অপরাজেয় বাংলা :: Aparajeo Bangla

‘ফিলিস্তিনিদের চাইতেও বড় ফিলিস্তিনি’ কেন হচ্ছেন?

কবির য়াহমদ, সাংবাদিক ও লেখক

প্রকাশিত: ১০:১১ এএম, ২৯ মে ২০২১ শনিবার   আপডেট: ১২:৩৭ পিএম, ২৯ মে ২০২১ শনিবার

কবির য়াহমদ

কবির য়াহমদ

ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সমস্যা ঐতিহাসিক। দূরবাসী হলেও শোষিত ফিলিস্তিনের পক্ষে আমাদের অবস্থান। তাদের সংগ্রামকে আমরা ন্যায্য সংগ্রাম হিসেবে চিত্রিত করে আসছি। রাষ্ট্রের এই অবস্থান দেশের অধিকাংশ নাগরিকের মতামতের প্রতিফলন। এখানে ভিন্নমত নাই আমাদের, শোষিত-নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রশ্নে আমরা তাদের মতই অনড়। সাম্প্রতিক যুদ্ধেও আমরা ছিলাম ইসরায়েলের বিপক্ষে। যদিও ওখানে আমাদের সামরিক অংশগ্রহণ ছিল না, তবু আমাদের নৈতিক সমর্থন ফিলিস্তিনিদের পক্ষেই গেছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সাম্প্রতিক যুদ্ধের সমাপ্তি হয়েছে। কে জিতেছে, কে হেরেছে সে হিসাব মেলাতে যায়নি আমাদের আবেগী মন। দুই জায়গায়ই প্রাণের অপচয় আর সম্পদহানি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুই দেশেরই লোকজন। ওইসব ক্ষতির আলোচনায়ও আমরা ফিলিস্তিনিদের সংখ্যাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তবু ওখানে ইসরায়েলেও কিছু মানুষ মারা গেছে। শাসকের ভুলে হলেও ওই ক্ষতি তো প্রাণেরই অপচয়। সেগুলো আমরা কমই ধর্তব্যে নিয়েছি। আমরা নিচ্ছি না, যেমনটা ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ সংগ্রামকে আমলে নেয় না পশ্চিমারা, পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও। সোশ্যাল মিডিয়াগুলো ফিলিস্তিনিদের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য ও প্রাণের অপচয়ের সংবাদ আড়াল করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এখানে যুদ্ধংদেহী ক্ষমতাবানের নৈতিকতার যে স্খলন তার সঙ্গেও যোগ রয়েছে এই গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের নীতিনির্ধারকদের।

ইসরায়েল ৭৩ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যা এবং ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর থেকে তাদের উচ্ছেদ করা অব্যাহত রাখা সত্ত্বেও বিশ্ববিবেক এখানে জাগরূক হয় না। ফিলিস্তিনিদের এই সংগ্রামের প্রতি আমাদের সংহতি রয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে মাঠে যুদ্ধে নামি না বা নামব না ঠিক তবে নৈতিক সমর্থন তাদের প্রতি আমাদের। সাম্প্রতিক যুদ্ধেও আমাদের সমর্থন পেয়েছে দেশটি। এই সময়ে ঢাকাস্থ ফিলিস্তিনের দূতাবাসে তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে দেশের অনেকেই আর্থিক সহায়তাও দিয়েছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানও দিয়েছে সহায়তা, সরকার দিয়েছে পঞ্চাশ হাজার ডলার আর্থিক সহায়তা। বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে জানিয়েছেন সংগৃহীত অর্থ দিয়ে গাজায় মেডিকেল সামগ্রী পাঠানো হবে।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই সমর্থন আমাদের ঐতিহাসিক। বাংলাদেশ স্বাধীনের অনেক আগেই ইসরায়েল নামের দেশের অস্তিত্ব থাকলেও বাংলাদেশ অদ্যাবধি ইসরায়েলকে স্বীকার করেনি। ইসরায়েলকে স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দেয় না, দেবে না এমনটাও বলে আসছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে ইসরায়েল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও বাংলাদেশ সেই স্বীকৃতিকে গ্রহণ করেনি। বায়াত্তর সালে স্বাধীন বাংলাদেশকে ইসরায়েল ফের স্বীকৃতি দিলেও বঙ্গবন্ধুর সরকার সেটা গ্রহণ করেনি। যুদ্ধকালে সমর্থন ও স্বীকৃতি, স্বাধীনতাত্তোরকালে ইসরায়েলের দুইবারের এই সমর্থন ও স্বীকৃতি যখন বাংলাদেশ গ্রহণ করেনি তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না শোষিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন কতটা প্রগাড় আর আন্তরিক। বাংলাদেশ সেই আন্তরিকতাকে এখনও অব্যাহত রেখে চলেছে।

নিবন্ধটির উদ্দেশ্য বাংলাদেশ-ফিলিস্তিন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল কিংবা দ্বিপাক্ষিক কোন সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা নয়। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ঐতিহাসিক শত্রুভাবাপন্ন দুই দেশের শত্রুতার সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত করার অদ্ভুত একটা প্রচেষ্টা চলছে জোরেশোরে। স্বার্থের দ্বন্দ্ব না থাকা সত্ত্বেও দেশটির সঙ্গে আমাদের শত্রুতার প্রসঙ্গ সামনে আনা হচ্ছে খোদ সরকারের পক্ষ থেকেই। অথচ এগুলোর দরকার ছিল না আমাদের পক্ষ থেকে, বিশেষ করে সরকারের পক্ষ থেকে।

বাংলাদেশে ইসরায়েল বিরোধী এক প্রবল জনমতের অস্তিত্ব রয়েছে। ইসরায়েল বিরোধিতা এদেশের অনেকের কাছে ধর্মপালনের মত হয়ে গেছে। ইহুদিরা মুসলমানের ঐতিহাসিক শত্রু, এই সিদ্ধান্তে আসা মানুষের সংখ্যা অগণন। দেশের ধর্মীয় বক্তাদের সকলেই ইহুদিদের প্রতি যে বিদ্বেষ ও ঘৃণা প্রচারের কাজ করে চলেছেন তার প্রভাব আছে দেশের সকল স্তরেই। ইহুদি অধ্যুষিত ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে এদেশের মানুষদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনিদের অধিকারের সংগ্রাম না ভেবে ধর্মযুদ্ধ বলে মনে করে। সাম্প্রতিক হামাস ও ইসরায়েলের যুদ্ধকেও তাই অনেকেই ভাবে এটা ধর্মযুদ্ধ। যদিও বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। এখানে দুপক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিক কিন্তু আমাদের অনেকের ধর্মীয় আবেগে ফিলিস্তিনি প্রাণের অপচয় আর ক্ষয়ক্ষতি প্রাধান্য পেয়েছে।

অতি সম্প্রতি ইসরায়েল নিয়ে বাংলাদেশে ঘটেছে অন্য ঘটনা। বাংলাদেশের ই-পাসপোর্ট থেকে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দবন্ধটি তুলে দেওয়া হয়েছে। আগে যেখানে লিখা ছিল- ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’। এখন এটা হয়েছে ‘দিস পাসপোর্ট ইজ ভ্যালিড ফর অল কান্ট্রিজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড’। অর্থাৎ, এই পাসপোর্ট বিশ্বের সব দেশের ক্ষেত্রে বৈধ। এই পরিবর্তন আলোচনায় এসেছে সাম্প্রতিক ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের সময়ে। সরকার বলছে- বিষয়টি তুলে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের ই-পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার জন্য। তার মানে এই নয় যে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ইসরায়েল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা অপরিবর্তিতই থাকছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, ইসরায়েলকে দেশ হিসেবে স্বীকার করি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, কোনো বাংলাদেশি ইসরায়েলে গেলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। সরকার পাসপোর্ট থেকে এক্সসেপ্ট ইসরায়েল শব্দদ্বয় বাদ দিলেও কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা অস্বীকার করছে, এবং ভবিষ্যতেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে উপ পরিচালক রাষ্ট্রদূত গিলাড কোহেনের এক টুইট বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্থাপনে ইতিবাচক কথা বললেও এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার বরাবরের মত কঠিন ভাষা ব্যবহার করেছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, দেশটির সঙ্গে যেখানে আমাদের সরাসরি কোন সংঘাত নেই, স্বার্থের দ্বন্দ্ব নেই সেখানে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করার কী দরকার আমাদের? আমরা স্বাধীনতার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের অধিকারের প্রশ্নে অনড় রয়েছি, সেখানেই থাকি। আগবাড়িয়ে ইসরাইলকে শত্রু-দেশ হিসেবে এখানে বসে হুঙ্কার দেওয়ার প্রয়োজন তো দেখি না। দেশটির সঙ্গে যদি আমাদের স্বার্থের প্রশ্নের যোগ থাকত তাহলে না হয় এর যৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা করা যেত, কিন্তু এখানে তেমন কিছু নেই। ফিলিস্তিনিদের প্রতি আবেগ প্রকাশ করতে এখানে আমাদের ‘ফিলিস্তিনিদের চাইতেও বড় ফিলিস্তিনি’ প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছি কী?

ফিলিস্তিন নিজেদের পাসপোর্টেও কিন্তু ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দদ্বয় লিখে না। আমাদের লেখা হতো। এর আরও একটি দিক রয়েছে। ইসরায়েলকে আমরা ‘দেশ মানি না’ দাবি করে আবার এই শব্দগুলো দিয়ে ইসরায়েলকে প্রকারান্তরে দেশ হিসেবে স্বীকার করেই নেওয়া হতো। দেরিতে হলেও সরকার ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে ‘এক্সসেপ্ট ইসরায়েল’ শব্দদ্বয় বাদ দেওয়ার মাধ্যমে। সরকার বলছে ‘পাসপোর্টের মান বাড়াতে’ এই সিদ্ধান্ত। সিদ্ধান্তের কারণ যাই হোক এটা সঠিক এক পদক্ষেপ হিসেবেই আমরা দেখছি। তবে এই সিদ্ধান্তের বাইরে হঠাৎই সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী যেভাবে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছেন, যার প্রয়োজন নেই। ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের স্বার্থের কোন দ্বন্দ্বও নেই। এমন অবস্থায় আক্রমণাত্মক বক্তব্যের মাধ্যমে দেশটিকে শত্রুজ্ঞান করা অপ্রাসঙ্গিক।

ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক স্থাপন হবে না, এটা এখন পর্যন্ত সরকারের সিদ্ধান্ত। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের নিজস্ব। তবে এই সিদ্ধান্তের উপযোগিতা প্রমাণ করতে দেশটির প্রতি আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার দরকার আছে কি? মানোয়ার হোসেন নামের ফেসবুকে আমার এক বন্ধু মন্ত্রীদের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এটাকে ‘খাল কেটে ইসরায়েল আনার চেষ্টা’ হিসেবেই দেখছেন! মানোয়ার হোসেনের এই মন্তব্য শব্দ বুননে রসাত্মক, অথচ শঙ্কার দিক থেকে অর্থবোধক! বৈশ্বিক রাজনীতিতে অন্ধকার যে দিক সেখানে অনেক ক্ষেত্রে অনেকের বিশেষত নীতিনির্ধারকদের নিরাপত্তার ব্যাপারও জড়িয়ে থাকে। ওঁত পেতে থাকা অন্ধকারের আততায়ীদের সুযোগ দিতে যাব কেন আমরা?

ইসরায়েলের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক নাই, আমরা বাধ্যও নই সম্পর্ক স্থাপনে; এটা একান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। ফিলিস্তিনের প্রতি আমাদের সমর্থন আছে, শোষিতদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আছে, আবেগ আছে; এটাও আমাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত। এসবে হস্তক্ষেপ করতে পারবেও না কেউ। আমাদের যে ক্ষমতা, যে অধিকার, যে সিদ্ধান্ত সেগুলো ভোগ করার বিপরীতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে কারও প্রতি আক্রোশের ধারাবাহিক প্রচারণারও নৈতিক অধিকার নাই আমাদের। আমরা কেন শত্রু বাড়াতে যাব? আমরা বাংলাদেশি বাঙালি, এটাই আমাদের পরিচয়। আমরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি দুর্বল, এটা আমাদের ঔদার্য। এই ঔদার্যের প্রকাশ করতে গিয়ে ‘ফিলিস্তিনিদের চাইতেও বড় ফিলিস্তিনি’ হয়ে পড়ার চেষ্টা করলে আমরা আমাদের স্বাতন্ত্র্যটাই হারাব হয়তো!

[এই কলামে তুলে ধরা মত লেখকের নিজস্ব]