অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন, [পর্ব-২]

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ১১:৫৩ পিএম, ১৪ অক্টোবর ২০২০ বুধবার   আপডেট: ০৭:২৭ এএম, ২৫ অক্টোবর ২০২০ রোববার

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

প্রথম খণ্ড, প্রথম অধ্যায়
[পর্ব-১]

পর্ব-২

তবে কৌতুক আর কৌতুহলের বিষয় হলো- সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন স্মৃতি তার মনের কোণে স্পষ্ট হয়ে ওঠার কারণেই কাজটিতে সে হাত দিয়েছে। ভাবনাটি তার মনকে ঠেলে ঠেলে এমন একটি স্থানে নিয়ে ঠেকিয়েছে যে সে মনে করছে এগুলো লিখে ফেলা জরুরি। কিন্তু একথা ভাবতে ভাবতেই তার মস্তিষ্ক বলতে লাগলো অন্য কথা। মস্তিষ্ক এখন বলছে- সেই স্মৃতি নয়, বস্তুত অপর একটি ঘটনা এই লিখতে বসার কারণ। যে ঘটনাটি তাকে এই ভর দুপুরে ঘরে ঠেলে পাঠিয়েছে; আর আজই ডায়রি লেখা শুরু করতেও বাধ্য করেছে। 

এমন একটি অতি অস্পষ্ট বিষয়কে যদি আদৌ কোনো ঘটনা কিংবা বিষয় বলা চলে তাহলে তা ঘটেছে ওইদিন সকালেই, মন্ত্রণালয়ে।

তখন বেলা এগারোটার কাছাকাছি। সবাই বেশ ব্যস্ত। উইনস্টন যেখানটায় কাজ করে সেই রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে সবাই মিলে বিভিন্ন কক্ষ থেকে চেয়ারগুলো টেনে টেনে হলরুমে বড় টেলিস্ক্রিনের সামনে সারি বেঁধে বসাচ্ছিলো। ‘দুই মিনিটের ঘৃণা’ কর্মসূচির প্রস্তুতি চলছিলো। উইনস্টন মাঝের সারিতে একটি চেয়ারে কেবল বসবে- ঠিক এমনই সময়ে সে কক্ষে দুই জন মানুষের অপ্রত্যাশিত আগমন। এদের উইনস্টন চেনে, আগে দেখেছে, কিন্তু কখনও কথা হয়নি। দুই জনের মধ্যে একজন একটি মেয়ে, যাকে বারান্দায় বিভিন্ন সময় দেখেছে। সে মেয়েটির নাম জানতো না। তবে এটা জানতো, ফিকশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মাঝে মধ্যে তার তেলমাখা হাতে নাট-বল্টু লাগানোর যন্ত্র দেখে ধারণা করেছে মেয়েটি কোনো একটি উপন্যাস লেখার মেশিনের কারিগর হতে পারে। মেয়েটির চেহারায় কাঠিন্য স্পষ্ট, বয়স সাতাশ হবে, মোটা ঘন চুল, মেচতা পড়া গাল আর চালচলনে খেলোয়াড়সুলভ ভঙ্গি। ওভারঅলের উপর দিয়ে কোমড়ের কাছে জুনিয়র অ্যান্টি-সেক্স লিগের প্রতীক চিকন লাল পরিকর বারকয়েক পেঁচিয়ে বাধা। একটু শক্ত করেই বেঁধে নেওয়া ফলে ওভারঅলের উপর দিয়েও নিতম্বদেশ বেশ সুডৌল হয়ে ফুটে উঠেছে। ঠিক যে মূহূর্তে উইনস্টন মেয়েটিকে দেখলো তখন থেকেই সে তাকে ঠিক নিতে পারছিলো না। কারণটা অজানা নয়। মেয়েটির আগমনের ভঙ্গিমাটি এমন যেনো এটি কোনো হকি খেলার মাঠ, নয়তো ঠাণ্ডা স্নান ঘর, নয়তো কমিউনিটিকে চাঙ্গা করে তোলার কোনো কর্মসূচি, আর সে যেনো এক সুন্দর মননশীলতার ধ্বজাধারী। বস্তুত প্রায় সকল নারীকেই অপছন্দ উইনস্টনের। বিশেষ করে যারা একটু সুন্দরী তাদেরতো বটেই। তার মতে, সবসময়ই নারীরা, বিশেষ করে যুবতীরা পার্টির সবচেয়ে সংকীর্ণমনা সমর্থক, এরা স্লোগান সর্বস্ব, সুখের মাছি আর অকারণে অযাচিতভাবে যে কোনো ইস্যুতে নাক গলায়। আর এই মেয়েটিকে তার কাছে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে হয়। করিডোরে যেদিন প্রথম অতিক্রমণ ঘটে একে অপরের, সেদিন মেয়েটি তার দিকে আড়চোখে তীব্র দৃষ্টি হানে। উইনস্টনের মনে হয়, চাহুনি দিয়েই মেয়েটি তার ভেতরটা দেখে নিয়েছে, আর এতে অন্তর্গত একটা কালো আতঙ্ক বয়ে যায় তার শরীরময়। ভাবনায় এও এলো যে, মেয়েটি ‘থট পুলিশের’ কারিন্দা হতে পারে। এমনটা সত্য হওয়া খুব অসম্ভব। তারপরেও তার ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। আতঙ্কের সাথে এক ধরনের শত্রুতার মনোভাব মিশ্রিত হয়। এরপর থেকে যখনই মেয়েটি তার কাছাকাছি আসে তখনই তার ভেতরে একই মনোভাব কাজ করতে থাকে।

অন্য লোকটির নাম ও’ব্রায়েন। ইনার পার্টির একজন সদস্য এবং কিছু পদেও আছেন। তবে সেসব পদের গুরুত্ব এমনই যে উইনস্টন সে সম্পর্কে সামান্যই ধারণা রাখে। পার্টির একজন সদস্য কালো ওভারঅল পরে এসেছে এমন দৃশ্যে মূহূর্তেই চারিদিকে একটা ফিসফিসানির শব্দ বয়ে যায়। ও’ব্রায়েনের দশাসই পেটানো শরীর, মোটা গর্দান, কর্কশ, কৌতুকতা আর বর্বরতার মিশেল চাহুনি। ভয়ঙ্কর দেখতে হলেও তার আচরণে এক ধরনের খুশির ভাব লেপ্টে থাকে। নাকের ওপর চশমাটি ঠিক করার সময় সে এমন একটা কিছু করে যা কৌতুহল সৃষ্টি করে, মজাও দেয়। এর কোনো সংজ্ঞা নেই বটে, তবে তারপরেও কিছুটা সভ্য বলেই তাকে মনে হয়। ভাবভঙ্গিমায়, কেউ তাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর আদর্শবানব্যক্তিদের কারো সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেও, দেখতে পারে।  

অনেক বছর ধরে অন্তত ডজন খানেকবার ও’ব্রায়েনকে দেখেছে উইনস্টন। লোকটি তার ভাবনায় ভালো করেই স্থান করে নিতো। তার বিশালাকায় লড়াকু বপু আর ভদ্রোচিত আচরণের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য তাতে তাকে নিয়ে এক ধরণের সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করে উইনস্টনের মনে। তবে সেটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়। তার চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে- তার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস- অথবা সম্ভবত বিশ্বাস নয় এক ধরনের ভাবনা কাজ কাজ করে যে ও’ব্রায়েন যে রাজনৈতিক মতাদর্শে রয়েছেন তা সঠিক নয়। ওর চেহারায় কিছু একটা আকর্ষণ আছে। এও হতে পারে তার চেহারায় যে ভদ্রোচিত ভাবটি লেখা আছে তার জন্য নয়, ওই আকর্ষণ স্রেফ তার বুদ্ধিমত্তার জন্যই। তবে যাই হোক না কেনো সে এমন একটা লোক যাকে একা পাওয়া গেলে এবং টেলিস্ক্রিনকে ফাঁকি দেওয়া গেলে তার সঙ্গে কিছু বাতচিৎ হতেই পারে। উইনস্টন অবশ্য এই অনুমানকে যাচাই করে দেখার সামান্য চেষ্টাও করেনি। যদিও সে চেষ্টা করার সুযোগও খুব ছিলো তা নয়। ঠিক এই মূহূর্তে ও’ব্রায়েন তার হাতঘড়িটির দিকে তাকিয়ে। দেখে নিলেন তখন প্রায় এগারোটা বাজে। হাবভাবে বোঝা গেলো দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টেই থাকছেন।

উইনস্টন যে সারিতে বসে ঠিক সেই সারিতেই কয়েকটি চেয়ার দূরে বসলেন ও’ব্রায়েন। ধূসরকেশী যে মেয়েটি উইনস্টনের পাশের কক্ষ থেকে চেয়ার টেনে সাজাচ্ছিলো সে বসেছে তাদের দু’জনের মাঝখানের একটি চেয়ায়ে আর আর সেই কালোকেশী বসেছে ঠিক তার পেছনে। পরক্ষণেই দৈত্যাকায় মেশিন থেকে হলের শেষ মাথায় বসানো বিশাল টেলিস্ক্রিনের মধ্য দিয়ে একটি কর্কশ ভাঙা কণ্ঠ বাজতে শুরু করলো। একে স্রেফ চ্যাঁচামেচি ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। এতে মেজাজ খিঁচড়ে আপনার দাঁতকপাটি লেগে যাবে আর তা ঘাড়ের কাছের চুলগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠবে। তবে ঘৃণা কর্মসূচির  শুরুটা এরকমই হলো।

অবধারিতভাবেই জনগণের শত্রু ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইনের মুখ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। দর্শকদের মধ্যে এখানে সেখানে তখন কেবলই কানাঘুষার শব্দ। ধূসর চুলের মেয়েটি ভয় আর বিরক্তি মিশ্রণে একটি অদ্ভুত অভিব্যক্তি দিলো। পার্টির বিদ্রোহী আর পশ্চাদপসরণকারী হিসেবে পরিচিত এই গোল্ডস্টেইন। আগে দলের প্রধানসারির নেতাই তিনি ছিলেন, অনেকটা বিগ ব্রাদারের সমমাপের, সম পর্যায়ের। পরে প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানাও জারি হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কিভাবেই যেনো বেঁচে যান, আর নিরুদ্দেশ হয়ে যান। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি একেক দিন একেকরকম। কিন্তু এমন একটিদিনও পাওয়া যাবে না যেদিন এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু গোল্ডস্টেইন নন। তিনি ছিলেন প্রথম ও প্রধান বিদ্রোহী। দলের পবিত্রতার প্রথম বিনষ্টকারী। ধরে নেওয়া হয়, পরবর্তীতে পার্টিতে যত অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, নাশকতা, বিচ্যুতি যা কিছুই হয়েছে তার সবকিছুই এই গোল্ডস্টেইনের শিক্ষাপ্রসূত। কোথাও কোন অজ্ঞাতস্থানে বসে এখনো তিনি তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। হতে পারে সমুদ্রের ওপার থেকে, নয়তো বিদেশি কোনও চক্রের ছত্রছায়ায়, এমনকি হতে পারে, ঠিক যে গুজব প্রায়শঃই কানে আসে, এই ওসেনিয়ার ভেতরেই কোনো একটি গুপ্ত আস্তানা থেকে। উইনস্টনের মধ্যচ্ছদা শুকিয়ে আসছিলো। গোল্ডস্টেইনের চেহারাটা যখনই সে দেখে একটা ব্যাথাভরা অনুভূতি বয়ে যায়। কৃশকায় ইহুদি মুখ, মাথায় ঘন সাদা চুল, ছোট ছাগলা দাড়িতে চতুর চেহারা, একটা সহজাত অবজ্ঞার ভাব মুখে মাখা, লম্বা পাতলা নাকের ডগায় বসানো চশমা জোড়ায় এক ধরনের জরাগ্রস্ত বোকাটে ভাবের প্রকাশ। সব মিলিয়ে ভেড়ার মতো দেখতে আর কণ্ঠস্বরও সেই ভেড়ারই মতোন। দলের নীতির বিরুদ্ধে গোল্ডস্টেইন আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে সমানে বিষোদগার করে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বাক্যে এমন অত্যুক্তি ও ন্যয়ভ্রষ্টতা ছিলো যে, ছোট্ট শিশুটি পর্যন্ত তা পরিষ্কার বুঝতে পারে। আর এমন একটা বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন যে অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিসম্পন্নরা সহজেই তার কথাগুলো মেনেও নিতে পারে। বাক্যবাণে বিগ ব্রাদারকে নাজেহাল করে যাচ্ছিলেন গোল্ডস্টেইন। দলের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় তুললেন আর দাবি তুললেন, ইউরেশিয়ার সঙ্গে যেনো এখনই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা হয়। তিনি বাক-স্বাধীনতার কথা বললেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বললেন, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বললেন। হিংস্রভাবে চিৎকার করতে করতে তিনি বললেন, বিপ্লব প্রতারিত হয়েছে- কণ্ঠস্বরের দ্রুত ওঠানামার মধ্য দিয়ে বলে চলা এই কথাগুলো দলের বাগ্মিদের বক্তব্যের স্বভাবজাত ধরণটিরই অনুকরণ। যাতে ছিলো নিউস্পিকের শব্দের ব্যবহার। দলের সদস্যরা বাস্তব জীবনে যতটা নিউস্পিকের শব্দ ব্যবহার করেন তার চেয়েও বেশি।

গোল্ডস্টেইনের এই মিথ্যা ফালতু বয়ানের বাস্তবতা নিয়ে কেউ সন্দেহ করতে পারে এই ভাবনা থেকেই পুরো বক্তৃতার সময়জুড়ে টেলিস্ক্রিনে তার পেছনে দেখানো হচ্ছিলো ইউরেশীয় সেনাদের কুচকাওয়াজ। ভাবলেশহীন কঠিন মুখোভঙ্গির এশীয় চেহারার ওই সেনাদের সারি যেনো শেষ হচ্ছিলো না।  একেকটি সারি একেরবার টেলিস্ক্রিনের সামনে চলে এসে আবার দ্রুত সরে যায়, সেখানে এসে হাজির হয় একই রকম দেখতে আরেকটি সারি, সেটিও সরে যায়, আরেকটি আসে। গোল্ডস্টেইনের ভ্যা ভ্যা চিৎকারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসছিলো সৈনিকদের বুটের ভারি শব্দ।
 
ঘৃণার তখন ত্রিশ সেকেন্ডও পার হয়নি। এরই মধ্যে কক্ষের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবিরাম তাদের ক্রোধের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। একটি আত্মতৃপ্ত ভেড়ামুখো চেহারা টেলিস্ক্রিনে, তার পেছনে ইউরেশীয় সেনাদের ভীতিকর শক্তির প্রদর্শন, আসলেই এক অসহনীয় দৃশ্য। এর পাশাপাশি গোল্ডস্টেইনের দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তা আরও ভয় ও ক্রোধ ধরিয়ে দেয়। ইদানিং ইউরেশিয়া কিংবা ইস্ট এশিয়ার চেয়েও বড় ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছেন এই গোল্ডস্টেইন। সাধারণত এই দুটি শক্তির কোনো একটির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে অপরটির সঙ্গে শান্তির সম্পর্কই বজায় রাখে ওসেনিয়া। কিন্তু অদ্ভুত দিকটি হচ্ছে, যদিও গোল্ডস্টেইন সর্বত্র-সকলের কাছেই ঘৃণিত-অপমানিত, যদিও প্রতিদিন এবং দিনে সহস্রবার, মঞ্চে, টেলিস্ক্রিনে, সংবাদপত্রে, বইয়ে তার তত্ত্বের বিরোধীতা হয়, গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দেওয়া হয়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়, নোংরা-ফালতু বলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়- তা সত্ত্বেও তার প্রভাব কখনো কমতে দেখা যায়নি। তার হাতে অপদস্থ হওয়ার জন্য সবসময়ই নতুন বোকামি থেকেই যায়। এমন একটি দিনও পাওয়া যায়নি যেদিন থট পুলিশের হাতে গোল্ডস্টেইনের জন্য কাজ করছে এমন চর কিংবা অন্তর্ঘাতক ধরা পড়েনি। একটি বিশাল ছায়া সেনাদলের অধিনায়ক সে। একটি গোপন ষড়যন্ত্রকারী নেটওয়ার্কের প্রধান, যারা রাষ্ট্রকে বানচাল করে দিতে চায়। 

নেটওয়ার্কের একটি নামও রয়েছে- ‘দ্য ব্রাদারহুড’। একটি ভয়ংকর বইয়ের কথাও শোনা যায়, যেটি আসলে উৎপথগামিতার এক সংক্ষিপ্ত সোপান। গোল্ডস্টেইনই এর রচয়িতা। আর অত্যন্ত গোপনীয়তায় সে বই সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ের কোনো নাম নেই। কেউ বইটির কথা বলতে গেলে, বা আদৌ যদি বলে, তাহলে স্রেফ ‘দ্য বুক’ কথাটিই ব্যবহার করে। কিন্তু এগুলো কেবল গুজব থেকেই জানা। দলের সাধারণ কোনো সদস্যও বাধ্য না হলে এই ‘ব্রাদারহুড’ কিংবা ‘দ্য বুক’ শব্দের ব্যবহার করবে না।

ঘৃণার দ্বিতীয় মিনিটে গোটা হলেই ক্রোধ ছড়িয়ে পড়লো। মানুষগুলো তাদের নিজ নিজ আসন থেকে লাফিয়ে উঠছিলো আর যতজোড়ে সম্ভব চিৎকার করে যাচ্ছিলো, যেনো তারা স্ক্রিনের ভ্যা ভ্যা শব্দ ছাপিয়ে নিজেদের শব্দ উচ্চারণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ছোট ধূসর চুলের মেয়েটি ততক্ষণে গোলাপী রং ধরেছে, দেখা গেলো তার মুখ ঠিক ডাঙায় তোলা মাছের মতো একবার খুলছে একবার বন্ধ হচ্ছে। ও’ব্রায়েনের ভারী মুখও তখন জ্বলে উঠেছে। তিনি চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছিলেন। উঁচু বুকের ছাতি কেঁপে কেঁপে স্ফীত হয়ে উঠছিলো, যেনো তিনি সজোরে আসা ঢেউয়ের আঘাত সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন। উইনস্টনের পেছনের কালোকেশী মেয়েটি ততক্ষণে ‘জঘণ্য! শুয়োর!’ গলা ফাটিয়ে এসব বলে চলেছে। আচমকা একটি ভারি নিউস্পিক অভিধান তুলে নিয়ে সেটি স্ক্রিনের দিকে ছুড়ে মারলো সে। সরাসরি ওটি গিয়ে পড়লো গোল্ডস্টেইনের নাক বরাবর। এবং পড়েই ছিটকে এলো। কিন্তু তাতে বক্তব্যে বাধা পড়লো না। এমন একটা মূহূর্তে উইনস্টন নিজেকেও আবিষ্কার করলো যে সেও অন্যদের সঙ্গে সমানতালে চিৎকার করছে আর পায়ের গোড়ালি দিয়ে নিজের চেয়ারের পাদানিতে সজোরে লাথি মারছে।

দুই মিনিটের এই ঘৃণা কর্মসূচির একটা অদ্ভুত দিক হচ্ছে- কেউ এতে উপস্থিত থাকলেও ঘৃণা ছড়াতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ কাজটি না করে পারে না। ভয় আর প্রতিহিংসার উদ্যাম উল্লাস, মেরে ফেলার কিংবা নির্যাতনের প্রগাঢ় ইচ্ছা, হাতুড়ি দিয়ে মুখমণ্ডল থেঁতলে দেওয়ার তীব্র বাসনা সবগুলো মানুষের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো বইতে থাকে। তখন তারা এমনকি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভয়ঙ্কর চিৎকার জুড়ে দেয়। আর প্রত্যেকেই এমন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে যে তাতে নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই আচরণ একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মাঝে আগুনের হলকার মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

কথা এই যে, উইনস্টনের যে ঘৃনার প্রকাশ দেখা গেলো তা কিন্তু আদৌ গোল্ডস্টেইনের বিরুদ্ধে ছিলো না। বরং সে ঘৃণা ছিলো বিগ ব্রাদারের বিরুদ্ধে, দলের বিরুদ্ধে এবং থট পুলিশের বিরুদ্ধে। আর ঠিক এই মূহূর্তে তার হৃদয় একাকীত্বে ভরে গেলো, উদাসভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকালো, আর গোল্ডস্টেইনকে মনে হলো মিথ্যার দুনিয়ায় সত্য আর  বিচারবুদ্ধির একক অভিভাবক। আর চারিদিকে এত মানুষের মধ্যে সে নিজেই হচ্ছে এর দ্বিতীয় উদাহরণ। গোল্ডস্টেইন যা কিছু বলছেন তার সবটাই যেনো তার কাছে সত্যি মনে হতে লাগলো। তবে পর মূহূর্তেই আবার বিগ ব্রাদারের প্রতি তার গোপন ঘৃনা রূপ নিলো ভালোবাসায়। বিগ ব্রাদারকে তার অকুতোভয় রক্ষক, এশীয়দের বিরুদ্ধে পাথরকঠিন দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন অভিভাবক মনে হচ্ছিলো। পক্ষান্তরে গোল্ডস্টেইনকে, তার নির্বাসন, অসহায়ত্ব এবং এমনকি তার সংশয়পূর্ণ অস্তিত্বের পরেও অশুভ জাদুকর বলেই মনে ঠেকলো। মনে হলো- সে যেনো তার কণ্ঠের শক্তি দিয়েই এই সভ্যতার কাঠামোকে ভেঙ্গে দিতে চায়। 

এটাও সম্ভব, মূহূর্তের মধ্যেই একজনের ওপর যে ঘৃনা; তা অন্য জনের ওপর চেপে বসে। হঠাৎ, যেভাবে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মাঝেও কেউ তার প্রচণ্ড চেষ্টায় মাথাটিকে বালিশ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে, ঠিক সেভাবেই উইনস্টন তার মনের সব ঘৃনা স্ক্রিনের মুখটি থেকে তার পেছনের কালোকেশী মেয়েটির ওপর ফেলতে সক্ষম হলো। একটি অদ্ভুত ভাবনা তার মনের ভেতর খেলে গেলো। তার মনে হলে একটি রাবারের মোটা লাঠি দিয়ে মেয়েটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে যদি পারে; তাকে উলঙ্গ করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে সাধু সেবাস্টিয়ানের মতো তীরে তীরে জর্জরিত করতে যদি পারে. কিংবা ওকে প্রথমে বিমোহিত করে পরে ঠিক চরম উত্তেজনার মূহূর্তে যদি জিভটা কেটে নিতে পারে। আর অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন উইনস্টন ভালো করেই যেনো বুঝতে পারছে ঠিক কী কারণে সে মেয়েটিকে ঘৃণা করতো। সে তাকে ঘৃণা করতো কারণ সে যুবতী, সুন্দরী আর ক্লিব, কারণ সে তাকে বিছানায় নিতে চাইতো কিন্তু কখনো পারেনি, কারণ তার মিষ্টি কোমল কটিদেশ, যা বাহুদিয়ে জড়িয়ে রাখার মতো, সেখানে শোভা পাইছে ঘৃণিত ওই লাল পরিকর, যা তার কৌমার্যের উদ্ধত ঘোষণা।

রুম জুড়ে ঘৃণা ততক্ষণে চরমে রূপ নিয়েছে। গোল্ডস্টেইনের কণ্ঠকে তখন সত্যিকারেই ভেড়ার ভ্যা ভ্যা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিলো না।... [পরের অংশ পড়ুন এখানে]