শিকার করে। আবার কখনো শস্যদানায় বিষ মিশিয়ে এদের খাইয়ে দেয়। বিষের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কখনো কখনো বনমোরগ নিজের ধারালো নখর দিয়ে নিজেরই শ্বাসনালী ছিড়ে আত্মহত্যা করে। আশার কথা হলো এখনো কিছু কিছু বনমোরগ-মুরগি পার্বত্য বনাঞ্চল, সুন্দরবন, শ্রীমঙ্গল, লাউয়াছড়া, সাতছড়ি সংরক্ষিত বনাঞ্চল, গারো পাহাড়ে টিকে আছে। এদের রক্ষায় বন বিভাগের নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে আদিবাসীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই।

গন্ধগোকুল

গন্ধগোকুল বিড়াল জাতীয় নিশাচর প্রাণী। গন্ধগোকুলের সিভেট-গ্রন্থি থেকে পোলাওয়ের মত এক ধরনের তীব্র গন্ধ নিঃসৃত হয় যা এদের বিচরণক্ষেত্র নির্দিষ্টকরণ, প্রজনন, আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। গন্ধগোকুল সাধারণত বিশাল কোনো অরণ্যে থাকার চেয়ে ঝোপঝাড়, বনবাদাড়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে ইঁদুর, পাখির বাচ্চা ও ডিম্, কাঁকড়া, ফলমূল ইত্যাদি।

দিনের আলোতে নিশাচর গন্ধগোকুল

অরক্ষিত ও বিরল হয়ে পড়া এই সুন্দর প্রাণীটি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বিক্ষিপ্ত অবস্থায় টিকে আছে। অনেক সময় এ প্রাণীটি লোকালয়ে প্রবেশ করলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। 

প্রাণীগুলো খাদ্য সংকটে ভুগে, বাসস্থান হারিয়ে যখন এরা বাধ্য হয়ে লোকালয়ে এসে মানুষের হাঁস-মুরগি, কবুতর দুয়েকটা ধরে খায় অথবা ক্ষুধার তাড়নায় ক্ষেতের সবজি, ফলমূল খেয়ে ফেলে তখন লোকে জোটবদ্ধ হয়ে এদের দেখামাত্র মেরে ফেলে। অথচ তারা খেয়াল রাখে না এরাই সেই গন্ধগোকুল যারা ইঁদুর ও ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের ফসল রক্ষা করে ।

গন্ধগোকুলের কী মায়াবী কাজলটানা চোখ, কী সুন্দর লোমশ গাট্টাগোট্টা শরীর, তাতে বিচিত্র ডোরা আর ছোপ ছোপ দাগ, সুন্দর একটি লম্বা লেজ। দুটো খাবারেরই আশায় রাত বিরাতে প্রাণীটি ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ায়। দুটো হাঁস-মুরগি খেয়ে ফেলার কারণে মানুষ কীভাবে একে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে, ভাবতে কষ্ট হয়। বাংলাদেশে প্রায় তিন প্রজাতির গন্ধগোকুল সচরাচর দেখা যায়। স্থানীয়ভাবে গন্ধগোকুল খাটাশ, গাছ খাটাশ, নোঙর, সাইরেল, তাড়ি-বিড়াল, ভোন্দর প্রভৃতি নামেও পরিচিত। 

ভোঁদড়

অরক্ষিত প্রাণীটি জলমার্জার, জলনকুল নামেও পরিচিত। ভোঁদড় উভয়চর লিপ্তপদী প্রাণী যাদের পায়ের পাতা অনেকটা হাঁসের পায়ের পাতার মত। এরা ছোট সাপ, মাছ, ব্যাঙ ও অন্যান্য ছোট জলজ প্রাণী খেয়ে জীবন ধারণ করে। এদেশে এক সময় সাগর-নদীতে তো বটেই, খালে-বিলে, হ্রদে, হাওরে এই দক্ষ মাছ শিকারি প্রাণীটির দেখা হরহামেশাই মিলত। এখনো অনেক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি রয়েছেন যাঁদের মুখে শোনা যায় এই ভোঁদড়কে তাঁরা এমনকি বড়সড় পুকুরেও প্রায়ই দেখতে পেতেন।

সুন্দরবনে বিপদ সংকেত পাওয়া একদল ভোঁদড়

প্রাকৃতিক জলাশয় ভরাট, প্রাকৃতিক উৎস থেকে নির্বিচারে মাছ শিকার, নদী দূষণের মত কারণে ভোঁদড় আজ সংকটাপন্ন। হয়ত আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম ভোঁদড়কে কেবল ছবিতে আর জাদুঘরেই দেখতে পারবে, বাস্তবে দেখার সৌভাগ্য তাদের হবে না হয়ত। 

দক্ষ শিকারি হওয়ায় কৈবর্ত ও মালো সম্প্রদায়ের জেলেরা ভোঁদড়কে প্রশিক্ষিত করে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত করে। ভোঁদড় অঞ্চল বিশেষে ধেড়ে, ধাউরা, উদবিড়াল নামেও পরিচিত। সুন্দরবনসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে ভোঁদড় এখনও বুনো পরিবেশে বেঁচেবর্তে আছে কিছু। প্রতিবেশি ভারত যেমন ভোঁদড়ের বিলুপ্তি রোধে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, বাংলাদেশও যদি তেমন ভোঁদড় সংরক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ করে তবে হয়ত আমরা এ প্রাণীটিকে হারাব না।

বনরুই

প্রতিবছর বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অরণ্য থেকে হাজার হাজার বনরুই বিশ্বের নানা প্রান্তে পাচার হয়।

কাঁটা গাছে নিরীহ সুন্দর বনরুই

সিলেট, চট্টগ্রামের পার্বত্যাঞ্চলসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন বনে-জঙ্গলে বনরুইয়ের প্রায়ই দেখা মিলত। এখন চিরুনি অভিযান চালিয়েও এর সন্ধান পাওয়া কঠিন আছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে বর্তমানে এই সুন্দর ও নিরীহ প্রাণীটির অস্তিত্ব সংকটাপন্ন।

বনছাগল

বনছাগলের আদি নিবাস বাংলাদেশ, ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে। বাংলাদেশে তো বটেই, এরা ভারত ও মিয়ানমারেও ভীষণ সংকটাপন্ন বন্যপ্রাণী। ইংরেজিতে রেড সেরো (Red Serow) নামে পরিচিত এই বনছাগল বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সংরক্ষিত বনাঞ্চলে অল্প সংখ্যক রয়েছে।


গভীর বনে রেড সেরো বনছাগল

এই বনছাগল নিশাচর প্রাণী। শেষ বিকেল থেকে খুব ভোর পর্যন্ত বন-পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে ঘাস, লতাপাতা ও শেকড়বাকড় খেয়ে জীবন ধারণ করে। লালচে বাদামি রঙের বনছাগল দিনের বেলা পাহাড়ি গুহা কিংবা ঘন ঝোপালো জায়গায় লুকিয়ে থাকে বলে এদের দেখা মেলা ভার। বাংলাদেশে হঠাৎ কখনো বনছাগল উদ্ধার হওয়ার খবর পাওয়া যায়। যেমন ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বান্দরবানের কুরুকপাতা ইউনিয়নের মুরং পাড়া থেকে একটি বনছাগল লামা বন বিভাগের কর্মীরা উদ্ধার করেন।

অন্যান্য দেশের বনচারী আদিবাসীরা প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় যতটা আন্তরিক, বাংলাদেশের আদিবাসীরা ততটা আন্তরিক নয়। তারা সুযোগ পেলে বনছাগলের মত মহাবিপন্ন প্রাণীকেও শিকার করে খায়। প্রাপ্তবয়স্ক বনছাগল বেশ বড় আকারের হয়, ওজন হয় ১১-১৬ কেজি। 

বান্দরবানের কুরুকপাতা ইউনিয়নের মুরং পাড়া থেকে উদ্ধারকৃত বনছাগল

বনছাগলের জীবনকাল ১০ থেকে ২০ বছর। বনরক্ষীদের কঠোর অবস্থান এবং বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্রে বনছাগলের কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে এদের বংশবৃদ্ধি সম্ভব। পাশাপাশি এদের প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস রোধ করা গেলে বনছাগলের বিলুপ্তি ঠেকানো যেতে পারে। এ প্রক্রিয়ায় মায়া হরিণেরও সংখ্যাবৃদ্ধি সম্ভব।

উপরের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীগুলো ছাড়াও বন্য হাতি, লজ্জাবতী বানর, উল্লুক, ঘড়িয়াল, মেছোবাঘ, বনবিড়াল প্রভৃতি বন্যপ্রাণী বাংলাদেশে বিরল হয়ে পড়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ভাল্লুক, বনগরু (গৌর বা গয়াল নামেও পরিচিত), নীলগাই ও চিতাবাঘ বাংলাদেশ থেকে ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই ৪টি প্রাণীকে মাঝে মাঝে বাংলাদেশের বনাঞ্চলে দেখার খবর পাওয়া গেলেও এরা এখানকার স্থায়ী নয়। পার্শ্ববর্তী ভারতীয় বনাঞ্চল থেকে সময়ে সময়ে এদেশে ঢুকে পড়ে।