অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

বাঘ বাঁচাবে সুন্দরবন

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১১:৪১ এএম, ৩০ জুলাই ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ১১:৪৬ এএম, ৩০ জুলাই ২০২১ শুক্রবার

সুন্দরবনের অতন্দ্র প্রহরী বাঘ। বাঘ সুন্দরবনের শোভা। বাংলাদেশের মানুষের বাঘমামা’র সঙ্গে পরিচয় হয় শিশুকালে ছড়া-গল্পে। বাংলাদেশ নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জাতীয় পশু বাঘ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সিতে, সার্ক গেমসের মাস্কট অদম্যে, চারুকলার পয়লা বৈশাখের শোভাযাত্রার বাঘের মুখোশ বাঙালিকে গর্বিত করে। এশিয়ার বিখ্যাত প্রাণী বাঘ। শক্তি, সাহস, ক্ষিপ্রতা, হিংস্রতা এবং দ্রুততার জন্য এ প্রাণীটি বিখ্যাত। সিংহ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণীর সঙ্গে বাঘের তুলনা হয়না। 

নাম তার রয়েল বেঙ্গল টাইগার
বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘকে বলা হয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রাজকীয় নামটা দিয়েছে বৃটিশরা। এ বাঘের রাজকীয় স্বভাব এবং ভয়ংকর সৌন্দর্যের জন্য ‘দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ নামকরণ করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক নাম- প্যানথারা টাইগ্রিস। প্রাণী বিজ্ঞানীরা বলেন, মধ্য এশিয়ার সাইবেরিয়া অঞ্চল বাঘদের আদি নিবাস। এ অঞ্চল থেকেই পৃথিবীর নানান এলাকায় বাঘ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে পৃথিবীতে আটটি উপপ্রজাতির বাঘ দেখা যায়। এসবই বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, ইরান, চীন, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং কোরিয়ায় বাস করে। এ আট প্রজাতির বাঘের মধ্যে আমাদের বাংলাদেশের বাঘই সবচেয়ে সুন্দর এবং বিখ্যাত। 

গায়ে তার কালো ডোরা দাগ
বাংলাদেশের বাঘের গায়ের রং উজ্জ্বল বাদামি হলুদ বর্ণের। তার উপর কালো ডোরা কাটা দাগের সমন্বয় রয়েছে। ডোরা দাগগুলো দেহের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে সাজানো। শরীরের নিচের অর্থাৎ বুকের অংশের এবং পায়ের ভিতরের চামড়ার বর্ণ সাদা। বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, বাংলাদেশের প্রতিটি বাঘের গায়ের ডোরার নকশা একেবারেই আলাদা। একজনের সঙ্গে অন্যজনের মেলে না। পৃথিবীর অন্য বাঘ থেকে এদের বৈশিষ্ট্যও ভিন্নরকম। একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ওজন সাধারণত দেড়’শ থেকে সাড়ে তিন’শ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। বাঘ ঘন দুর্ভেদ্য বনাঞ্চল পছন্দ করে। এরা খাবারের প্রয়োজন না হলে খোলা জায়গায় খুব একটা আসে না। বাঘ চমৎকার সাঁতার কাটতে জানে। সুন্দরবনের বড় বড় নদী এরা সহজেই সাঁতার কেটে পার হয়। বাঘ সাধারণত একা থাকতে পছন্দ করে। বাঘিনীও বাচ্চা না থাকলে একা ঘুরে বেড়ায়। বাঘিনীর গর্ভধারণের সময় সাধারণত ১৫/১৬ সপ্তাহ হয়ে থাকে। বাঘিনী সাধারণত দু’ থেকে ছ’টি বাচ্চা একত্রে প্রসব করে। বাচ্চারা প্রায় দু’ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে থাকে। এ সময় মায়ের কাছ থেকে শিকার করার কৌশল শিখে নেয়। 

বাঘের লালায় ঘা হয় কেন?
আত্মরক্ষা ও শিকার ধরার জন্য বাঘ নিজেকে সুচতুরভাবে লুকিয়ে রাখতে জানে। এরা সিংহের মতো শিকারের সময় অযথা তর্জন-গর্জন করে না। বাঘ নিরবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিকারকে অনুসরণ করে। রাতের বেলা শিকার করতেই বেশি পছন্দ করে বাঘ। অন্ধকারে এরা বিড়ালের মতোই দেখতে পায়। বাঘের চোয়ালে মোট ২৭টি দাঁত থাকে। সামনের চারটি দাঁত আকারে বেশ বড় ও সুতীক্ষ্ম। এরা যখন প্রচন্ড হুংকার দেয় তখন সামনের এই বড় দাঁতগুলোর জন্য এদের ভয়ংকর দেখায়। এসময় এদের মুখ থেকে প্রচুর লালা নির্গত হয়। এই লালা খুবই বিষাক্ত। মানুষের দেহে লাগলে ঘা হয়ে যেতে পারে। নিজের ওজনের দুইগুণেরও বেশি ভারী বোঝা বাঘ সহজে টানতে পারে। বড় বড় গরু, মহিষ মেরে বহুদূরে টেনে নিয়ে মহানন্দে ভোজন করে। বাঘের স্বাভাবিক খাদ্য হরিণ, বুনো শূকর, মহিষ, গরু ইত্যাদি। তবে এসব খাদ্য জোটাতে না পারলে মাছ, বনমোরগ, বানর, গুঁইসাপ, কাছিম, কাকড়া, ব্যাঙ ইত্যাদির মাংস খায়। 

বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে
এই করোনা মহামারির সময়ে প্রকৃতি প্রেমীদের জন্য একটি ভালো খবর হলো, বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাড়ছে বাঘের সংখ্যা। জানা যায়, ২০১৫ সালের ক্যামেরা ট্রাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘশুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০৬। ২০১৮ সালের শুমারিতে এই সংখ্যা ১১৪। আগের চেয়ে বেড়েছে ৮টি বাঘ। একক বনগুলোর মধ্যে সুন্দরবনেই বাঘের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি! বর্তমানে সুন্দরবনের মিষ্টি পানির পুকুরগুলোতে বাঘকে পানি খেতে আনাগোনা করতে দেখা যায়।

বাঘ বাঁচাবে সুন্দরবন
২৯ জুলাই ছিল বিশ্ব বাঘ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘বাঘ বাঁচাবে সুন্দরবন, সুন্দরবন বাঁচাবে লক্ষ প্রাণ’। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাঘ রক্ষা করতে শেখ হাসিনা সরকার বাঘ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের গাছপালা ও বন্যপ্রাণী রক্ষার জন্য স্মার্ট পেট্রোলিং টিম তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সুন্দরবনের আয়তন বাড়ানোর জন্য এবারই প্রথম কৃত্রিম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এর বিস্তৃতি ঘটানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা আরও বাড়াতে হলে, বাঘ যেসব প্রাণী শিকার করে বেঁচে থাকে, সুন্দরবনে সেসব প্রাণীর সংখ্যা বাড়াতে হবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাঘের সংখ্যা আশানুরূপভাবে আরও বেড়ে যাবে বলে গবেষকরা মনে করেন।  

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।