অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ধারাবাহিক অনুবাদ উপন্যাস

১৯৮৪ ।। মূল: জর্জ অরওয়েল ।। অনুবাদ: মাহমুদ মেনন [পর্ব-১৩]

মাহমুদ মেনন, সাংবাদিক ও শিক্ষক

প্রকাশিত: ১০:২৪ এএম, ১১ জুন ২০২১ শুক্রবার   আপডেট: ০২:৫৫ পিএম, ২ জুলাই ২০২১ শুক্রবার

১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

১৯৮৪, মূল- জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

 


[পর্ব-এক] [পর্ব-দুই] [পর্ব-তিন] [পর্ব- চার] [পর্ব- পাঁচ] [পর্ব-ছয়[পর্ব- সাত] [পর্ব-আট] [পর্ব-নয়] [পর্ব-দশ] [পর্ব-এগারো] [পর্ব-বারো


পর্ব- তেরো

সবকিছুই ধোয়াশায় মিশে গেছে। অতীত মুছে ফেলা হয়েছে, যার ঘঁষে ফেলা অংশটিও এখন বিস্মৃত, মিথ্যাটাই আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। গোটা জীবনে মাত্র একটিবার- মিথ্যায়নের সুনির্দিষ্ট, অভ্রান্ত নজীর তার হাতে পড়েছিলো। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড ওটি আঙুলের ফাঁকে আটকে ধরেও রেখেছিলো সে। সালটা ১৯৭৩ই হবে- ততদিনে ক্যাথরিনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তবে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারিখটি বিচ্ছেদেরও সাত বা আট বছর আগের। 

গল্পের শুরু ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, মহাশুদ্ধিকরণের সেই দিনগুলোতে বিপ্লবের মূল হোতাদের যখন একবারে এবং চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হচ্ছিলো তখন। ১৯৭০ এর পর এদের একজনেরও অস্তিত্ব থাকলো না, বিগ ব্রাদার ছাড়া। বাদবাকিরা ততদিনে হয় উবে গেছে নয়তো ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিবিপ্লবীর তকমা নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গোল্ডস্টেইনও পালালো, আর কোথায় সে গা-ঢাকা দিলো তা কেউ জানে না। অন্যদের মধ্যে কেউ কেউ স্রেফ গুম হয়ে গেলো, আর অধিকাংশেরই বিস্ময়কর গণবিচারে অপরাধের স্বীকারোক্তির পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলো। 

শেষ যারা টিকে ছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন তিনজন- জোন্স, অ্যারোনসন আর রাদারফোর্ড। ১৯৬৫ সাল নাগাদ এই তিনজনকে গ্রেফতার করা হলো। যেমনটা প্রায়শঃই ঘটে, এদের তিনজনকেই বছর খানেক বা তারও বেশি সময় ধরে লাপাত্তা করে দেওয়া হলো, যাতে কেউ বুঝতে না পারে ওরা বেঁচে আছেন, নাকি মৃত। এরপর স্বাভাবিক নিয়মে হঠাৎই একদিন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে আবারও সামনে আনা হলো তাদের। তিন জনই স্বীকার করলেন, তারা শক্রপক্ষের গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করেছেন (সে সময়ও ইউরেশিয়াই ছিলো শত্রুপক্ষ), সরকারের তহবিল তসরুপ করেছেন, দলের কয়েকজন আস্থাভাজন সদস্যকে হত্যা করেছেন, বিগ ব্রাদারের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন আর তা শুরু হয় বিপ্লব শুরুরও অনেক আগে, এছাড়াও তারা জড়িত ছিলেন এমন এক নাশকতায় যার ফলে মৃত্যু হয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। এতসব কিছু স্বীকার করে নেওয়ার পরেও তাদের ক্ষমা করে দেওয়া হলো, দলে ফিরিয়ে নেওয়া হলো, পদে বসানো হলো, যেসব পদ স্রেফ অনারারি, দায়িত্বহীন। তিন জনই ‘দ্য টাইমস’এ লম্বা ফিরিস্তিমূলক ফালতু নিবন্ধ লিখলেন যাতে বর্ণিত হলো তাদের পদস্খলনের কারণ আর সংশোধিত হওয়ার প্রতিশ্রুতি।

ওদের ছেড়ে দেওয়ার পর কিছুদিনের মধ্যেই একদিন এই তিনজনকে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে দেখতে পায় উইনস্টন। তার মনে পড়ে, চোখের কৌনিক দৃষ্টি ফেলে কি ভীতিকর আগ্রহ নিয়ে সে তাদের দেখেছিলো। ওরা তার চেয়ে অনেক বয়ষ্ক, যেন প্রাচীন বিশ্বের ভগ্নাবশেষ, দলের সেই গৌরবময় সাহসী দিনগুলোর টিকে থাকা শেষ ক’টি মানুষ। গোপণ সংগ্রাম আর গৃহযুদ্ধের জ্বলজ্বলে স্মৃতি এখনও তাদের চোখেমুখে হালকা হয়ে মেখে আছে। তার মনে পড়ছিলো, যদিও ততদিনে তারিখ আর ঘটনাগুলো আবছা হয়ে এসেছে, বিগ ব্রাদারের নাম জানার অনেক আগেই সে জেনেছিলো এই মানুষগুলোর নাম। কিন্তু মাত্র একটি কিংবা দুটি বছরের মধ্যেই এরা হয়ে গেলো নিষিদ্ধঘোষিত, শক্রপক্ষ, অচ্ছ্যুত, দণ্ডপ্রাপ্ত, নিশ্চিত মৃত্যুপথযাত্রী। থট পুলিশের হাতে পড়ে শেষ পর্যন্ত রেহাই পেয়েছে এমন একজনও পাওয়া যাবে না। এরা আসলেই কয়েকটি মৃতদেহ যাদের ভাগাড়ে পাঠানোর অপেক্ষা মাত্র।  

ওদের কাছাকাছি টেবিলগুলোতে কেউ বসেনি। এ ধরনের মানুষের আশেপাশেও ঘেঁষাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। লবঙ্গের সুঘ্রাণ মিশ্রিত জিন এই ক্যাফের বিশেষত্ব, তারই ঘ্রাণ ছড়ানো গ্লাস সামনে নিয়ে নিঃশব্দে বসেছিলেন তারা। তিন জনের মধ্যে রাদারফোর্ডের চেহারা বেশি আকৃষ্ট করে উইনস্টনকে। একসময়ের বিখ্যাত ব্যাঙ্গচিত্র আঁকিয়ে, যার দুর্দান্ত কার্টুনগুলো বিপ্লবপূর্ব ও বিপ্লবকালীন বিষ্ফোরিত জনমত গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছিলো। এখনও দীর্ঘ বিরতিতে তার কার্টুন দ্য টাইমসে আসে। তবে সেগুলো পুরোই ফাঁকিবাজি, স্পন্দন নেই, নেই প্রভাবিত হওয়ার মতো কিছু। পুরোনো বিষয়গুলোরই চর্বিত চর্বন- বস্তিবাসী, ক্ষুধার্ত শিশু, সড়ক সংঘর্ষ, আর চোঙা হ্যাটের পুঁজিপতি- বাধার মধ্যে থেকেই পুঁজিপতিরা এখনো তাদের চোঙা হ্যাটে পেছনের দিনে ফিরে যাওয়ার অবিরাম, অবুঝ  চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিপুল বপু, তেলজবজবে ধুসর কোকঁড়ানো চুল, বলিরেখা ভরা ঝুলে-পড়া চামড়ার মুখ, নিগ্রোগের মতো মোটা ঠোঁট রাদারফোর্ডের। একসময় তার শরীর যে ভীষণ শক্তি ধরতো তা বোঝা যায়, কিন্তু এখন তার সেই বড় বপুখানা ঝুঁকে-নুয়ে পড়েছে, ভেঙ্গে-ভেঙ্গে পড়ছে সবদিক থেকে। পাহাড় যেমন ধসে যায় তেমনি মানুষের চোখে ধসে পড়েছেন তিনি।

বেলা তখন তিনটা, একাকীত্বের সময় উইনস্টনের। এখন ঠিক মনে আসছে না, অমন একটি সময়ে কিভাবেই সে চেস্টনাট ট্রি ক্যাফেতে পৌঁছেছিলো। গোটা ক্যাফেই বলতে গেলে ফাঁকা। হালকা একটা সুর-সঙ্গীত টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে আসছিলো। তিন ব্যক্তি এক কোনায় অনেকটা মূর্তির ন্যায় বসে, মুখে রা নেই কারো। কিছু বলার আগেই আরেক প্রস্থ জিন দিয়ে গেলো ওয়েটার। টেবিলের একপাশে একটা দাবার বোর্ড, গুটি সাজানো আছে,  খেলা শুরুর অপেক্ষা। টেলিস্ক্রিনের সঙ্গীত পাল্টে গেলো। শুরু হলো নতুন বাজনা- অদ্ভুত, ভাঙ্গা, কর্কশ এলোমেলো স্বর। উইনস্টন মনে মনে এর নাম দিয়েছে হলুদ স্বর। টেলিস্ক্রিন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ গাইছে:

ছড়িয়ে পড়া চেস্টনাট গাছের ছায়ায় 
আমি তোমাকে বেচলাম, তুমি বেচলে আমায়
হেথায় শুয়ে তারা, আর আমরা এখানে
ছড়িয়ে পড়া চেস্টনাট গাছের ছায়ায়... 
                    
তিন জনের মধ্যে নড়াচড়াটুকুও নেই। উইনস্টন আরেকবার যখন রাদারফোর্ডের বিপর্যস্ত চেহারায় চোখ ফেললো, দেখতে পেলো চোখ দুটি পানিতে ভরে উঠেছে। আর প্রথমবারের মতোই তার নজরে এলো অ্যারনসন ও রাদারফোর্ড দুজনেরই নাক ভাঙা। চোখে পড়তেই মনের ভেতরটা গুমড়ে উঠলো। অবশ্য আজও সে জানেনা কেনোই তার মনের ভেতরটা গুমড়ে উঠেছিলো।

কিছুদিনের মধ্যে তিনজনকেই গ্রেপ্তার করা হলো। দেখানো হলো, মুক্তির পর থেকেই এরা তিনজন নতুন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। দ্বিতীয় বিচারে তারা আরেকদফা পুরোনো সকল অপরাধ স্বীকার করলো, সঙ্গে নতুন অপরাধগুলোও পুরোপুরি মেনে নিলো। তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে গেলো, আর তাদের এই করুণ পরিণতি পার্টির ইতিহাসে নথিভুক্তও হলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে। 

এর প্রায় পাঁচ বছর পর, ১৯৭৩ সাল, নিউমেটিক টিউব থেকে মাত্র বের করে এনে টেবিলে রাখা এক গাদা নথি থেকে একেকটির প্যাঁচ খুলে খুলে দেখছিলো উইনস্টন। তার মধ্যেই সে পেয়ে গেলো একটি কাগজ যা অন্যগুলোর মধ্যে ভুলে ঢুকে পড়েছে। খুলেই সে এর গুরুত্ব ধরে ফেললো। এটি ছিলো দ্য টাইমসের বছর দশেক আগের একটি সংখ্যার ছেঁড়া আধখানা পাতা। পাতার উপরের আধা অংশ, ফলে তারিখটিও রয়েছে স্পষ্ট। পত্রিকার সেই পাতায় পার্টির একটি প্রতিনিধি দলের নিউ ইয়র্ক সফরে গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার খবর একটি বড় ছবিসহ। ছবির মাঝখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উপস্থাপিত তিনজন- জোন্স, অ্যারনসন আর রাদারফোর্ড। ভুল হওয়ার কোনও কারণ নেই, আর নিচে ক্যাপশনেও লেখা ছিলো তাদেরই নাম।

এখন কথা হচ্ছে, দু’দফা বিচারেই এরা তিন জন স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, ওই দিনটিতে তারা ইউরেশিয়ায় অবস্থান করছিলেন। কানাডার একটি গোপন বিমানঘাঁটি থেকে উড়ে গিয়েছিলেন সাইবেরিয়ায়। সেখানে ইউরেশীয় জেনারেল স্টাফের সদস্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে তারা তুলে দিয়েছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গোপন তথ্য। উইনস্টনের কাছে তারিখটি ধরা পড়লো কারণ ওটি ছিলো মধ্য গ্রীস্মের একটি দিন। পুরো গল্পটি অবশ্যই আরও অসংখ্য স্থানে একইভাবে রচিত হয়ে আছে। এ থেকে বলাই যায়- এরা মিথ্যা স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন।

অবশ্যই এটা নতুন কোনও আবিষ্কার নয়। শুদ্ধি অভিযানে বিলীন হয়ে যাওয়া মানুষগুলো যেসব অপরাধে অভিযুক্ত, সত্যিকারে সে অপরাধগুলো তারা করতো বলে উইনস্টন কল্পনায়ও মনে করতো না। কিন্তু এ ছিলো এক সুনির্দিষ্ট প্রমাণ, ছিলো মুছে ফেলা অতীতের বেঁচে যাওয়া একটি স্মৃতি, যেভাবে জীবাষ্মের কোনো হাড় ভুল স্তরে পড়ে টিকে গিয়ে ভূ-তত্ত্বের মূল তত্ত্বকেই হুমকিতে ফেলে দেয় কখনো, ঠিক তেমনি। এই একটি নথি পার্টিকে অণুতে গুঁড়িয়ে দিতে পারে, যদি কোনভাবে বিশ্বের দরবারে এটি প্রকাশ করা যায় আর এর গুরুত্ব তুলে ধরা যায়, তবেই। 

সোজা কাজে মন দিলো উইনস্টন। ছবিটি দেখে এর গুরুত্ব বুঝে ফেলার পর দ্রুতই আরেকটি কাগজ দিয়ে ওটি ঢেকে ফেললো। ভাগ্য ভালো বলা চলে, কাগজটি যখন খুলছিলো তখন টেলিস্ক্রিনের চোখে ছিলো এর উল্টো দিকটা।

লেখার প্যাড হাঁটুর উপর রেখে চেয়ারটি ধাক্কা দিয়ে পেছনে সরিয়ে নিলো উইনস্টন। টেলিস্ক্রিনের চোখ থেকে নিজেকে যতটা বাঁচানো যায়। চেহারা অভিব্যক্তিশূন্য করে রাখা এমন কিছু কঠিন নয়, এমনকি শ্বাস-প্রশ্বাসও নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়; কিন্তু হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়; আর টেলিস্ক্রিন এতটাই সুক্ষ্ম যে ওই স্পন্দনটিও ধরে ফেলে। তার বিচারে এভাবেই কাটলো দশ মিনিট, যন্ত্রণাদায়ক একটি ভয় ভর করে থাকলো মনের ভিতর- যেনো তাকে প্রতারিত করে, আচমকা বাতাসের ঝাপটায় ডেস্ক থেকে সব উড়ে যাবে। এরপর, ঢাকা থাকা অবস্থাতেই তুলে নিয়ে আরও কিছু অকেজো কাগজের সঙ্গে ছবিটি স্মৃতি গহ্বরে ফেলে দিলো। আর সম্ভবত এক মিনিটের মধ্যেই তা ভষ্মে পরিণত হলো।

এ ঘটনা দশ-এগারো বছর আগের। এখনকার হলে, হতে পারতো, ছবিটি রেখেই দিতো উইনস্টন। তবে হাতের আঙুলে ক্ষণকাল চেপে ধরে রাখা সেই সত্য তার কাছে এখনও ভিন্ন কিছু অর্থ দেয়, যদিও সেই ছবি আর সে ছবিতে নথিভুক্ত ঘটনা দুইই আজ স্মৃতি। তার সন্দেহ জাগে, অতীতের ওপর কি তাহলে দলের দখল কম, যে দলিল আজ নেই, এক সময়তো তা অবশ্যই ছিলো। 

কিন্তু আজ, ধরা যাক ছাই থেকেই ছবিটি ফের আসল চেহারা পেলো তাতেই কি একটি বড় প্রমাণ হয়ে যাবে। সে যখন এটি আবিষ্কার করে ততদিনে ওশেনিয়ার সঙ্গে ইউরেশিয়ার যুদ্ধ সাঙ্গ হয়ে গেছে, তখন পূর্ব এশিয়ার এজেন্টদের কাছে এর ব্যাখ্যা এই হতো, তিনটি মৃত ব্যক্তি তাদের দেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।

এরপর পরিস্থিতি বার বার পাল্টেছে- দুই বার, তিন বার, সে জানেনা কতবার! হতে পারে স্বীকারোক্তি পুনর্লিখনের পর পুনর্লিখন হয়েছে, যতক্ষণ মূল ঘটনা ও তারিখ তার সামান্য গুরুত্বটুকুও হারিয়ে না ফেলেছে ততক্ষণ, ততবার লেখা হয়েছে। অতীত কেবল পাল্টেই দেওয়া হয়নি, বার বার পাল্টানো হয়েছে। মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে যা তাকে সবচেয়ে বিপর্যস্ত করে রাখে তা হচ্ছে সে কোনও দিন স্পষ্ট করে বুঝতে পারে না, কেনো ছলচাতুরির এই বিশাল যজ্ঞ। অতীত মিথ্যায়নের আপাত সুবিধা আছে, কিন্তু এর মূল অভিসন্ধী রহস্যে ভরা। ফের কলম তুলে নিলো সে, লিখলো:

আমি বুঝি কিভাবে; কিন্তু বুঝিই না কেনো।

সে নিজেই কি আসলে একটা পাগল? এই ভেবে তার ভয় হয়। অতীতেও বার বার হয়েছে। একজন পাগল স্রেফ একা। একটা সময় ছিলো, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে এমন কথায় বিশ্বাস করাই ছিলো পাগলামি; এখন অতীত পাল্টানো যায় না, সে কথায় বিশ্বাস করা পাগলামি। হতে পারে সে একাই সেই বিশ্বাস ধারণ করে, আর যদি একাই হয়, তাহলে তো সে পাগলই। তবে এই পাগল হওয়ার ভাবনা তাকে খুব একটা ঝামেলায় রাখে না, বরং তার এই ভাবনা যদি ভুল হয়ে বসে সেই ভয়টিই বড় আতঙ্কের বিষয় হয়ে ওঠে! 

শিশুদের ইতিহাস বইটি তুলে নিয়ে এর মুখচিত্রে ছাপা বিগ ব্রাদারের ছবিটির দিকে তাকালো সে। সম্মোহনী চোখ দুটো তার চোখের গভীরে প্রোথিত। মনে হবে কিছু একটা কঠিন চাপ সৃষ্টি করে খুলির ভেতরে ঢুকে পড়ছে, মস্তিষ্কে আঘাত হানছে, বিশ্বাসগুলো থেকে বের করে আনার চেষ্টা করছে, আর প্রায় এমন কাবু করে ফেলছে যেনো আপনি আপনার নিচের চেতনাকেও অস্বীকার করে বসেন। এরপর পার্টি একদিন ঘোষণা করে দেবে- দুই আর দুইয়ে পাঁচ হয়, আর আপনি তাই বিশ্বাস করবেন। এটা অবশ্যম্ভাবী, অতি শীঘ্র, নয়তো আরও পরে পার্টি একদিন এমন দাবিই করবে, তাদের অবস্থান থেকে এটাই হবে যৌক্তিক দাবি। অভিজ্ঞতার শক্তিই কেবল নয়, বিদ্যমান বাহ্যিক বাস্তবতাগুলোও কৌশলে তাদের দর্শণ দিয়ে অস্বীকার করা হচ্ছে। সকল নব্যতন্ত্রের সেরা তন্ত্র সাধারণ জ্ঞান। ভিন্নচিন্তার জন্য আপনাকে যে ওরা হত্যা করে সেটা ভয়ঙ্কর নয়, ভয়ঙ্কর হচ্ছে ওরা যা করে সেটাই ওরা সঠিক বলে জ্ঞান করে। তাহলে আমরা কিভাবেই জানবো, দুই আর দুইয়ে চার হয়? অথবা মধ্যাকর্ষণের শক্তি কিভাবে কাজ করে? অথবা অতীত পাল্টানো যায় না? যদি অতীত আর বাহ্যিক পৃথিবী দুইয়েরই অস্তিত্ব থাকে কেবল মনে, আর সে মনটা যদি হয় নিয়ন্ত্রিত, তাহলে কী করেই বা তা হবে?

কিন্তু না! তার সাহসিকতা হঠাৎ করেই যেনো নিজের মতো করে জোর পায়। কোন যোগসূত্র ছাড়াই তার মনে ভেসে উঠলো ও’ব্রায়েনের মুখ। অতীতের চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চয়তায় সে জানে, ও’ব্রায়েন তার পক্ষের কেউ নন। সে এই ডায়রি লিখছে ও’ব্রায়েনের জন্য- ও’ব্রায়েনের কাছে: এ যেনো অসমাপনীয় একটি চিঠি যা কেউ পড়বে না; কিন্তু তা এক বিশেষ ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে লেখা এবং সেই সত্য থেকেই এর রং নেওয়া।

পার্টি বলে দিয়েছে যে কোনও দলিল চোখে দেখে বা কানে শুনে ভুলে যেতে হবে। এটিই তাদের চূড়ান্ত ও সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ। তার হৃদয়টি যেনো তলিয়ে যায় যখন সে ভাবে কি ভয়ানক ক্ষমতার দাপটে সে কুক্ষিগত হয়ে আছে, কত সহজে পার্টির কোনো বুদ্ধিজীবী তাকে বিতর্কের মাঝে ছুঁড়ে দিতে পারে, ধোঁয়াটে যুক্তি খাড়া করতে পারে যার উত্তর দেওয়া দূরে থাক, অর্থই সে বুঝতে পারবে না। তার পরেও সত্যেই তার অবস্থান! ওরাই ভুল, সেই সঠিক। ষ্পষ্টতই যা প্রতীয়মান, যা ফালতু, যা সত্য তা সুরক্ষিত হবে। স্বতঃসিদ্ধ সত্যগুলো সত্য হবে! মাটির পৃথিবী বিদ্যমান, এর আইন পাল্টায় না। পাথর শক্ত, পানি ভেজা, উপর থেকে ফেললে কোনো বস্তু নিচেই পড়বে। ও’ব্রায়েনকে উদ্দেশ্য করেই যেনো কথাগুলো বলছে, এবং সে যেনো কোন স্বঃতসিদ্ধ বিষয় সামনে নিয়ে আসছে এমন একটি অনুভূতি নিয়ে সে লিখলো:
 
স্বাধীনতা হচ্ছে, দুইয়ে দুইয়ে চার হয়, এই কথাটুকু বলতে পারা। এটুকু স্বাধীনতা যদি মেলে, বাকি সবই মিলবে। [পরের পর্ব পড়ুন এখানে]