অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

ভার্চুয়াল ডায়রি

অপরাহ্নের সামগীতি: ইদ, মা, বাইডেন, নোয়াহ ও পত্রপল্লবের গল্প

রিফাত ফাতিমা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে

প্রকাশিত: ০৫:১৯ পিএম, ৫ জুন ২০২১ শনিবার   আপডেট: ০৪:৪৩ পিএম, ২৫ জুন ২০২১ শুক্রবার

রিফাত ফাতিমা

রিফাত ফাতিমা

রিফাত ফাতিমা। এখন একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক। বছর খানেকের কিছুটা বেশি সময় ধরে বাস করছেন ইন্ডিয়ানা রাজ্যের সাউথবেন্ডে। সেখানকার প্রকৃতি, জীবনাচার এসব নিয়ে নতুন বিষ্ময়ের আবিষ্কার করেই চলেছে সদ্য দেশ ছাড়া এই সংবাদকর্মীর কৌতুহলী মন। সেগুলো তিনি লিখে রাখছেন ভার্চুয়াল ডায়েরিতে। করোনা ভাইরাসের মহামারি কালে যুক্তরাষ্ট্র যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে তার পর আবার যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সেসব চাক্ষুস করছেন কিংবা জানছেন। এর সাথে মিলিয়ে দেখছেন পৃথিবীর অপরপীঠ বাংলাদেশকেও। অপরাজেয় বাংলা'র পাঠকদের জন্য আমরা তুলে আনছি লেখাগুলো রিফাত ফাতিমার ডায়রি থেকে। যার তিনি নাম দিয়েছেন অপরাহ্নের সামগীতি।

ইদ, মা, বাইডেন, নোয়াহ ও পত্রপল্লবের গল্প

দিন কয়েক আগে ইদ গেল। আমি কেবল একদিনের ছুটি নিয়েছি, চমৎকার আবহাওয়া। আ্ম্মাকে ছাড়া জীবনে আমাদের প্রথম ইদ। আমি বিকেল থেকে আম্মার শেষ মুহুর্তে যে ওড়নাটা গায়ে ছিল তা জড়িয়ে ছিলাম। আসলে আম্মার গায়ের গন্ধ খুজছিলাম। যদিও আমি জানি না মায়েদের সুবাস কেমন হয়। আম্মা জীবনে আমাকে খুব কম জড়িয়ে ধরেছেন, তিনি শৈশবে তার মাকে কাছে পান নি। তাই তিনি জানেন না, সন্তান বড় হলেও তাকে মাঝে মাঝে জড়িয়ে ধরতে হয়। ফাহমিদ দুপুরে ইউনিভার্সিটিতে পূর্ব নির্ধারিত লাঞ্চে গেল, বাসায় আমরা কেবল তিনজন। আরো চমৎকার ব্যাপার হচ্ছে মেয়ের পরীক্ষাও ছিল সেদিন। এক পর্যায়ে মনে হল, তাহলে কেন ছুটি নিলাম, মন্ময় স্কুলে যেত, আমিও স্কুলেই থাকতাম। তাহলে আর পোলাও কোর্মা রেঁধে কি হবে, মনের দুঃখে তেলছাড়া খিচুরি রেধেছি। বিকেলে ওয়াহিদ ভাই ও রুমানা ভাবির বাসায় ওপেন হাউস পার্টিতে গিয়ে সত্যিকারের ঈদের আমেজ পেলাম। আমাদের কম্যুনিটির প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন।

রাতে মা কেঁদেকেটে একসা হয়ে ফোনে বললেন, ‘তুমি আমার ইদ, আমার নাতিপুতি ছেলেমেয়ে আমার ইদ।’ মায়ের হাতের খড়ির চুলায় রান্না গরুর মাংসের টুকটুকে লাল রং ও স্বাদ মিস করছি। আমাদের মায়েরা বছরের পর বছর কি অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে আমাদের রেঁধে খাইয়েছেন, তারপরও সুযোগ পেলেই মায়ের সাথে রান্না ভালো হয়নি বলে চোটপাট করেছি। এখন আমাকে কেউ রান্না করতে বললে পিটুনি দিতে ইচ্ছে করে। আমাদের স্কুলের ওনার মি. প্যাটেল নাচো গ্র্যান্ডে অফার করে আমাকে বলেছিলেন, ‘ট্রাই দিস, ইটস ভেরি ডেলিশাস। ইউর চিলড্রেন উইল লাইক দিস।’ আমি বিনয়ের সাথে বলেছিলাম, ‘নিশ্চয় তারা পছন্দ করবে, কিন্তু ওদের এটা আমি বাসায় রেঁধে খাওয়াতে রাজি নই। রেষ্টুরেন্টে গিয়ে কিনে খাবে।’ ভদ্রলোক আর কথা বাড়াননি। রান্না সর্ম্পকে আমার অনীহার বিবিধ কারণ আছে, তার মধ্যে একটি হল আমি আমার মূল্যবান সময় দিয়ে কারো জন্য রেঁধেছি, সে খেয়েছে। তারপর আবার অন্য জায়গায় গিয়ে বলেছে, হার্টের রোগির রান্না, খেতে ভালো লাগে না। তাহলে বাবা কেন আপনি বা আপনারা মরতে আমার কাছে আসেন? ডলার খরচ করে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খান অথবা রাঁধুনি বিয়ে করুন। ভাবছি কারাতেটা আবার ঝালিয়ে নেব। কখন কোনটা কাজে দেয় কেউ বলতে পারে না। সবই লাইফ স্কিল।

বাইডেন প্রশাসন জানিয়েছে, শিগগীরই ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় দেশসমূহ, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা সেইসাথে ফিলিস্তিন ভূ-খণ্ড, যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজা ও পশ্চিমতীরে প্রথম দফায় মোট ৮০ মিলিয়ন টিকা পাঠানো হবে। সম্প্রতি করোনার টিকার জন্য ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি সুরক্ষা আইনে ছাড় দেওয়া হলেও এ্যাকটিভিস্টরা বলছেন দান ও ছাড় যথেষ্ট নয়। তারা ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন দেশের টিকা উৎপাদনকারীদের কাছে তাদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি হস্তান্তরের আহবান জানিয়েছে যাতে করে দেশগুলো নিজেরাই টিকা উৎপাদন করতে পারে।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন সামরিক বা সারভিল্যান্স প্রযুক্তি বিক্রয় করে এমন কিছুর সাথে জড়িত চীনা কোম্পানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের বিনিয়োগ না করার জন্য এক নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। এমন এক সময়ে এই অধ্যাদেশ জারি করা হল যখন চেহারা শনাক্তকরণ ক্যামেরা, ফোন স্ক্যানার ও অন্যান্য প্রযুক্তির সাহায্যে চীন তার জনগণের উপর নজরদারির সক্ষমতা বাড়াচ্ছে।

আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে সবাই কেবল ছুটছে। গত দু’ শতাব্দীতে বিশেষ করে শেষের কয়েক দশকে মানবীয় উন্নয়ন যেমন মানুষ দীর্ঘজীবী হয়েছে, উৎপাদন ও ভোগবাদিতা বেড়েছে, ফলে বর্জ্য বেড়েছে গ্রিন হাউস গ্যাস নিসরণ বেড়েছে। উনিশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীর মানুষ পাচ গুণ হারে বেড়েছে। এই করোনা মহামারী প্রকতির প্রতিশোধ মাত্র। 

প্রখ্যাত ভারতীয় আমেরিকান সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়া তার ‘টেন লেসনস ফর এ্যা পোষ্ট প্যানডেমিক ওয়ার্ল্ড' নামক বইয়ে নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত বায়োলজিষ্ট জসুযা ল্যাডারবার্গের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন, ‘‘আমরা আমাদের বায়োলজিক্যাল ট্রাইজেক্টরি এত বদলেছি যে, সমসাময়িক মানুষ এখন কেবল মনুষ্য সৃষ্ট এক প্রজাতিমাত্র।" তিনি মানুষের অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রাকে অন্যান্য গ্রহ ও জীব প্রজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি বলে অভিহিত করেছেন কারন মানুষ নিজেদের স্বার্থে তাদের যার যার জায়গা থেকে বিতাড়িত করেছে। উল্লেখ্য ব্যাকটেরিয়াল জেনেটিক্সে কাজ করে ল্যাডারবার্গ মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পান। তার মত, মানুষ অপ্রতিরোধ্য হলেও তার একমাত্র প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইরাস, শেষ পর্যন্ত এটাই জিততে পারে।

তাহিয়া মন্ময়ের এবছরের স্কুল ইয়ার শেষ হল। যদিও তারা ব্যস্ত থাকবে তাদের স্কুলের সামার প্রোগ্রাম নিয়ে। যথারীতি ফাহমিদ ও আমিও ব্যস্ত থাকব। তাহিয়া তার স্কুলের মজার মজার গল্প বলে হেসে লুটোপুটি খায়। একটি হল, একদিন তার এক সহপাঠি সাইদ আরেক সহপাঠিকে বলছে,‘‘এ-ও নোয়াহ! ডু ইউ লাইক উইমেন থিক অর স্কিনি?’’ নোয়াহ টেবিলে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছিল, আচমকা জেগে বলল, ‘হোয়াট?’ সাইদ আবারও একই ফিচেল প্রশ্ন করলে ক্ষেপে গিয়ে নোয়াহ বলল, ‘আই উইল প্রিটেন্ড দ্যাট ইউ ডোন্ট একজিস্ট।’ তারপর আবার ঘুম।

এই গ্রীস্মে সূর্য তাপ ছড়াচ্ছে ভীষণ। পাশ্ববর্তী লরেন্স, ম্যারিয়ন ও গ্রোভ স্ট্রিটের শান্ত ঘরবাড়ি ও তরুণ পত্রপল্লবিত গাছগাছালি গরমে মন জুড়িয়ে দেয়। মিডল স্কুলের ছেলেমেয়েরা গল্প করতে করতে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। ফেয়ার ভিউ সেমেট্রির পাথরের ফলকে ঝিকিয়ে উঠছে রোদ, পুড়ছে সূর্য, পুড়ছি আমরা।  

রিফাত ফাতিমা
৩ জুন, সাউথ বেন্ড, ইন্ডিয়ানা, যুক্তরাষ্ট্র....... পরের পর্ব পড়ুন এখানে

পর্ব-এক: অপরাহ্নের সামগীতি: সুপারম্যান, হাঁসছানা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ