অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা হতে চলছে কর্ণফুলী

রাজিব শর্মা, চট্টগ্রাম

প্রকাশিত: ০৫:০১ পিএম, ৩১ মে ২০২১ সোমবার   আপডেট: ০৫:২৭ পিএম, ৩১ মে ২০২১ সোমবার

দশ বছরের ব্যবধানে ভরাট, দখল ও দূষণে চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলী নদীর বেহাল অবস্থা। পানি ধারণক্ষমতা প্রায় বিশ শতাংশ কমে গেছে। এই অবস্থার মধ্যে নদীর জোয়ারের পানি শুধু নগরীর নিম্নাঞ্চল নয়, ক্রমান্বয়ে উঁচু হিসেবে চিহ্নিত এলাকায়ও ঢুকতে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্যাপিটাল ড্রেজিংসহ নদী খননের মাধ্যমে ধারণক্ষমতা না বাড়ালে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কর্ণফুলী নদী দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম শহরের বৃষ্টিসহ নালা-নর্দমার পানির প্রায় পুরোটাই ধারণ করে। কাপ্তাই বাঁধের মুখ থেকে বঙ্গোপসাগরের মুখ পর্যন্ত ৮৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর পানি ধারণক্ষমতা দিনে দিনে কমে এসেছে। বিশেষ করে নগরীর শাহ আমানত সেতু থেকে মোহনা পর্যন্ত ১৯.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় নদী দখল, দূষণ ও ভরাট হয়েছে বেশি। বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাত্যহিক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মোহনা এবং জেটি এলাকা খনন করলেও নদীর বিস্তৃত এলাকা রয়ে যায় খননের বাইরে। প্রতি দশ বছর অন্তর নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং পরিচালনার কথা থাকলেও নানা প্রতিকূলতায় তা হয়ে উঠেনি। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের নামে মালয়েশিয়ান কোম্পানি এবং দেশীয় প্যাসিফিক মেরিন কর্ণফুলী নদীর সর্বনাশ ঘটিয়েছে। নদী খননের চেয়ে নদী ভরাট করা হয়েছে বেশি। প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি অবৈধ স্থাপনা কর্ণফুলীর দুই পাড়ে দখলদারিত্ব চালিয়েছে। নদীর তলদেশে পলিথিনের আস্তরণ। সবকিছু মিলে কর্ণফুলী নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ২০১০ সালে শাহ আমানত সেতুর কাছে কর্ণফুলী নদী প্রস্থ ছিল ৮৫০ মিটার। শাহ আমানত সেতু থেকে মোহনার দিকে কোথাও ৭৫০ মিটার, কোথাও ৬০০ মিটার প্রস্থ ছিল। মোহনা থেকে সেতু পর্যন্ত নদীর গভীরতা ছিল ১১ মিটার থেকে সাড়ে ৩ মিটার পর্যন্ত। কিন্তু দখলে, দূষণে দশ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে নদীর গড় প্রশস্ততা ৫০০ মিটারে নেমে এসেছে। গভীরতা নেমে এসেছে আড়াই থেকে সাড়ে নয় মিটারে। নদীর সাড়ে ১৯ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলেছে দখলদারিত্ব আর ভরাট। এই অবস্থায় নদীর পানি ধারণক্ষমতা প্রতিদিন কমেছে। দশ বছরের ব্যবধানে নদীটির পানি ধারণক্ষমতা ২০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী নদী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, কর্ণফুলী দখল, দূষণ ভয়াবহ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। গত কয়েক বছরে নদীর সর্বনাশ ঘটানো হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ চ্যানেল পরিষ্কার রেখে জাহাজ চলাচল নিয়মিত রাখলেও উজানে নদীর অবস্থা শোচনীয়। পানি ধারণক্ষমতা দিনে দিনে কমার ফলে শহরের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে, যা চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতার জন্যও বড় ধরনের হুমকি।

কর্ণফুলী নদীর পানি ধারণক্ষমতা কমে যাওয়ায় জোয়ারের সময় নগরীর নিম্নাঞ্চল নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে। গত কিছুদিন ধরে নদীর জোয়ারের পানি নগরীর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করছে। ইতোপূর্বে আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, হালিশহর, ছোট পুল, বড়পুল, বেপারিপাড়া, চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, ঘাটফরহাদাবেগসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছিল। গত কিছুদিন ধরে জিইসি মোড়ের মতো এলাকাও প্লাবিত হচ্ছে। বিআরটিসি মোড়সহ সন্নিহিত এলাকায় আসছে জোয়ারের পানি। তপ্ত রোদের মাঝে জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। ভারী বর্ষণের সময় নগরীর জলাবদ্ধতা কোন পর্যায়ে যাবে তা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

বড় ধরনের ক্যাপিটাল ড্রেজিং করা না হলে নদীর পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ক্যাপিটাল ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। এই প্রকল্পের আওতায় নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করা হচ্ছে। সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় এই ড্রেজিং করা হচ্ছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনা কোম্পানি ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটির কাজ করছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পটির কাজ ত্রিশ শতাংশেরও বেশি সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ। নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করা হলে নদীর পানি ধারণক্ষমতা বাড়বে বলে জানান তিনি।

তবে অধ্যাপক মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, পুরো নদীতেই ড্রেজিং করতে হবে। এজন্য বড় ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। যে হারে নদী ভরাট এবং দখল হয়েছে তাতে ক্রাশ প্রোগ্রাম না চালালে পানি ধারণক্ষমতা আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়া কখনো সম্ভব হবে না। পানি ধারণক্ষমতা বাড়ানো না গেলে নগরীর জলমগ্ন হওয়া ঠেকানো সম্ভব হবে না।