অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

অস্তিত্ব হারাতে বসেছে দেড়শ’ বছরের পুরনো হাট

​​​​​​​শওকত জামান, জামালপুর

প্রকাশিত: ১১:১২ এএম, ৯ অক্টোবর ২০২০ শুক্রবার   আপডেট: ০২:২৯ পিএম, ৯ অক্টোবর ২০২০ শুক্রবার

বাবার হাতের আঙুল ধরে শিশু এলাহী বকস হাটে আসতেন গুদগাশিমলার রঘুনাথপুর গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে। সেই আসা যাওয়ায় মাঝেই ছেলেবেলার কোনো একদিন হাটুরে পরিচয় থেকে এই হাটের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন তিনি নিজেই। সেই থেকে এই হাটেই কেটে গেল ৭৫ বছর। পান ব্যবসায়ী এলাহি বকসের বয়স এখন ৮৫।

কথা হচ্ছিলো তার পান পসরার পাশে বসেই। অশিতিপর বৃদ্ধ যেনো ফিরে গেলেন শৈশব-কৈশর-যৌবনে। বললেন,  হাট সরগরম থাকতো ক্রেতা সমাগমে। সপ্তাহের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ কেনাকাটা সেরে নিতেন হাটে আসা লোকজন। হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার কোলাহলে যে গম-গম আওয়াজ হতো তা শোনা যেত এক মাইল দুর থেকেও।

হাটে ক্রেতা-বিক্রেতার দরকষাকষি, চিতকার করে না বললে কেউ কারো কথা শুনতে পাবে না। হাজারো চিতকার মিলেই তৈরি হতো সেই শব্দ। ফলে এক সময় তা অভ্যাসেও পাল্টে যায়।

‘গ্রামের ছেলে আমি, চেঁচিয়ে কথা বলাই অভ্যাস’, সব্যসাচি লেখক সৈয়দ শামসুল হক ঈর্ষা নাটকে গ্রামের ছেলের চরিত্র এভাবেই এঁকেছেন। সম্ভবত লেখকের, গ্রামীণ হাটে শতশত মানুষের মধ্যে চেঁচিয়ে কথা বলার চিরসত্য প্রবণতাটা অন্তরে দাগ কেটেছিল। তাইতো তিনি গ্রামের ছেলের এমন প্রাণবন্ত চরিত্রায়ন করেছেন এত সহজে! আর লেখকের সে কথাই শোনাগেলো বাস্তব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এলাহী বকসের মুখে।

হটের দিন হাটগামী ও হাট ফেরত মানুষের সারি সারি লাইন। কত দিয়ে কিনেছো, কত দরে বেচবে এসব আলোচনা পথেই চলতো। হেকে হেকে সব কিছু জানতে চাওয়া।

হাট মানেই হাটুরের হাতে ঝুলছে স্বাদের ইলিশ, সপ্তাহের বাজারের ব্যাগ, নতুন কাপড়। তেল-নুন, পান-সুপুরি, সুই-সুতো কোনোটাই বাদ যায় না।

সেই সব গল্পই মিলে যায় জামালপুরের এই ঐতিহ্যবাহী হাটে। কি ছিলো না এখানে।

ক্রেতা সামলাতে হিমশিম খেতে হতো হাটের দোকানীদের। এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাট ছিল রাণিগঞ্জ। বড় হাট বা বৈকাল বাজার নামেই পরিচিত হয়ে উঠে। আশপাশে এলাকার বাইরেও দুরদুরান্ত থেকে লোকজন আসতো বেচাকেনা করতে, জানালেন এলাহী বকস।

হাটে বেচাকেনারত অবস্থায় কথা হয় শরিফপুরের মির্জাপুর গ্রামের পিয়াজ ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদের (৬০) সঙ্গে। তিনিও এই হাটে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছেন। কিছুটা মলিন মুখে বললেন, হাটটি কি দেখেছিলাম, কি হইলো! যে হাটে পা ফেলানোর জায়গা থাকতো না, প্রচণ্ড ভীরে বাবার হাত ধরে সখে হাটে আসা ছেলে-মেয়েরা হারিয়ে যেত। প্রায়দিনই হাট ইজারার মাইকে নিখোঁজের সংবাদ শোনা যেত। এই জমজমাট হাট এখন ক্রেতা শুণ্য।

‘একসময় ক্রেতা ফিরাতে পারতাম না সেখানে ক্রেতার আসায় বসে থাকি। আগে ১০/১৫ মন পিয়াজ হাটে আনলে সব বিক্রি করে বাড়ি ফিরতাম। এখন ১০/১৫ কেজিও বিক্রি হয়না। দুই থেকে ৩’শ টাকা কামাই হয় পোষায় না, তারপরেও হাটে আসার অভ্যাস না এসে থাকতে পারিনা’।

লোক সমাগমে মুখরিত হাটটির বেহালদশার কারন খুঁজতে গিয়ে আলাপ হয় লোহার গৃহস্থালী সামগ্রী বিক্রেতা খাদেম আলী (৬৫)’র সাথে। তার মতে, যত্রতত্র বাজার গড়ে উঠা, মুদির দোকানে সবধরনের পন্য পাওয়ার সহজলভ্যতা, হাটের জরাজীর্ণ চালাঘর আর হাট পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা এসবই এই হাটের জৌলুস হারানোর কারণ।  এই সমস্যায় পড়ে বড় হাট ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।

জামালপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ ধরে গড়ে ওঠা ব্যবসা বাণিজ্য ঘিরে শত বছরের আগে রানীগঞ্জ বাজার (বড় হাট) গড়ে উঠে। বৃহত্তর জামালপুরের সবচেয়ে বড় বাণিজয কেন্দ্র ছিল এটি। সপ্তাহে প্রতি শনি ও মঙ্গলবারে হাট বসে। কবে নাগাদ এই হাটটি চালু হয়েছে বলতে পারে না কেউ। অনেকের ধারনা, জামালপুরে জনপদ গড়ে উঠার গোড়ার দিকে এই হাটের জন্ম। প্রবীণ ব্যক্তিদের অনেকেই বলছেন, জমিদার আমলেই হবে এই হাটের শুরু।

সঠিক সন তারিখের তথ্য জামালপুরের ইতিহাসমুলক বইপুস্তকেও নেই। সকলের ধারনা প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরনো হবে এই হাট।

স্মৃতি থেকে তারা বলেন, এই হাটের মালামাল আনা নেয়ায় ব্রহ্মপুত্র নদের শাখা বংশখালে হাজার মনি নৌকা বজরা নোঙর করে রাখতেন সওদাগররা। আর দুরদুরান্ত থেকে হাট করতে আসতো মানুষ।

সেই জমজমাট হাট কালের বির্বতনে ও অবৈধ দখলদারদের কবলে পড়ে ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। যত্রতত্র বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠায় এখন মানুষজন সপ্তাহের পরিবর্তে দিনের বাজার দিনেই সেরে নেয়। তাই হাটের গুরুত্ব হারিয়ে অতীতের স্বৃতি আঁকড়ে কোনমতো অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

হাটে আসা ক্রেতা-বিক্রেতাদের অনেকেরই ইচ্ছা, ঐতিহ্যবাহী হাটটির পুরনো অবস্থায় ফিরুক। এজন্য তারা পৌর কর্তৃপক্ষের বাস্তবমুখি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি করেন। হাটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করে রাস্তার পাশে বসা বাজারের ব্যবসায়ীদের হাটে আনতে উদ্ভুদ্ধ করতে পৌরসভাকেই উদ্যোগ নিতে হবে, মত তাদের।

এ ব্যাপারে জামালপুর পৌরসভার মেয়র মির্জা সাখাওয়াতুল আলম মনির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বড় বাজার হাটের অতিত গৌরব রয়েছে। তবে হাটটি জমজমাট করার জন্য বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজে আসেনি।

তবে হাটের অবকাঠামো উন্নয়ন করে ব্যবসায়ীদের হাটে আনতে উদ্ভুদ্ধ করা হবে বলে আশারবাণী শোনালেন পৌর মেয়র।