অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক সুতিহার দিঘি

আজমাল হোসেন মামুন, শিক্ষক ও সাংবাদিক

প্রকাশিত: ১০:৫৯ এএম, ২৩ জুলাই ২০২১ শুক্রবার  

'মোরা এক বৃন্তে দু'টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান,
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ' ।

জাতীয় কবির রচিত পঙ্‌ক্তির প্রতিফলন ঘটেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি গ্রামে। জেলার নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের সে গ্রামের নাম বরেন্দ্রা। যে গ্রামে প্রায় এক হাজারের বেশি মুসলিম ও প্রায় ৮ শতাধিক সনাতন ধর্মীর বসবাস । আর তাদের একসূত্রে গেঁথে রেখেছে একটি দিঘি, যার নাম সুতিহার। 

৩০ বিঘার সুতিহার দিঘিটিই এ এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেছে দীর্ঘকাল থেকে । এ দিঘির পানি প্রয়োজনে গ্রামের সবাই ব্যবহার করে । প্রতিদিন কাপড় পরিষ্কার থেকে শুরু করে গোসল, ভাত রান্না, প্রয়োজনে ফসলি জমিতে এ দিঘির স্বচ্ছ পানি ব্যবহার হয়। 

লোকমুখে শোনা যায়, ব্রিটিশ আমলে কিছু উপজাতি হিন্দু ও মুসলমান ভারতের রাঢ় এলাকা থেকে এসে এই পতিত ভূমিতে নতুনভাবে বসতি স্থাপন করেন। সেখানকার বনজঙ্গল কেটে জমিগুলোকে আবাদযোগ্য করে তুলে। গ্রামের নাম দেওয়া হয় বরেন্দা।

গ্রামে দুটি দিঘি রয়েছে। একটি সেতাহার অপরটি সুতিহার দিঘি। সেতাহার ও সুতিহার নামে সম্ভ্রান্ত পরিবারের আপন ভাই বোন ছিলেন বলে লোকমুখে প্রচলিত। এদের নামানুসারেই দিঘি দুটোর নামকরণ। সেতাহার দিঘি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলেও সুতিহার দিঘি বরেন্দা গ্রামের সকল মানুষের সম্পদ। যুগ যুগ ধরে গ্রামবাসী তাদের নিজস্ব দিঘি হিসাবে একে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করে আসছিল।

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে বরেন্দা গ্রামের ৭ বেকার যুবক 'যুব উন্নয়ন কেন্দ্র' থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে একটা যুব সমিতি গঠন করে। সমিতির নামে সুতিহার দিঘিটি জেলা প্রশাসনের কাছে লিজ নিয়ে মাছ চাষের উদ্যোগ নেয়। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। কারণ, 'মা' তুল্য এ দিঘিটি গ্রামের সবার। 

এ নিয়ে যূব সমিতি ও গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষ থেকে মামলা মোকদ্দমা পর্যন্ত গড়ায়। ২০০১ সালে দু'পক্ষের সংঘর্ষে ১ জন মানুষ প্রাণ হারায়। উভয়পক্ষ মামলা দায়ের করে। একপক্ষ হত্যা মামলা অপরপক্ষ জোরপূর্বক মাছ লুটের মামলা। প্রায় ৪ বছর ধরে মামলা মোকদ্দমা চলার পর জেলা প্রশাসন , তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মু. জিয়াউর রহমান ও তৎকালীন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল আওয়ালের উদ্যোগে মীমাংসা হয়। 

যুব সমিতিকে পুণর্গঠিত করে ৮০ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির নাম দেয়া হয় 'বরেন্দা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কমিটি'। ২০০৬ সাল পর্যন্ত দিঘিটির আয় থেকে মামলা মোকদ্দমার খরচসহ ক্ষতিপূরণ দেয় নবগঠিত কমিটি। এরপর থেকে দিঘির মালিকানা ধরা হয় গ্রামের প্রতিটি মানুষের।

জানা যায়, এই দিঘি থেকে মাছ চাষ করে প্রতিবছর আয় হয় প্রায় ১০ /১২ লাখ টাকা। সব টাকায় ব্যয় করা হয় বরেন্দা গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়নে।

মো. নুরুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক উন্নয়নকর্মী জানান, ২০০৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দিঘির আয় থেকে মুসলমানদের জন্য দিঘির পূর্ব কর্ণারে পূর্ব বরেন্দা কেন্দ্রীয় গোরস্থান এবং দক্ষিণ পাড়ায় গোরস্থান তৈর করা হয়েছে । নির্মাণ করা হয়েছে ঈদগাহের সীমানা প্রাচীর।

হিন্দুদের শ্মশানের জন্য জায়গা কিনে সীমানা প্রাচীর দেওয়া হয়েছে। তাদের উপাসনার জন্য উপজেলার মধ্যে বড় ১টি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের নাম দেওয়া হয়েছে বরেন্দা সর্বজনীন মন্দির। 

গ্রামের প্রত্যেক পরিবারের বিশুদ্ধ খাবার পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা হয়েছে। এজন্য বিল বাবদ প্রায় ৫০/৬০ হাজার টাকা ব্যয় বহন করে বরেন্দা সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন কমিটি'। দিঘির উৎপাদিত মাছ থেকে কিছু পরিমাণ মাছ প্রতি পরিবারের মধ্যে সমানে ভাগ করে দেওয়া হয়। অসহায় গরিব মানুষের মেয়ের বিয়ে, প্রবীণদের চিকিৎসায় নগদ সহায়তা দেওয়া হয় সমিতির পক্ষ থেকে।

মুদি দোকানদার মো. আব্দুল ওয়াহাব বলেন, এ সুতিহার দিঘিকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে গ্রামের সম্প্রীতির বন্ধন। ধর্মে ধর্মে নেই বিভেদ। ঈদ ও পুজোয় পরস্পর ধর্মের লোকদের সহযোগিতা ও নিমন্ত্রণ করার রেওয়াজ রয়েছে বরেন্দা গ্রামে

অলকা মাহাত্মের বাসা দিঘির আয়ে নির্মিত মন্দিরের পাশেই। তিনি বলেন, আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ মারা গেলে দূরবর্তী স্থানে সৎকার করতে হতো। এখন রয়েছে হিন্দুদের শ্মশান ঘাট। এ শ্বশানের জমি কেনা হয়েছে দিঘির আয় থেকে।

তিনি বলেন, এ গ্রামে প্রবেশ করলেই বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম তাঁর কালজয়ী গান, 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, আমরা আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' এর মাধ্যমে যে আফসোস করেছেন তা থাকবে না। এখানে সবাই নিজেদের আনন্দ ও কষ্ট ভাগাভাগি করে মিলেমিশে বসবাস করছে।