অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

সাবধান! কন্ট্যাক্ট লেন্স 

শেখ আনোয়ার

প্রকাশিত: ১১:৫৫ এএম, ১৫ জুন ২০২১ মঙ্গলবার   আপডেট: ০৬:০৭ পিএম, ১৫ জুন ২০২১ মঙ্গলবার

দেখতে যতই স্মার্ট তারুণ্যদীপ্ত হোন না কেনো। বয়স তো আর কম হয়নি। আপনার এ বয়সে চোখের দৃষ্টিশক্তি কমতেই পারে। তাই বলে চশমার ফ্রেমে সৌন্দর্যে সেকেলে শৃঙ্খল পরানো কি চলে? বেশভূষা, চলাফেরা, জীবনযাত্রা আর সব কিছুই যখন আধুনিক। তখন চোখে চশমা বড্ড বেমানান। এই চশমা সৌন্দর্যের বয়স বাড়িয়ে দেয়। সময় বদলে গেছে। করোনাকালে দেখা সাক্ষাৎ কম হলেও ডিজিটাল যুগে ভিডিও দেখা সাক্ষাতেও চোখে চশমা রাখতে হয়। এতেও সৌন্দর্যহানির কথাও ভাবা হয়। তাই চোখের সৌন্দর্য বিকাশে বিজ্ঞান নিয়ে এসেছে স্মার্ট ব্যবস্থা- চোখের কন্ট্যাক্ট লেন্স। চশমার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিচ্ছে কন্টাক্ট লেন্স। দৃষ্টি বাড়াতে, সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অনন্য। তাই ব্যবহার ও জনপ্রিয়তাও বেড়েছে অনেক গুণ। চশমার বদলে কন্ট্যাক্ট লেন্সের জয় এখন বিশ্বজুড়ে।  

কন্ট্যাক্ট লেন্স কি?
কন্ট্যাক্ট লেন্স একটি চোখের লেন্স, যা চশমার ফ্রেমে না বসিয়ে সরাসরি চোখের কর্নিয়া বা কালো পর্দার ওপর নিজে নিজেই বসানো যায়। কালো মনির সামনে লাগালেই চোখের দৃষ্টি স্বল্পতা ঠিকঠাক হয়। চোখের অনুভূতিতে এর উপস্থিতি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। লেন্সটি সরাসরি চোখের কন্টাক্টে থাকে বলে এর নাম কন্ট্যাক্ট লেন্স।

কন্ট্যাক্ট লেন্স কেন দরকার?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, দু’ চোখের পাওয়ারের তারতম্য অনেক বেশি হলে চশমা দিয়ে দু’ চোখে একসঙ্গে দেখা যায় না। সে ক্ষেত্রে কন্ট্যাক্ট লেন্স খুব ভালো। যাদের এক চোখে ছানি অপারেশন করা হয়েছে কিন্তু অন্য চোখ স্বাভাবিক, তাদের ছানি অপারেশন-পরবর্তী চশমা দিলে যেকোনো জিনিস দু’টো দেখেন। এ সমস্যা দূর করতে কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যায়। এছাড়া শিশুদের আঘাতজনিত ছানি অপারেশনের পর কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অধিক প্লাস পাওয়ার বা অধিক মাইনাস পাওয়ার থাকলে কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা ভালো। চোখের নিজস্ব কিছু অসুখে কন্ট্যাক্ট লেন্সের দরকার পরে। এক চোখ অন্ধ হলে সেটা ঢাকতেও ব্যবহার করা হয় কন্ট্যাক্ট লেন্স। পেশাগত কারণ যেমন, শোবিজ, মিডিয়া, ফ্যাশন জগতে অনেকের চশমা ব্যবহার চলে না। গাড়ি চালাতে, ভিড়ে চলাফেরা করতে, খেলাধুলায়, মাইক্রোস্কোপ, ক্যামেরা, ভিডিও নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে কন্টাক্ট লেন্স বেশ সুবিধাজনক।


 
কন্ট্যাক্ট লেন্স কোনটা কেমন?
জানা যায়- হার্ড, সেমি সফট ও সফট এবং ডিসপোজ্যাবল মোট চার ধরনের কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহৃত হয়। হার্ড লেন্স এক ধরনের স্বচ্ছ প্লাস্টিক। তবে সবচেয়ে ভালো দৃষ্টিশক্তি দিতে পারে। হার্ড লেন্সের মাপজোখ অত্যন্ত সুুক্ষ্ম হতে হয়, নতুবা সেট করা বেশ কষ্টসাধ্য। আর এই লেন্সের ভেতর দিয়ে অক্সিজেন আসতে পারে না বলে চার ঘণ্টা পরপর খুলে ধুয়ে আবার পরতে হয়। আমাদের কর্নিয়া বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে সুস্থ থাকে। হার্ড লেন্স তাতে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যদিও টেকে বেশি, দামে কম এবং অনেক পরিষ্কার। তবুও বেশি চলে সেমি সফট লেন্স বা আরজিপি লেন্স। যা অক্সিজেন পরিবহনে সক্ষম। সফট লেন্সও মূলত প্লাস্টিক জাতীয় পদার্থ। কিন্তু এর জলীয় অংশের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বেশ নরম হয়। তাই বেশ আরামদায়ক। 

কিভাবে ব্যবহার করতে হয়?
কন্ট্যাক্ট লেন্স একটা স্পর্শকাতর  মেডিকেল ডিভাইস। এজন্যে পরিধানকারীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা বাঞ্চনীয়। নতুবা ইনফেকশনের সম্ভাবনা রয়ে যায়। স্টেরিলাইজ করা ছোট্ট পাত্রে বিশেষ তরলের মধ্যে রাখা এই লেন্স মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে নিজেই দূষিত হয়ে যেতে পারে। সব সময়ই লেন্স পরা এবং খোলার আগে অবশ্যই হাত ভালো করে সাবান বা কোনো জীবাণুনাশক দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। হাত ধোয়ার পর হাত শুকিয়ে নিয়ে শুকনো হাতেই লেন্স পরতে বা খুলতে হয়। খোলার পর একটি বিশেষ পাত্রে লেন্স সলিউশনে ডুবিয়ে রাখতে হয়। সলিউশন প্রতিদিন পরিবর্তন করতে হয়। কোনোভাবেই পানি দিয়ে লেন্স ধোয়া যাবে না। একবার সর্বোচ্চ ৮-১০ ঘণ্টা লেন্স পরা যায়। লেন্স পরে ঘুমানো যাবে না। লেন্স পরা অবস্থায় চোখ রগড়ানো যাবে না।

সাবধান কন্ট্যাক্ট লেন্স!
কন্ট্যাক্ট লেন্সের উপকারিতা অনেক বেশি হলেও সম্পূর্ণ বিপদমুক্ত নয়। চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহারের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো সংক্রমণ। বিজ্ঞানীরা জানান, ‘চোখে সংক্রমণের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক হলো কেরাটিটিস। ব্যাকটেরিয়া এবং অন্যান্য জীবাণুর কারণে এই সংক্রমণ হতে পারে। কন্ট্যাক্ট লেন্স পরার ফলে চোখ যখন কোন রোগে আক্রান্ত হয় তা স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ যন্ত্রনা দেয়। ক্ষেত্রবিশেষে কেউ কেউ কন্ট্যাক্ট লেন্সের কারণে অন্ধ হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা জানান, ‘কন্ট্যাক্ট লেন্সে এক ধরনের  প্রোটোজোয়া বাসা বাঁধে। সাধারনত এরা বাসা বাঁধে বদ্ধ ডোবা আর ধূলিময় ড্রয়ারের আনাচে কানাচে। দুঃসংবাদ হচ্ছে এরা কন্ট্যাক্ট লেন্সেও বাসা বাঁধে। লেন্সে থাকাকালীন সময়ে এরা চোখের তারার ওপরের কর্নিয়ার টিস্যুগুলোতে ছড়িয়ে যায়। ফলে চোখে মারাত্মক যন্ত্রনা অনুভূত  হয়। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কখনো কখনো এজন্য রোগী অন্ধত্বের শিকার হয়।’ অ্যাকাস্থামোলাস নামক এই জীবাণু মূলত: কন্টাক্ট লেন্স ব্যাবহারকারীদের চোখ সংক্রমনের প্রধান কারন। বিজ্ঞানের পরিভাষায় অ্যাকাস্থামোলাস সৃষ্ট চোখের সমস্যাকে অ্যাকাস্থামোলাস কেরাইটিন বলা হয়। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেন, যখন কন্ট্যাক্ট লেন্সের ব্যবহার দীর্ঘক্ষণ সময় ধরে বেড়ে যায় তখন এ রোগের প্রকোপও বেড়ে যায়। এ নিয়ে গবেষনা করছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী মহেষ বান্দারা। তিনি বলেন, ‘অ্যাকাস্থামোলাস চক্ষু সংক্রমনের ব্যাকটেরিয়ার উপরিতলে এমন কিছু পরমাণু থাকে, যা ব্যাকটেরিয়াকে লেন্সের গায়ে বসে থাকতে সাহায্য করে। সংবেদনশীল এই লেন্স সহজেই ব্যাকটেরিয়ার শিকার হতে পারে। যে সমস্ত ব্যাকটেরিয়া চোখের ক্ষতি করে তাদের জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট স্থান হচ্ছে কন্ট্যাক্ট লেন্সের গায়ের মসৃণ জায়গাটি। একজন ব্যাবহারকারী যত বেশি একই কন্ট্যাক্ট লেন্স বার বার ব্যাবহার করবেন, ততোই তার জন্য চোখের রোগ অপরিহার্য্য হয়ে পড়বে।’  তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোগ সৃষ্টিকারী এই প্রোটোজোয়ার প্রতিষেধক হলো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড লেন্স সলিউশন। যখন-তখন লেন্স খুলতে হলে ঐ সলিউশন দিয়ে লেন্স পরিস্কার করে নিবেন। ব্যাস!  প্রোটোজোয়া ধ্বংস। এখন থেকে আর এ ধরনের কন্টাক্ট লেন্সে রোগীর তেমন কষ্ট পোহাতে হবে না। কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যাবহারকারীরা আবার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবেন।    

মুখের সৌন্দর্যের অনেকটাই জুড়েই থাকে একজোড়া চোখ। পুরুষের কাছে নারীর চোখ তাই কখনো সাগর, কখনো আকাশ, কখনো বর্ষার দীঘি, কখনো কাজল কালো মেঘ, কখনো পাখির নীড়। কেউ কি চায় এতো সুন্দর চোখজোড়াকে চশমার শৃঙ্খলে আড়াল করতে? জী না। আমাদের দেশে অনেকেই রয়েছেন, উপযুক্ত পরীক্ষা না করেই চশমার দোকান থেকে কন্টাক্ট লেন্স নিয়ে ব্যবহার শুরু করে দেন। সাবধান! বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ব্যতিরেকে কন্ট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করবেন না। 

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।